২০১১ সাল থেকে ভারতে দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে ১২.৩ শতাংশ ছবি: রয়টার্স
আজকের পরিণতি আমাদেরই ধারাবাহিক নির্মাণ। না। এই শব্দবন্ধ আমার নয়। ২০২১ সালে এই এপ্রিল মাসেই অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা একটি প্রবন্ধে এটিই ছিল শেষ বাক্য। এ যে কতটা সত্যি এবং অকাট্য তা আজ আমাদের জীবনের মূল্যে বুঝতে হচ্ছে। বুঝতে হচ্ছে হারিয়ে যেতে থাকা অধিকারের মূল্যে।
ধরা যাক দারিদ্র হ্রাস নিয়ে সাম্প্রতিক উল্লাসকে। এই উল্লাসের সূত্র বিশ্বব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষা। স্মিতা সিন্হা রায় এবং রয় ভান ডার ওয়েডের করা এই সমীক্ষাটি এই মাসেই প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাঙ্ক। তাতে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ২০১১ সাল থেকে ভারতে দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে ১২.৩ শতাংশ। এই সংখ্যাটি অবশ্যই শ্লাঘার। কিন্তু কতটা সেটাও বিচার করার একটা জায়গা তৈরি করে গিয়েছেন সমীক্ষকরা।
সমীক্ষাটির শিরোনাম অনুবাদে দাঁড়ায় এই রকম: ‘ভারতে দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু যতটা ভাবা হয়েছিল ততটা নয়’। আমাদের উল্লাসটা ছিল শিরোনামের প্রথম অংশ নিয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় অংশটা আমরা আর ধর্তব্যের মধ্যে রাখিনি। কেন? তা বোঝার জন্য কিছু তথ্যে আমাদের চোখ রাখতে হবে। দারিদ্র আপেক্ষিক। বড়লোকের দেশে যাকে দরিদ্র হিসাবে চিহ্নিত করা হবে, গরিবের দেশে তিনিই কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত হিসাবে পরিচিত হতে পারেন। বিশ্বব্যাঙ্কও সেই তুলনা মাথায় রেখে কোন আয়ে কোন দেশে দারিদ্রসীমা টানা হবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর এর নির্ধারক হল সংশ্লিষ্ট দেশের টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময় মূল্য, যা স্থির হয় ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে।
ভারতের স্থান কোথায়? ছবি: রয়টার্স
ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে হিসাব করা বিনিময় মূল্যের সঙ্গে কিন্তু সাধারণ বৈদেশিক মূদ্রার বিনিময় মূল্যের তফাত আছে।
ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে যে বিনিময় মূল্য তৈরি হয় (উদাহরণ হিসাবে আমাদের টাকা আর আমেরিকান ডলার ধরেই চলা যাক) তা বলে আমেরিকায় ১ ডলারে যা কেনা যায়, ঠিক সেই পণ্যই ভারতের বাজার থেকে কিনতে কত টাকা দিতে হবে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাঙ্ক নির্ধারিত হারে এই বিনিময়মূল্য হল ডলার পিছু ২১ টাকা ৬১ পয়সা। সাধারণ বৈদেশিক মূদ্রার বিনিময় হার বলে বিদেশ থেকে ১ ডলার দামের জিনিস কিনতে বা বাজার থেকে ১ ডলার কিনতে আমাদের কত টাকা দাম দিতে হবে। আর এই লেখার মুহূর্তে টাকায় ১ আমেরিকান ডলারের দাম দাঁড়িয়েছে ৭৬ টাকা ২০ পয়সা।
বিশ্বব্যাঙ্কের অঙ্কে নিম্ন আয়ের দেশ দারিদ্রসীমা টেনেছে দৈনিক ১.৯০ ডলারে। নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশের ক্ষেত্রে ৩.২০ ডলার আর উচ্চ মধ্যবিত্ত দেশের ক্ষেত্রে তা ৫.৫০ ডলার। টাকায় পরিবর্তন করলে নিম্ন আয়ের দেশের পক্ষে তা দাঁড়ায় ৪১ টাকা ৬ পয়সায়। বাকি অঙ্কে আর যাচ্ছি না। কারণ, আমাদের কাছে এই অঙ্কটাই কাজের।
এ বার বিশ্বব্যাঙ্কের অঙ্কে কোন দেশ মাথাপিছু জাতীয় আয়ের (ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে নির্ধারিত বিনিময়মূল্য) ভিত্তিতে কোথায় দাঁড়িয়ে সেই অঙ্কটি দেখে নেওয়া যাক। তালিকাটি এই রকম:
নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশ: ১০৪৬ ডলার থেকে ৪০৪৬ ডলার
উচ্চ মধ্যবিত্ত দেশ: ৪০৯৬ ডলার থেকে ১২৬৯৫ ডলার
উচ্চবিত্ত দেশ: ১২৬৯৫ ডলারের বেশি
ভারতের স্থান কোথায়? মাথা পিছু ৬৪৪০ আমেরিকান ডলার বা ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ১৬৮ টাকার হিসাবে ভারত উচ্চ মধ্যবিত্তের সারিতে স্থান পেয়েছে। সেই অঙ্কে কিন্তু দারিদ্রসীমা হওয়া উচিত ৫.৫ আমেরিকান ডলার বা ১১৮ টাকা ৮০ পয়সায়। কিন্তু এই সমীক্ষায় তা ধরা হয়েছে ৪১ টাকা ৬ পয়সায় যা নিম্ন আয়ের দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য!
কারণ? বৈষম্য। মাথাপিছু আয় একটা গড় হিসাব। সহজ করে বললে জাতীয় আয়কে লোক সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে যা দাঁড়ায় তাই। ধরা যাক এক সঙ্গে পাঁচ জন আছেন। এক জনের আয় ৫ লক্ষ টাকা। বাকি চার জনের আয় শূন্য। গড়ের হিসাবে মাথাপিছু আয় তো ১ লক্ষ টাকাই দাঁড়ায়। আর এই সংখ্যা যে ছবি তৈরি করে তার থেকে বাস্তবের তো আকাশা-পাতাল ফারাক! ভারতের ক্ষেত্রেও ঘটনাটা তাই।
এই অঙ্কে আয় বৈষম্যকে ধরেই দারিদ্র্যসীমাকে নিম্ন আয়ের দেশ হিসাবে দেখা হয়েছে, গড় আয়ের অঙ্ক যাই বলুক না কেন। আর তাই আমরা গাছেরও খাচ্ছি তলারও কুড়োচ্ছি। যখন গড় আয়ের কথা উঠছে তখন আমরা উচ্চ মধ্যবিত্ত। কিন্তু কখনই বলছি না সেই অঙ্কে বা ১১৮ টাকা ৮০ পয়সায় দারিদ্রসীমা নির্ধারণ করলে ভারতে গরিবের সংখ্যা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াত।
তথ্যটা গুটিয়ে আনলে কী দেখব আমরা? যদিও আমরা গড় আয়ের অঙ্কে উচ্চ মধ্যবিত্ত দেশ, কিন্তু দারিদ্রের নিরিখে আমরা নিম্ন আয়ের দেশ। আর তার কারণ হল ভারতে আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। আর আয়ের ভিত্তিতে ভারত এখন দ্বিখণ্ডিত। যে ভারতে বেশির ভাগ মানুষ বাস করে সেই ভারত নিম্ন আয়ের। আর তাই দারিদ্রের হিসাব করা হয় সেই ভারতকে নিম্নবিত্ত ধরেই। যদিও বিশ্বে আমরা সুযোগ নিই গড় আয়ের নিরিখে নিজেদের উচ্চ মধ্যবিত্ত বলে। আর গর্ব করি দারিদ্র কমেছে বলে। বলি না এই অঙ্ক কষা হয়েছে সেই ভারতকে ধরেই যে ভারত নিম্নবিত্ত। এ নির্মাণ তো আমাদেরই।