ফরাসি নিষেধ

কিছু দেশে কিছু স্কুলে মোবাইল ব্যবহারের সময় বাঁধিয়া দেওয়া অাছে, কিন্তু সম্পূর্ণ নিষেধ নাই। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাকরঁ-র অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল এই নিষিদ্ধকরণ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৮ ০১:৪৩
Share:

প্রতীকী ছবি।

ফ্রান্সে প্রাথমিক ও তাহার পরের কয়েকটি শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের মধ্যে মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করিবার আইন আসন্ন। কেবল শ্রেণিকক্ষে নহে, ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে বা অন্য কোনও স্থানেই মোবাইল ব্যবহার করিতে পারিবে না, টিফিনের সময়েও নহে। কিছু দেশে কিছু স্কুলে মোবাইল ব্যবহারের সময় বাঁধিয়া দেওয়া অাছে, কিন্তু সম্পূর্ণ নিষেধ নাই। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাকরঁ-র অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল এই নিষিদ্ধকরণ। কী কারণে এই কড়া ব্যবস্থা, তাহা ইদানীং অনেকেই হাড়ে হাড়ে বুঝিতেছেন। প্রায় প্রতিটি দেশে বহু পরিবারে এমন শিশু রহিয়াছে, যে সমগ্র দিন কেবল মোবাইলে মগ্ন হইয়া থাকে। কেহ বলিতেছে ইহাতে শিশুর চক্ষু খারাপ হইতেছে, কেহ বলিতেছে এই শুইয়া-বসিয়া থাকিবার অভ্যাস তাহাকে করিয়া তুলিতেছে অসুস্থ অলস অক্ষম, কেহ বলিতেছে সে হইয়া উঠিতেছে সামাজিক প্রতিবন্ধী, কাহারও সহিত মিশিতে শিখিতেছে না। মুশকিল হইল, শিশুর অভিভাবকরাও সমগ্র দিন মোবাইলেই বাঁধা রহিয়াছেন। রামকৃষ্ণদেবের কাহিনিতে, এক কবিরাজ এক শিশুকে গুড়ের নাগরির নেশা ছাড়াইবার জন্য প্রথমে নিজে সেই নেশা ছাড়িয়াছিলেন। কারণ, তিনি নিজে যে সংযম অভ্যাস করিতে পারেন না, তাহা অভ্যাস করিবার উপদেশ দানের যোগ্যতা তাঁহার নাই। সেই চরিত্রের বা নীতির জোর অধুনা বিরল। তাই নিজে মোবাইল দেখিতে দেখিতে, মুখ না তুলিয়াই, আধুনিক মাতাপিতা সন্তানকে বকিতেছেন, ‘‘আর ফোন দেখিলে কিন্তু তোমার চশমা হইবে!’’ শিশু মুচকি হাসিয়া ভাবিতেছে, তোমায় তো চশমা পরিয়া মন্দ দেখাইতেছে না!

Advertisement

বিদ্যালয়ে মোবাইল নিষিদ্ধ করিবার একটি কারণ অবশ্যই শিক্ষকের কথার পরিবর্তে ছাত্রছাত্রীর মনোযোগ মোবাইলে নিবদ্ধ হওয়া, আর একটি হইল: ‘সাইবার বুলিয়িং’। অর্থাৎ, আন্তর্জালের মাধ্যমে নিগ্রহ। বহু ছাত্র বা ছাত্রী এখন এই নূতন প্রকার ‘র‌্যাগিং‌’-এর শিকার। মেসেজ বা অন্য কিছুর মাধ্যমে হয়তো তাহার সম্পর্কে খারাপ কথা বলা হইতেছে, বা মিথ্যা রটনা করা হইতেছে, বা ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করিয়া দেওয়া হইতেছে, বা তাহার শরীর লইয়া ব্যঙ্গ করা হইতেছে। এই সকল কাণ্ড হয়তো বিদ্যালয়ে অনেককেই সহিতে হইয়াছে, মোটা ছাত্রকে শরীর লইয়া টিটকারি শুনিতে হইয়াছে, কাহাকেও মুদ্রাদোষের ফলে অপমানজনক ডাকনাম সহ্য করিতে হইয়াছে, কেহ পেনসিল চুরি না করিয়াও চোর বদনাম পাইয়া কাঁদিয়াছে, কাহাকে ক্রমাগত খেলা হইতে বাদ দেওয়া হইয়াছে। তবু বিদ্যালয় হইতে বাড়ি ফিরিয়া অন্তত কিছু ক্ষণের জন্য সেই শিশু বা কিশোরটির শান্তি মিলিয়াছে। কিন্তু ইদানীং ক্লাসের সকলেরই, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বা মেসেজের মাধ্যমে দিনের প্রতিটি মুহূর্ত যোগাযোগ থাকে। ফলে নিগৃহীতের একটি ক্ষণও নিস্তার নাই। অনেকে অবশ্য বলিতেছেন, বিদ্যালয়ের সময়টুকু মোবাইল কাড়িলে মোটেই এই বিশ্রী নিষ্ঠুর ব্যবহার কমিবে না। তদুপরি, ব্যাগের মধ্যে ছাত্রছাত্রীরা ঠিকই মোবাইল লুকাইয়া লইয়া যাইবে এবং বইপত্র ঘাঁটিবার ছলে স্ন্যাপচ্যাট করিবে। কিন্তু আশা করা চলে, কয়েক ঘণ্টার বাধ্যতামূলক নিবৃত্তি হয়তো এই সকল কার্য হইতে দূরে থাকিবার একটি অভ্যাস সূচিত করিবে।

