অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
উৎসবের দিনে নানা জমকালো শোভাযাত্রা দেখতে গিয়েছেন এক প্রৌঢ় আর তাঁর সঙ্গী। ফেরার পথে পথ আটকালেন সাঙ্গোপাঙ্গ-সহ এক যুবক। বললেন, ‘সংখ্যায় কে বেশি দেখছ তো? গায়ের জোরে পারবে? না পারলে থেকে যেতে হবে আমাদের বাড়ি।’
প্রৌঢ় বললেন, ‘আর একটা অন্য বিকল্প আছে। আমি তোমাকে বুঝিয়ে তোমার মত পরিবর্তন করতে পারি।’
প্রাচীন গ্রিসে সক্রেটিস যে বিকল্পের কথা বলেছেন, সেই ‘বুঝিয়ে বদল আনা’-র পথে হেঁটে মিলেছিল গণতন্ত্র। মানব সভ্যতা সর্বদা সে পথে হাঁটেনি। এমনকি এই একবিংশ শতকে, যখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশ গণতান্ত্রিক, তখনও মতের বিরোধ হলে শোনা যাচ্ছে সেই প্রশ্ন, ‘গায়ের জোরে পারবে?’ যদি বা হিংসা অবধি না গড়ায়, তবু অন্যের জায়গাটি থেকে কথা শুরু করে ক্রমে টেনে আনা নিজের দিকে, সে আর হচ্ছে কই? নস্যাৎ করাই দস্তুর। এক-এক জন নেতা আর তাঁর অনুগামীরা যেন এক একটা দ্বীপ। এর সঙ্গে ওর কথা নেই। পলিমার্কাস যেমন সক্রেটিসকে বলেছিল, ‘আমি যদি না শুনি, তুমি কী করে বোঝাবে?’ এখন মার্কিন মুলুকে তিন জন যুবকের মাত্র এক জন মনে করে, গণতন্ত্র জরুরি। সামরিক শাসনে আপত্তি নেই আঠারো শতাংশের।
আজ নোবেল পাচ্ছেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি অর্থনীতির চর্চায় তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চাইতেও গুরুত্ব দিয়েছেন সংলাপে নিরত হওয়া কাজটিকে, যা গণতন্ত্রের ধর্ম। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ প্রধানত সেই মানুষদের নিয়ে, গণতন্ত্র যাঁদের ভোট নেয়, কিন্তু বিনিময়ে দেয় সামান্যই। দারিদ্র দূর করার যে পদ্ধতি (র্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোল্ড ট্রায়াল) প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা, নোবেল তাকে স্বীকৃতি দিল। অমনি ঝড় উঠল, ‘আরসিটি’ কি আদৌ ভাল জিনিস? দু’পক্ষেই বাঘা বাঘা অর্থশাস্ত্রী, বিতর্কের সুনামিতে পাবলিকের হাবুডুবু দশা।
সেই দুর্যোগে বাতিস্তম্ভের মতো মাথা তুলে দাঁড়াল অভিজিতেরই (সহ-লেখক এস্থার দুফলোর) নতুন বই, ‘গুড ইকনমিক্স ফর হার্ড টাইমস।’ এই সময়, এই সঙ্কট নিয়ে অভিজিৎ কী ভাবছেন, তা স্পষ্ট হল। আমাদের এক একটা দৃঢ় অভিমতের মধ্যিখানে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে যে সব ‘ধরে-নেওয়া’ ধারণা, সেগুলো কি ওজনদার ভিত্তি-প্রস্তর? না কি খাটের তলার ঝুল? তা যাচাই করতে একে একে ধারণা টেনে বার করে, গ্রহণ বা বর্জন করতে করতে এগিয়েছে বই। তবে কিনা, ‘রিপাবলিক’-এ খোঁজা হয়েছে যুক্তিতে স্ব-বিরোধ, আর অভিজিৎ কষ্টিপাথর করেছেন সমীক্ষা-প্রাপ্ত তথ্যকে। উদ্বাস্তু এলে সত্যিই কি কমে যায় দিশি শ্রমিকদের মাইনে? কর বাড়লে কি কমে যায় কাজের আগ্রহ? উষ্ণায়ন, শরণার্থী, বেকারত্ব, আর্থিক অসাম্য— অতিকায় সঙ্কটের কারণ আর সমাধান নিয়ে প্রচলিত ধারণা বিচার করা চাই তথ্যের সাক্ষ্য দিয়ে। ভ্রান্ত ধারণাই যে মানুষে-মানুষে বিদ্বেষের উৎস।
যেমন মার্কিনরা মনে করেন (আমরাও অনেকে করি), যার যেমন ক্ষমতা সে তেমনই কাজ পাবে। বেকার হয়ে আছো, কিংবা সামান্য মাইনে পাচ্ছ, সে বাপু তোমারই দোষ। ‘সিস্টেম’ কী করবে? মার্কিন দেশে স্বল্পশিক্ষিত সাদা পুরুষেরা বেকারত্ব আর অল্প আয়ের জন্য তীব্র আত্মগ্লানিতে ভোগেন। ড্রাগ ব্যবহার আর আত্মহত্যার জেরে তাঁদের আয়ু কমছে।। কিন্তু যে কাজ, যে টাকা তাঁদের পাওয়ার কথা ছিল, সেগুলো যাচ্ছে কোথায়? সহজেই বিশ্বাস হয়, বর্ডার পেরিয়ে আসা লোকেরাই সেগুলো দখল করছে। এই ধারণার উপর দাঁড়িয়ে নির্বাচনও হয়ে গেল (ট্রাম্পের দেওয়াল তোলার অঙ্গীকার মনে করুন) অথচ তার সত্যতার প্রমাণ মিলল না। তথ্য বরং সাক্ষ্য দিচ্ছে যে রেগন-থ্যাচারের অনুসরণে রাষ্ট্রের ব্যয়সঙ্কোচ নীতি বেকারত্বের চাপ বাড়াচ্ছে। ভ্যাকিউম ক্লিনারে ধুলো টানার মতো, কর্পোরেট শীর্ষকর্তারা টাকা টানছে নিজেদের ট্যাঁকে। এমন গোড়ার গলদ থাকছে আড়ালে। আর শরণার্থীর প্রতি আক্রোশ সর্বত্র ক্ষমতায় আনছে চরমপন্থী নেতাদের। পিছু হটছে নাগরিক অধিকার, সংবাদের স্বাধীনতা। বিপন্ন হচ্ছে গণতন্ত্র।
তা হলে কর্তব্য কী?
‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবিটা যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁদের মনে থাকবে একটি দৃশ্যে র্যাঞ্চোর প্রশ্নে বিরক্ত শিক্ষক তাকেই ক্লাস নিতে ডাকলেন। র্যাঞ্চো (আমির খান) উদ্ভট, অর্থহীন প্রশ্ন দিল, ক্লাসের সকলে গলদঘর্ম। শেষে উত্তর লিখে র্যাঞ্চো বলল, ‘কেমন করে শেখাতে হয়, সেটাই শেখাচ্ছিলাম।’ অভিজিৎ-ও ক্লাসে ছাত্রদের, বৈঠকে মন্ত্রী-আমলাদের, এবং বইয়ে পাঠকদের বুঝিয়ে চলেছেন, কী করে কর্তব্য সম্পর্কে চিন্তা করতে হয়। দশ বছরের ব্যবধানে অভিজিৎ এবং এস্থারের দু’টি বই এত জনপ্রিয় হয়েছে, তা আশ্বস্ত করে। ‘কী করতে হবে জেনে নাও আর ঝটপট করে ফেলো’ ব্রিগেডের বাইরে এখনও কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা সমবেত চিন্তা থেকে কাজের সূত্র বার করতে ইচ্ছুক। ভুল হতে পারে, মেনে নিয়ে যাঁরা এগিয়ে যান। এমনকি ভ্রান্ত প্রমাণিত হওয়ার কামনা করেন। অভিজিৎ বলেন, ‘আমি চাই আমার সমীক্ষার ফল আমাকে হতবাক করুক।’ বার বার দেখিয়েছেন, নিজেকে অভ্রান্ত, অবিকল্প যে ভাবে, সে সুযোগ আর টাকা নষ্ট করে। সংলাপেই লাভ।
এই সংলাপের অংশীদার দরিদ্র মানুষও। ‘পুয়োর ইকনমিক্স’ পড়ে অনেকের একটা নৈতিক অস্বস্তি হয়েছিল। ‘আরসিটি’ গরিবের আচরণ থেকে তথ্য-পরিসংখ্যান নিষ্কাশন করে নীতি তৈরির জন্য সওয়াল করে। তা হলে গরিব কি কেবল তথ্যের উৎস? অবশ্যই না। দরিদ্রকে সসম্মানে সংলাপে সংযুক্ত করা কত প্রয়োজন, কত ফলপ্রসূ, ফ্রান্সের একটি উদ্যোগের দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখিয়েছে ‘গুড ইকনমিক্স...।’ দরিদ্রের মর্যাদাকে সুরক্ষিত না করতে পারায় কত প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে, তা-ও বলছেন। তবে ‘আরসিটি’-র একটা অন্তর্নিহিত নৈতিকতা কি নেই? ভারত-সহ সব দেশে প্রশাসক নিজেকে ভাবেন সর্বজ্ঞানী জ্যেঠামশাই, নাগরিককে ‘সচেতন করা’ তাঁর কাজ। ‘আরসিটি’ ছকটা পুরো উল্টে দেয়। সেখানে নীতি তৈরির সূত্র খুঁজতে প্রশাসককে যেতে হয় গরিবের কুটিরে। ছাত্রের মতো, প্রার্থীর মতো। নৈতিক নয়?
ছক ভাঙে অন্য ভাবেও। অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রনীতি, সমাজতত্ত্বে দরিদ্রের নানা ছাঁচ। হয় সে অলস, ধড়িবাজ, নয় ষড়যন্ত্রের অসহায় শিকার। হয় ‘অঁত্রেপ্রেনিয়র’ নয় ‘বেনিফিশিয়ারি।’ অভিজিৎ গরিবকে এমন কোনও ছাঁচে ফেলতে রাজি নন। যে লোকটা সন্তানের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন, সে-ই সন্তানকে টিকার শিবিরে নিয়ে যেতে ভুলে যান। অতি-দরিদ্রও বাড়তি পয়সা খরচ করেন বিনোদনে। বেকার ছেলেদের ক্লাব হালকা তোলাবাজি করে, কিন্তু বড় অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করে। এই তীক্ষ্ণ, নির্মোহ দৃষ্টি, যা মানুষের বহুমাত্রিকতাকে সম্মান করে গ্রহণ করে, তা থেকে সঞ্জাত হয় সহমর্মিতা, সম-মর্যাদার বোধ, সাধারণত যা নিয়ে আসে সাহিত্য। অভিজিৎকে পড়তে পড়তে পাতায় ভেসে আসেন জে এম কোয়েৎজ়ি, সতীনাথ ভাদুড়ি।
‘সিস্টেম’ যে ভাবে ছকে ফেলে মানুষকে, তা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়। অভিজিৎ বলছেন, তা বিপজ্জনক। ভারতের খরাগ্রস্ত অঞ্চলের চাষি, শিকাগোর গরিব অঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ যুবক আর মধ্যপঞ্চাশের সদ্য-ছাঁটাই হওয়া শ্বেতাঙ্গের মধ্যে মিল কোথায়? প্রত্যেকেরই সমস্যা আছে, কিন্তু তাঁরা কেউই আসলে ‘সমস্যা’ নয়। তাঁরা যেমন, তেমন করেই তাঁদের দেখতে হবে— তাঁদের দুর্দশাকে তাঁদের পরিচয় ভাবলে চলবে না। এটা বার বার দেখা গিয়েছে যে, আশাই সেই জ্বালানি, সেই শক্তি, যার জোরে মানুষ এগিয়ে চলে। সমস্যা দিয়ে মানুষকে বুঝলে তাঁর ‘পরিস্থিতি’কেই ‘পরিচিতি’ করে তোলা হয়। তখন আর কোনও আশা অবশিষ্ট থাকে না। সেই চরম হতাশার সামনে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল ‘কৃষ্ণাঙ্গ,’ ‘হিন্দিভাষী,’ ‘মুসলিম’ এমন কোনও পরিচয়ের চাদরে নিজেকে সম্পূর্ণ মুড়ে ফেলা। বৃহত্তর সমাজের কাছে এর পরিণাম হয় মর্মান্তিক, কারণ এই হল সংলাপহীন হিংসা-বিদ্বেষের উৎস। এই চরম উৎকণ্ঠার সময়ে চাই এমন নীতি, যা কাজ হারানোর মতো ‘শক’ সইতে সাহায্য করবে, কিন্তু আত্মপরিচিতির বোধে আঘাত করবে না।
এমন কথার জন্যই তো এই দুঃসময়ে কান পেতে আছেন অগণিত বিপন্ন মানুষ। ‘ভাল অর্থনীতি এত জরুরি, যে তা কেবল অর্থনীতির লোকেদের হাতে ছাড়া যায় না’, লিখেছেন অভিজিৎ-এস্থার। উত্তম অর্থনীতিবিদকেও কি কেবল অর্থনীতির জন্য তুলে রাখা চলে? তাঁর সঙ্গে সবার, সতত সংলাপ। এই তার শুরু।