বাঁচার লড়াই দেশ জুড়ে
George Floyd

পুলিশবাহিনীর চোখে আজও কৃষ্ণাঙ্গ মানেই সন্দেহভাজন

পুলিশি হিংসার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের একটি স্লোগান নিহতদের সবার নাম মনে রাখতে অনুরোধ করে।

Advertisement

সারণ ঘটক

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২০ ০০:২৮
Share:

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তাঁর রক্ষীরা ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে নিয়ে যেতে বাধ্য হলেন, হোয়াইট হাউসের জনবিক্ষোভের আকারপ্রকারে আশঙ্কিত হয়ে। দেশ জুড়ে এই উত্তাল আন্দোলন শুধু জর্জ ফ্লয়েডের জন্যই নয়। গত পঞ্চাশ বছরে এ দেশে পুলিশের হাতে যে কয়েক হাজার কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের প্রাণ গেছে— যাঁদের অনেকেই পরে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন— তাঁদেরও নামে।

Advertisement

আর তাই, পুলিশি হিংসার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের একটি স্লোগান নিহতদের সবার নাম মনে রাখতে অনুরোধ করে। সব নাম সম্ভবত খবরের কাগজের পাতায় ধরবে না। মার্চে কেন্টাকির লুইভিল শহরে ব্রিওনা টেলার নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবতীকে ভুল সন্দেহে তাঁর বাড়িতেই পুলিশ গুলি করে মারে। ফেব্রুয়ারিতে জর্জিয়ায় আহমদ আরবারি নামের এক তরুণ এক প্রতিবেশীর গুলিতে মারা যান। স্থানীয় পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করেনি, পরে জনমতের চাপে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কৃষ্ণাঙ্গ জীবনে পুলিশি হেনস্থা প্রাত্যহিক ঘটনা। অনেক কালো বাবা-মা-ই সন্তানদের শেখান, পুলিশ যা বলে তা অন্যায় হলেও মাথা নত করে না শুনলে প্রাণসংশয়!

পরিসংখ্যান বলছে, শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের পুলিশের হাতে মারা পড়ার সম্ভাবনা প্রায় আড়াই গুণ বেশি। পরিসংখ্যান এও বলে, দেশে কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্য সংখ্যালঘু নাগরিকদের কারাবাস, বেকারত্ব, দারিদ্র, অসুখের হারও বেশি। সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা বলছে, এর মূলে আছে প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের দীর্ঘ ইতিহাস। এই দেশের পত্তন হয়েছিল স্বাধীনতার নামে, কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের তিন-পঞ্চমাংশ মানুষের মানবাধিকার বলতে কিছু ছিল না। তাঁদের জন্ম, জীবন-মৃত্যু মালিকদের খিদমত খেটে। পলাতক ক্রীতদাসদের গ্রেফতার করে মালিকের কাছে ফেরত পাঠানো ছিল দেশের প্রথম পুলিশ সংস্থাগুলির অন্যতম প্রধান কাজ।

Advertisement

১৮৬০-এর দশকে গৃহযুদ্ধে ক্রীতদাস প্রথা বিরোধী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্বে মার্কিন সরকারের কাছে ক্রীতদাস প্রথাকামী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী দক্ষিণের রাজ্যগোষ্ঠীর পরাজয় হলেও এই সব রাজ্যে সদ্য মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের সামাজিক বা অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে স্থানীয় সরকারগুলি বিশেষ তৎপরতা দেখায়। তখন সাদা ও কালো সমাজ ছিল সম্পূর্ণ পৃথক। কৃষ্ণাঙ্গরা নামেই স্বাধীন, তাঁদের কোনও অধিকার ছিল না। প্রতিবাদের চেষ্টা করলে পুলিশের হাতে বা গণহিংসায় প্রাণহানি। ১৮৮০-র দশক থেকে ১৯৬০-এর দশক— প্রায় চার হাজার কৃষ্ণাঙ্গের গণহত্যায় মৃত্যু ঘটেছে। ছবিতে দেখা যায় সেই হতভাগ্যদের ক্ষতবিক্ষত প্রাণহীন দেহের সামনে শ্বেতাঙ্গদের উৎসব। এই ইতিহাস ও বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতেই আজকের আন্দোলনকে বোঝা চাই।

বিশ শতকের গোড়ায় দেশের দক্ষিণের রাজ্য ছেড়ে বিপুল সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ উত্তরের রাজ্যগুলিতে নতুন গড়ে ওঠা কারখানায় কাজ ও শহুরে জীবনে মুক্তির সন্ধানে পাড়ি দেন। ১৯২০-র দশকে শিকাগোর সাউথসাইড, সাউথ সেন্ট্রাল লস এঞ্জেলস, নিউ ইয়র্কের হার্লেম ইত্যাদি এলাকায় বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ গড়ে ওঠে। কিন্তু শহরে দৈনন্দিন স্বাধীনতা ও সচ্ছলতা বেশি হলেও বর্ণবিদ্বেষ থেকে মুক্তি মেলেনি। নিউ ইয়র্ক বা শিকাগোর যে-সব সান্ধ্য ক্লাবে জ্যাজ়ের জন্ম, সেখানে বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ গায়ক-গায়িকাদেরও সামনের দরজা ব্যবহার নিষেধ ছিল, খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকতে হত। তিরিশের দশকে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজ়ভেল্টের ‘নিউ ডিল’ দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্পের নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার প্রচেষ্টা থেকেও কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের

মানুষ বঞ্চিত হন। রুজ়ভেল্ট ইচ্ছে থাকলেও কৃষ্ণাঙ্গদের সমানাধিকারের জন্য কিছু করতে পারেননি, কারণ তখন আমেরিকার সেনেট তথা তাঁর ডেমোক্র্যাটিক দলে দক্ষিণের রাজ্যগুলির বর্ণবিদ্বেষীদের প্রবল প্রতিপত্তি, তাদের সম্মতি ছাড়া কোন আইন পাশ অসম্ভব। তা সত্ত্বেও রুজ়ভেল্ট কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে বর্ণবৈষম্য বেআইনি ঘোষণা করেন এবং তাঁর উত্তরসূরি ট্রুম্যান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে মার্কিন সেনাবাহিনীতে বর্ণবিভেদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

পঞ্চাশের দশক থেকেই সামাজিক অধিকার আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৫৪ সালে মার্কিন শীর্ষ আদালত এক ঐতিহাসিক রায়ে শিক্ষাক্ষেত্রে বর্ণবিভেদ অসাংবিধানিক এবং সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্ণনির্বিশেষে সব নাগরিকের সমাধিকার ঘোষণা করে। শীর্ষ আদালতের আদেশ সত্ত্বেও দক্ষিণের রাজ্যগুলি স্কুলের দরজা কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের জন্য সহজে খুলতে চায়নি। প্রেসিডেন্ট আইজ়েনহাওয়ার ও পরে কেনেডির প্রশাসন আরকানসাস, মিসিসিপি, আলাবামায় বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় রক্ষীবাহিনীর হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের আসার ব্যবস্থা করেন। ষাটের দশকের গোড়ায় ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি এবং তাঁর ভাই, আইনসচিব রবার্ট কেনেডি সকল নাগরিকের সমান সামাজিক অধিকারের জন্য নতুন আইনের দাবি সমর্থন করেন। আততায়ীর হাতে কেনেডির মৃত্যুর পরে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের উদ্যোগে ১৯৬৪ সালে নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার আইন হয়। কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের আইনত সমানাধিকার অর্জন করতে ক্রীতদাস প্রথা রদের পরেও প্রায় একশো বছর লেগেছিল।

সামাজিক অধিকার আন্দোলনের সাফল্য সত্ত্বেও দেশে সামাজিক বৈষম্য দূর হয়নি। ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন, নারী আন্দোলনের সঙ্গে নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক অশান্তিও চলতে থাকে। ১৯৬৫ সালে দেশের বিভিন্ন শহরে দারিদ্র ও পুলিশি হয়রানির বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ যুবকদের বিক্ষোভের বিরুদ্ধে পুলিশ কড়া ব্যবস্থা নিলে অনেক শহরে দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। স্থানীয় পুলিশ শান্তি ফেরাতে ব্যর্থ হলে কিছু রাজ্য সরকার সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতে বাধ্য হয়।

একই সময়ে দেশে মাদক দ্রব্য ব্যবহার ও অন্যান্য অপরাধের হারও বাড়তে থাকে। জনগণের একটা বড় অংশ দেশের আইনকানুনের অবনতিতে চিন্তিত হয়ে পড়েন। ’৬৮-র নির্বাচনে রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি প্রার্থী রিচার্ড নিক্সন সুকৌশলে এর জন্যে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে দায়ী সাব্যস্ত করেন, নিজে কঠোর হাতে আইনকানুন বজায় রাখবেন বলে প্রচার চালান। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটিয়েছিলেন, কিন্তু নিক্সনের সময় থেকে রিপাবলিকান দল সংখ্যালঘুদের উন্নতির জন্য কোনও রকম সংস্কারের বিরোধী হয়ে ওঠে।

প্রেসিডে্ট নিক্সনের সময় থেকেই কঠোর আইন, দীর্ঘ কারাবাস এবং কড়া পুলিশি ব্যবস্থার শিকারে শহরের কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় বিশেষ ভাবে আক্রান্ত হন। খানিকটা সুপ্ত বর্ণবিদ্বেষের জন্য আর খানিকটা অরাজকতার ভয়ে অনেক নাগরিকই আইনি কঠোরতা সমর্থন করেন। পুলিশকর্মীরা ব্যক্তিগত ভাবে বর্ণবিদ্বেষী কি না বলা মুশকিল, এ যুগে বেশির ভাগ মানুষই বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগ অস্বীকার করবেন। সমাজতাত্ত্বিকেরা বলেন, পুলিশ প্রশিক্ষণ তথা অব্যক্ত কর্মনীতি অনুযায়ী সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষই সন্দেহভাজন। এই কারণেই পুলিশকর্মীরা কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের প্রতি প্ররোচনা ছাড়াই বলপ্রয়োগ ও বন্দুক ব্যবহারে প্রস্তুত থাকেন। শিক্ষা ও চাকরি জগতেও একই রকম অব্যক্ত বর্ণবিদ্বেষী কর্মনীতির জন্যই সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথ বহু প্রজন্ম ধরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগালের বাইরে থেকে গেছে।

সত্তরের দশক থেকে এখনও আমেরিকায় সেই একই রকম কঠোর পুলিশ ও আইন ব্যবস্থা চলছে। গত পঞ্চাশ বছরে লাখ লাখ নাগরিকের কারাবাস ও অন্যান্য শাস্তিভোগের ইতিহাস আছে— বেশির ভাগই সংখ্যালঘু। একই সময় শিক্ষা ও চাকরি বৈষম্য, দৈনন্দিন পুলিশি হামলা, অপরাধীদের উপদ্রব, দারিদ্র, সব মিলে মার্কিন শহরগুলির সংখ্যালঘু এলাকায় অতি সঙ্কটময় অবস্থা। ভোটে ফেডারাল, স্টেট, স্থানীয় সরকার বদলালেও পরিস্থিতি বদলায় না। এই মুহূর্তে মার্কিন শহরগুলির জনরোষ বা হিংসার পিছনে আছে কয়েকশো বছরের জমা দুঃখ ও ব্যর্থতার ইতিহাস।

ওবামা প্রশাসনের আমলে কিছু সংস্কারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় মার্কিন সংসদে রিপাবলিকান দলের বিরোধিতায়। ওবামার দেশপ্রেমকে তুচ্ছ করে যাঁর জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ, সেই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম থেকেই কঠোর পুলিশি ব্যবস্থা ও অন্যান্য অগণতান্ত্রিক নীতি সমর্থন করে এসেছেন। আজ তিনি যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদকে সেনাবাহিনী দিয়ে দমন করার হুমকি দেবেন তাতে আশ্চর্য কী। তাঁর হুমকি ও পুলিশের নিপীড়ন সত্ত্বেও জনগণের প্রতিবাদ অব্যাহত। ষাটের দশকের পরে সম্ভবত আমেরিকায় এই প্রথম একটি আন্দোলন হল যেখানে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষ দিনের পর দিন প্রতিবাদে শামিল। এমনকি কিছু পুলিশকর্মীও এই আন্দোলন সমর্থন করেছেন। আমেরিকা ও ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাস দেখায়, রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী শক্তির মোকাবিলা করতে পারে একমাত্র সাধারণ মানুষের প্রতিবাদী শক্তিই। তার ওপরেই নির্ভর করে গণতন্ত্রের জীবন ও মৃত্যু।

সমাজতত্ত্ব বিভাগ, কিন স্টেট কলেজ, নিউ হ্যাম্পশায়ার

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement