মার্চ গেল, এপ্রিল প্রায় শেষ। একটা কালবৈশাখীও কিন্তু এ বার পেলাম না আমরা। —প্রতীকী চিত্র।
সাতসকালে গাঙ্গুলিবাগানের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম নদিয়ার হরিণঘাটা। বাহক একটি বাতানুকূল গাড়ি। বেশ কয়েক জনকে রাস্তা থেকে তুলে যখন বারাসত পেরোচ্ছি, বাইরে সূর্যটা যেন গিলে খেতে চাইছে! গরম হয়ে যাচ্ছে ১৬ আসনের গাড়ির ভিতরটা। মনে হচ্ছে যেন গাড়ির বাতানুকূল যন্ত্রটা চলছে না। আমার আসনটা সূর্যের দিকে। পাশে বসা অধ্যাপকের মতো আমার কপালেও জমতে শুরু করেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
বাসের পিছনে বাতানুকূল যন্ত্রটি যেখানে, তার কাছাকাছি বসা এক যাত্রী অনুযোগ করলেন চালকের কাছে, ‘‘এসিটা কি বন্ধ করে দিয়েছেন ভাই?’’ আসলে জানলা-দরজা বন্ধ ছোট ওই বাসটির ভিতরে বসে থাকা সকলের অস্বস্তি শুরু হয়েছে যে! আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেই নদিয়া জেলা কর্কটক্রান্তি রেখার কাছাকাছি। তাই সওয়া ১০টা নাগাদ হরিণঘাটার গন্তব্যে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই যেন গিলে খেতে এল একরাশ গরম হাওয়া। উত্তর ভারতে গ্রীষ্মকালের দুপুরে এই রকম গরম হাওয়া বয়ে যায়। যার পোশাকি নাম লু। দিল্লি, রাজস্থান, হরিয়ানার নাগরিকেরা এই রাক্ষুসে হাওয়া থেকে বাঁচতে আপাদমস্তক ঢেকে রাখেন। যে ভাবে তাপমাত্রা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, তাতে কলকাতার রাস্তাতেও গত ক’দিন ধরে এই দৃশ্যটা কিন্তু চোখে পড়ছে। ক’দিন আগে মাস্ক যেমন ছিল নিত্যসঙ্গী, এখন ব্যাগে ছাতা, একটা তোয়ালে কিংবা নিদেন পক্ষে একটা টুপি থাকাটা জরুরি। বৈশাখের মাঝামাঝি এখনও পৌঁছয়নি আমরা। কিন্তু তাপপ্রবাহ কাহিল করে ফেলছে সবাইকে। করোনার চতুর্থ ঢেউ আসবে বলে প্রহর গুনছে সবাই। কিন্তু তার আগেই মানুষকে গৃহবন্দি রাখার ছক কষেছে ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তাপমাত্রা।
চৈত্র মাসের শেষ দিনে আফসোস করেছিলাম কালবৈশাখী না আসার জন্য। তার পর দিন দশেক অতিক্রান্ত। কালবৈশাখীর জন্য হাপিত্যেশটা আরও জোরদার হচ্ছে। নিয়ম মতে আর মাসখানেকের মধ্যেই আন্দামানের কাছে মৌসুমি বায়ু জন্ম নেওয়ার কথা। এখন থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, যে ভাবে কালবৈশাখী এ বার বঞ্চিত করেছে, বর্ষা কি সে ভাবেই আমাদের ফাঁকি দেবে? দিল্লির মৌসম ভবন কিন্তু ইতিমধ্যেই এ বার অনিয়মিত বর্ষার পূর্বাভাস দিয়েছে। করোনা প্রাণে মেরেছে, আবহাওয়ার এই খামখেয়াপনা কি তা হলে এ বার ভাতে মারার জোগাড় করছে?
এখন তাপমাত্রা চড়চড় করে বাড়লেও কালবৈশাখীর অন্য উপকরণ জলীয়বাষ্প প্রায় নেই বললেই চলে— কারণ ভিন্ন, কিন্তু ফল এক। —ফাইল চিত্র।
মার্চ গেল, এপ্রিল প্রায় শেষ। একটা কালবৈশাখীও কিন্তু এ বার পেলাম না আমরা। নদিয়া- মুর্শিদাবাদের কয়েক জায়গায় স্থানীয় ভাবে বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হয়ে বৃষ্টি হয়েছে গত সপ্তাহান্তে। কিন্তু তাপমাত্রা কমানোর শক্তি তার ছিল না, ছিল না ব্যাপ্তিও। কালবৈশাখীর জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে আবহবিদেরা বলছেন, ছোটনাগপুর মালভূমিতে তাপমাত্রা যত বাড়ে, ততই বাড়ে কালবৈশাখীর সম্ভাবনা। তার জন্য মূলত দু’টি প্রাকৃতিক অবস্থার প্রয়োজন। ঝাড়খণ্ড আর সন্নিহিত অঞ্চলে লাগামছাড়া তাপমাত্রা এবং বঙ্গোপসাগরের উচ্চচাপ বলয়। ঝাড়খণ্ড-ছত্তীসগঢ় হল কালবৈশাখীর রান্নাঘর। সেখানে তাপমাত্রা যত বাড়বে, ততই গরম হবে ভূপৃষ্ঠ। মাটি থেকে বিকিরিত তাপ বাতাসকে গরম করে দেয়। বাতাস যত গরম হয়, ততই তা উঠতে থাকে উপরের দিকে। ঝাড়খণ্ড ও দক্ষিণবঙ্গে আবহাওয়ার এই অবস্থায় বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয় উচ্চচাপ বলয়, যা জলীয়বাষ্পকে ঠেলে নিয়ে যায় বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে। জলীয়বাষ্প সেই গরম বাতাসের সংস্পর্শে এলে উল্লম্ব মেঘপুঞ্জ তৈরি হয়। তার পরে জলীয় বাষ্পপূর্ণ উল্লম্ব মেঘপুঞ্জ ঝাড়খণ্ডের দিক থেকে এগিয়ে আসে দক্ষিণবঙ্গের দিকে। এক সময় তা জলীয় বাষ্প ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ভেঙে পড়ে। জন্ম হয় কালবৈশাখীর।
এটা ঠিক যে, বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পরিস্থিতিটা এই রকমই ছিল। কিন্তু বঙ্গোপোসাগরের থেকে আসা জলীয় বাতাসের আগমনটা হঠাৎ করে কমে যাওয়াতে উত্তর ও মধ্য ভারত থেকে আসা গরম শুকনো বাতাসকে বাধা দেওয়ার কাউকে পাওয়া যায়নি। তাই গরম বাতাস যেমন তাপমাত্রাকে লাগামছাড়া করে দিয়েছে। সূর্যের সামনে কালো পর্দার মতো আড়াল করার মেঘপুঞ্জও তৈরি হতে পারছে না। এই পরিস্থিতিটা কিন্তু প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে খুবই প্রতিকূল। সপ্তাহ দেড়েক আগেও পরিমণ্ডলে জলীয়বাষ্প ছিল যথেষ্ট, কিন্তু তাপমাত্রা তেমন বাড়েনি— তাই কালবৈশাখী হয়নি। আর এখন তাপমাত্রা চড়চড় করে বাড়লেও কালবৈশাখীর অন্য উপকরণ জলীয়বাষ্প প্রায় নেই বললেই চলে— কারণ ভিন্ন, কিন্তু ফল এক। কালবৈশাখী আর জন্মাল না।
শহর জুড়ে বহুতলের সারি। বহুতলে আকাশ ঢাকা পড়েছে শহরতলিতেও। তার অনেকগুলিই তৈরি হয়েছে পুকুর-ডোবা-নালা বুঝিয়ে। যারা মাটিতে রস ভরে দিত। সেই সব বহুতলের বাসিন্দাদের মুখে জল তুলে দিতে ভূগর্ভ থেকে লাখ লাখ গ্যালন জল উঠছে প্রতি দিন। ফসল বাঁচাতে কৃষিজীবীরা অগভীর নলকূপ নির্ভর হয়ে পড়ছেন। একটা বিষয় চিন্তা করে দেখুন— বৃষ্টি নেই। মাটি ফুটিফাটা। তার উপরে যেটুকু রস মাটির নীচে জমে আছে, তা-ও আমরা সব নিংড়ে নিচ্ছি। মাটির নীচে আর্সেনিক, ফ্লুওরাইড আমাদের চোখ রাঙাচ্ছে। উপরে চোখ রাঙাচ্ছে সূর্য। আমাদের কিন্তু মুখ লুকানোর আর জায়গা থাকবে না।