প্রত্যুষে মোরগের ডাক উৎপাত না কি ঐতিহ্য? এই প্রশ্নে উদ্বেল ফ্রান্স। যাহার ডাক এমন সাড়া ফেলিয়াছে, তাহার নাম মরিস। নিবাস ফ্রান্সের ক্ষুদ্র এক দ্বীপে। এক প্রভাতে সূর্যকে সরবে অভ্যর্থনা করিয়া মরিস ওই গ্রামে অবকাশযাপনরত এক দম্পতির অকালে নিদ্রাভঙ্গ করিয়াছিল। দম্পতি আদালতে আবেদন করিয়াছেন, শান্তিভঙ্গের জন্য সরিয়া যাইতে হইবে মরিসকে। মরিসের মালকিনের দাবি, নিজের মনোভাব প্রকাশের অধিকার মোরগদের রহিয়াছে। তাঁহার সমর্থনে কয়েক সহস্র ফরাসি স্বাক্ষর করিয়াছেন। তাঁহাদের বক্তব্য, গ্রামজীবনের স্বাভাবিক শব্দ-গন্ধ দেশের ঐতিহ্য। সেইগুলিকে ঐতিহ্যের মর্যাদা দিয়া সুরক্ষিত রাখিতে হইবে। শহর হইতে আগত পর্যটকদের সুবিধার জন্য তাহাদের বাতিল করা যাইবে না। এই দাবি নিতান্ত অমূলক নহে। বিত্তবান পর্যটকদের দাবি মানিয়া ইতিপূর্বে ফ্রান্সের অপর একটি গ্রামে এক দম্পতিকে তাঁহাদের পুকুর বুজাইতে হইয়াছে। কারণ পুকুরের ব্যাঙগুলির শোরগোল পর্যটকদের বিরক্তি জাগাইয়াছিল। আর একটি গ্রামে শহরবাসী নালিশ করিয়াছিল, গির্জার ঘণ্টা ভোর সাতটায় বাজিয়া ওঠা বাড়াবাড়ি। এত তাড়াতাড়ি উঠিবার প্রয়োজন কী? রুষ্ট হইয়া এক ছোট শহরের মেয়র প্রশ্ন করিয়াছেন, ইহার পরে কি সমুদ্রপক্ষীর রব আপত্তিকর মনে হইবে? কিংবা বাতাস বহিবার শব্দ? শহরবাসীর সুবিধার জন্য গ্রামের মানুষ ও প্রাণীদের অভ্যস্ত জীবনযাত্রা বদলাইতে হইবে, এই প্রত্যাশা অন্যায়।
ফ্রান্সে এই বিতর্কটি নগরবাসী পর্যটকের স্বাচ্ছন্দ্যের দাবি বনাম গ্রামবাসীর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখিবার দাবি, এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু বিশ্ববাসীর মনোযোগ টানিয়াছে যে বিষয়টি তাহা হইল, ঐতিহ্যের অঙ্গরূপে শব্দের বিবেচনা। শহর বা গ্রামে ভগ্নপ্রায় প্রাসাদকে রক্ষা করিতে সকলে ব্যস্ত হইয়া ওঠে। কারণ সেগুলি নিশ্চিহ্ন হইলে ‘ঐতিহ্য’ হারাইয়া যাইবে, ইহাতে কাহারও সন্দেহ নাই। কিন্তু শহরের রাস্তায় হাঁকিয়া-যাওয়া ফেরিওয়ালার ডাক, গ্রামে বৃষ্টিপাতের পরে ব্যাঙের কলরব হারাইয়া গেলেও যে অপূরণীয় ক্ষতি, সে বোধ সহসা জন্মায় না। শরতের শহর যদি ছাতিম ফুলের সুবাসে আমোদিত না হইল, যদি গ্রামের নয়ানজুলি হইতে জলমগ্ন পাটের গন্ধ না উঠিয়া আসিল, তবে উৎসবের আড়ম্বর বাড়াইয়াও বাঙালি নিজ ঐতিহ্য হারাইবে।
পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়া পারিপার্শ্বিকের যত রূপ-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শ অনুভূত হয় তাহার সকলই ‘ঐতিহ্য’, এমন নহে। কিন্তু যে অনুভূতিগুলি একটি জাতির সম্মিলিত বোধের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে, আত্মপরিচিতির অংশ হইয়া উঠিয়াছে, সেগুলি সংরক্ষণের যোগ্য। ঐতিহ্যের তালিকা লইয়া অতএব চিন্তা প্রয়োজন। মোরগের ডাক আরও একটি প্রসঙ্গ উঠাইয়াছে, তাহা প্রকৃতির সহিত মানুষের সম্পর্কের। মানুষের মতে সে সম্পর্কটি পুরাতন ভৃত্যের সহিত মনিবের। যথেচ্ছ দুর্ব্যবহার করিলেও প্রকৃতি মানুষকে তাহার প্রয়োজনের বস্তুটি নীরবে বাড়াইয়া দিবে, এমনই প্রত্যাশা। আরামপ্রিয় পর্যটকের ন্যায় সমগ্র মনুষ্যজাতিই নিরন্তর নালিশ করিতেছে, প্রকৃতি ইচ্ছামতো চলিয়া তাহার বড়ই অসুবিধা করিতেছে। অগত্যা গাছ কাটিয়া, জলাশয় বুজাইয়া, পাহাড় ফাটাইয়া সুবিধা করিতে হইয়াছে মানুষকে। আজ একটি মোরগকে সরাইতে এত আপত্তি কেন, তাহাই আশ্চর্য ঠেকে।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।