মাকরঁ-র সমর্থকরা পার্লামেন্টে বিতর্কে বলিয়াছেন, এই নিষেধ কোনও ছাত্র বা ছাত্রীকে অাইনি অধিকার দিবে, মোবাইল-জালে সংযুক্ত না থাকিবার। ইহা গুরুত্বপূর্ণ কথা। কেহ হয়তো মোবাইল দেখিতে চাহিতেছে না, চুপ করিয়া বসিয়া বৃক্ষ অবলোকন করিতে করিতে টিফিন খাইতে চাহিতেছে, কিন্তু ‘অন্য রকম’ বা ‘অপ্রতিভ’ চিহ্নিত হইয়া যাইবার ভয়ে তাহাকে মোবাইলে মগ্ন থাকিবার ভান করিতে হইতেছে, বা সাম্প্রতিক ভিডিয়ো ক্রীড়ায় নিজ পয়েন্ট প্রদর্শন করিতে হইতেছে। বিদ্যালয়ে ‘বেমানান’কে ঠুকরাইয়া অতিষ্ঠ করিয়া দিবার ঘটনা অতি প্রচলিত, এবং ওই বয়সের ছাত্রছাত্রীর নিকট গ্রহণযোগ্য হইয়া উঠিবার তাড়নাও প্রবল। তাই মোবাইল হইল ‘আমি তোমাদেরই দলে’ ফুকারি উঠিবার অমোঘ যন্ত্র। সেইটি রাষ্ট্র যদি হাত হইতে কাড়িয়া লয়, হয়তো অনেকে বাহ্যিক অস্বস্তি দেখাইলেও, প্রকৃতপক্ষে হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিবে। এই নিষেধ ঠিক না ভুল, মোবাইল ছাড়িয়া বহু ছাত্রছাত্রী অসুস্থ হইয়া পড়িবে কি না, সময়ে বুঝা যাইবে। কিন্তু পরিবর্তিত সময় অনুযায়ী চিন্তা ও সক্রিয় পদক্ষেপের কৃতিত্বটি অন্তত ফ্রান্সকে দিতে হইবে।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

আইপিএল গেল। তার পর বিরাট বিরাট পরীক্ষার ফল বেরিয়ে ‘কলকাতা বনাম জেলা’, ‘অমুক বোর্ড বনাম তমুক বোর্ড’, ‘মেয়েদের মধ্যে প্রথম বনাম ছেলেদের মধ্যে প্রথম’ ম্যাচ শেষ হল। এ বার আসছে ফুটবল বিশ্বকাপ। পাড়ায় ব্রাজ়িলের পতাকা, মাঠে স্ক্রিন, দেওয়ালে মেসি। প্রিয় দল জিতলেই মাংস। ভাগাড়ের ব্যাপারটা ভুলে যাওয়াই ভাল, কারণ খেলাটায় কে বনাম কে, তা আবছা হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, তা ছাড়া একঘেয়েও লাগছে অ্যাদ্দিন নিরামিষ খেয়ে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement