Gift Economy

Gift Economy: জিনিসপত্র থেকে সময়, নিজের উদ্বৃত্ত সব নিয়ে সমাজের পাশে দাঁড়াতে তৈরি ‘উপহার অর্থনীতি’

আমাদের শহুরে জীবন আসলে বস্তুগত প্রাচুর্যে ঠাসা। রোজনামচায় এমন সহস্র জিনিস আমাদের ঘিরে থাকে, আদতেই যার জীবনে কোনও ব্যবহার নেই।

Advertisement

অরিত্র দত্ত বণিক

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২২ ১৪:৪২
Share:

আপেক্ষিক ভাবে মনে হতে পারে এটা নেটমাধ্যমে এক ধরনের বাজার। অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।

কোভিড পরবর্তী জগৎ নাকি কেবলই নেতিবাচক! শারীরিক, মানসিক কিংবা সামাজিক— সব দিকেই ক্ষয় আর বিপর্যয়। এ সব খবরে যখন আমরা সামগ্রিক ভাবে নিরাশ, তখন সুদূর পশ্চিমে, আমেরিকায় নেটমাধ্যমের নতুন দিগন্তে লন্ঠন জ্বেলেছেন দুই বন্ধু রেবেকা ও লিজেল।

Advertisement

বছর কয়েক আগে সপরিবার কোনও এক সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে গিয়েছিলেন দুই বন্ধু। সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যের বিরাট স্তূপ দেখে হতচকিত হয়ে যান। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে নানা তট থেকে প্লাস্টিক বর্জ্যের এই নমুনা সংগ্রহ করতে করতে তাঁদের মনে হয়, এগুলি তো আসলে সভ্যতার অনাচারের ফসল! তাই এমন কিছু করা উচিত, যাতে কোনও এক ভবিষ্যতে সাগরবক্ষে এ সব যেন আর না দেখা যায়। সে দিন থেকেই নতুন প্রতিজ্ঞা। শুরু হল ‘বাই নাথিং প্রজেক্ট’। ‘বাই নাথিং’ অর্থাৎ কিছু কেনার দরকার নেই।

আমাদের শহুরে জীবন আসলে বস্তুগত প্রাচুর্যে ঠাসা। রোজনামচায় এমন সহস্র জিনিস আমাদের ঘিরে থাকে, আদতেই যার জীবনে কোনও ব্যবহার নেই। দিনকতক বাদে, মেয়াদান্তে তাদের ঠাঁই সেই বর্জ্যের স্তূপে। এই প্রাচুর্য ও অপচয় দিনান্তে ডাক পাঠায় সভ্যতার অবক্ষয়কে। জেগে ওঠে প্রকৃতির রুষ্ট সত্ত্বা। ‘বাই নাথিং’ প্রকল্প গড়ে উঠেছে ফেসবুকের হাত ধরে। এই প্রকল্পের আওতায় গড়ে উঠছে শহরভিত্তিক কিছু অধি-আঞ্চলিক (হাইপার-লোকাল) গ্রুপ। এই গ্রুপগুলির মাধ্যমে ছোট ছোট ভৌগোলিক পরিধিতে গড়ে উঠেছে কমিউনিটি। কমিউনিটির সদস্যেরা তাঁদের জীবনে ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত অপ্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী অথবা নিজের ‘উপহারযোগ্য প্রতিভা’র কথা পোস্ট করেন। কেউ কেউ পোস্ট করেন নিজেদের প্রয়োজন বা চাহিদার কথাও। এই কমিউনিটির সদস্যেরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দ্রব্য এবং পরিষেবার আদানপ্রদান হয়।

Advertisement

আপেক্ষিক ভাবে মনে হতে পারে এটা নেটমাধ্যমে এক ধরনের বাজার। কিন্তু এই পদ্ধতির অন্যতম বিশেষত্ব— এখানে টাকাপয়সার কোনও জায়গা নেই। নেই বিনিময় প্রথাও। আবার একে কোনও ভাবেই আপনি এক শব্দে ‘দান’ বা ‘ভিক্ষা’ বলে ছোট করতে পারবেন না। বরং এ সবের মাধ্যমে এই কমিউনিটি গড়ে তুলছে নতুন রকমের এক দুনিয়া। যাকে ‘উপহার অর্থনীতি’ বলা যেতে পারে। সুস্থিত উন্নয়নের প্রগতিশীল দর্শনকে সামনে রেখে সুদূর ভবিষ্যতে সেই দুনিয়ায় নতুন করে কিছু কিনে নয় বরং নিজের প্রাচুর্যের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব হবে। কাউকে কিছু দিলে তার বিনিময়ে কিছু পাওয়ার লোভ নয়। বরং কৃতজ্ঞতা ও মানবতাই হবে একমাত্র মুনাফা।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
সামাজিক মূলধনের ধারণা সভ্যতার আদিলগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠিত। প্রশান্ত মহাসাগরীয় কিছু দ্বীপের আদিবাসীদের মধ্যে ‘পটল্যাচ’ নামে এক প্রথা বহু আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ওই প্রথা অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক ভাবে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে বা এক শ্রেণি থেকে আর এক শ্রেণির মানুষের কাছে বিভিন্ন বস্তুগত সম্পদ ‘উপহার’ হিসেবে হস্তান্তর করা হত। এই উপহার প্রদানের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হত সামাজিক পদমর্যাদা। কখনও কখনও দুই শত্রুগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার সূচক হিসেবেও কে কী ধরনের উপহার দেয়, তাকে মাপকাঠি হিসাবে ধরা হত। এই হস্তান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠা সামাজিক যোগাযোগকে গণ্য করা হত সামাজিক মূলধন হিসেবে। পরবর্তী কালে, টাকার প্রচলন শুরু হওয়ার পরে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একটি সাধারণ অর্থনীতির কাঠামোয় আনা হয় এবং এই প্রথা ধীরে ধীরে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রাচীন সমাজের সেই ‘পটল্যাচ’কেই বলা যেতে পারে নতুন ভাবে সাজিয়ে তুলে আজকের স্ন্যাপচ্যাট প্রজন্মের সমাজে একে অপরের কাছে টেনে আনার প্রচেষ্টাই এই ফেসবুক-ভিত্তিক ‘বাই নাথিং’ প্রকল্প।

মূলত তিন ধরনের পোস্টকে প্রাধান্য দেওয়া হয়—

১. উপহার: গ্রুপে আপনি পোস্ট করতে পারেন এমন কোনও পরিষেবা বা জিনিসের কথা, যা আপনার কাছে অপ্রয়োজনীয়। অথচ আপনি সেটা আপনার প্রতিবেশিকে উপহার হিসেবে সাময়িক বা পাকাপাকি ভাবে দিয়ে দিতে ইচ্ছুক।

২. খোঁজ: আপনার কোনও পরিষেবা বা জিনিসের প্রয়োজন, যেটা আপনার কাছাকাছি এলাকায় কারও কাছে আছে কি না জানতে চান।

৩. কৃতজ্ঞতা: এই সংক্রান্ত পোস্টই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই কমিউনিটির বিশ্বাস, যোগাযোগই হল আসল সম্পদ। তাই নিজের এলাকার অচেনা মানুষের সঙ্গে আলাপ করা, তাঁর থেকে কোনও উপহার পাওয়ার বিনিময়ে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাতে পোস্ট করতে পারেন গ্রুপে।

কত রকমের উপহার দেওয়া যাবে?

আচারের প্যাকেট থেকে ড্রায়ার মেশিন— যে কোনও সামগ্রী উপহার হিসেবে গণ্য হয়। পাশাপাশি, এমন তিনটি উপহারের কথা এই কমিউনিটি বলে, যা জেনারেশন ‘জি’ ও ‘আলফা’র কাছেও একেবারে নতুন।

১. নিজস্বতা
বস্তুগত মূল্যায়নের আগে মানুষ হিসেবে এই সমাজে আমরাই একে অপরের সম্পদ। তাই ‘বাই নাথিং’ কমিউনিটিতে সবার আগে প্রতিবেশি বন্ধুর কাছে নিজেকে উপহার হিসেবে হাজির করতে পারেন। ধরুন, আপনার কাছাকাছি কোনও প্রবীণা একা থাকেন। আপনি তাঁর বাড়িতে বাগান পরিচর্যায় সাহায্য করতে চান। অথবা হতে চান কারও যোগ ব্যায়ামের মেন্টর। কিংবা কোনও সমবয়সির গেম খেলার সঙ্গী হতে চান। এ সব নিজেই নিজেকে উপহার হিসেবে বেছে নেওয়া। নিজস্বতা ফিরে পেতে এই কমিউনিটি আপনার পছন্দের প্ল্যাটফর্ম হতে পারে।

২. প্রতিভা
আমাদের সকলেরই কিছু না কিছু প্রতিভা আছে। জীবন ও জীবিকা নির্বাহের পরেও যে অতিরিক্ত সময় ও এনার্জি বেঁচে থাকে, সেটুকু দিয়েই আমরা সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারি। এই কমিউনিটির সাহায্যে কাউকে গান শোনাতে পারি। কম্পিউটারপ্রেমী ছাত্রকে পড়াতে পারি। আবার পেটুক কোনও বন্ধুর বাড়ি গিয়ে তাঁকে নিজের পছন্দের রেসিপিও শিখিয়ে আসতে পারি।

৩. সময়
কেরিয়ার, সাফল্য, পার্থিব সমৃদ্ধির শিখরে ওঠার লড়াইয়ে আমরা বড় একা হয়ে পড়ি। সব কিছু থাকলেও ‘হাইব্রিড চ্যাট বেস্ড’ প্রজন্মের কাছে মূলত যে জিনিসের অভাব, তা হল সময়। এবং সময় কাটানোর মতো প্রকৃত অফলাইন বন্ধু। এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আপনি সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারেন। কখনও কারও প্রাতঃর্ভ্রমণের সঙ্গী হতে বা কারও সঙ্গে এক দিন কফি খেতে যেতে চাইলে এই গ্রুপে পোস্ট করতে পারেন। এ ছাড়াও ক্লাব ফরম্যাটে আঞ্চলিক গ্রুপগুলো তাদের নিজেদের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

এই রকমের একটি প্রথা আগেও প্রচলিত ছিল। বিশেষত কানাডায়। সেখানে অব্যবহৃত নানা জিনিস বাড়ির বাইরে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দেওয়া হত। যে কেউ তাঁর দরকার মতো এসে গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তা নিয়ে যেতে পারতেন। একসঙ্গে একই জিনিসের জন্য একাধিক মানুষ এলে ‘আগে এলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে লেনদেন চলত। তবে যোগাযোগের পরিধি ও সম্ভাবনা ছিল সঙ্কীর্ণ। স্বচ্ছতারও অভাব ছিল। কিন্তু নেটমাধ্যমের এই নতুন কমিউনিটিতে সমস্ত লিস্টিং ‘পাবলিক’। অর্থাৎ সকলের জন্য একই সময়ে উন্মুক্ত। তাই কার, কখন, কোনটা দরকার এবং কে, কখন যোগাযোগ করছেন সেই প্রক্রিয়াও স্বচ্ছ। পাশাপাশি সকল সদস্যের কাছে ভরসাযোগ্য। মাত্র ৮ বছরের যাত্রায় শুধু ফেসবুকের মাধ্যমে প্রায় ৪৪টিরও বেশি দেশে প্রায় ৫ মিলিয়ন সদস্যকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘বাই নাথিং’ কমিউনিটি। তবে এখন ফেসবুকের নিজস্ব নানা জটিলতার কারণে এই প্রকল্পের নিজস্ব অ্যাপ বানানো হচ্ছে। সেখানেই নিজেদের মতো করে সামাজিক সংযোগ গড়ে তুলবেন সদস্যেরা। সুদূর ভবিষ্যতে ভারতের মতো দেশেও সমস্ত স্তরের মানুষের মধ্যে এ রকম এক মানবতার নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেওয়া যায় কি না, সে দিকেই তাকিয়ে থাকব আমরা। হয়তো এক দিন বলতে পারব, আমরাও ‘উপহার অর্থনীতি’র অংশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement