Festival

অমূল্য

আজ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি তাহার সঙ্কীর্ণ রাজনীতির ধারণা লইয়া দেশবাসীকে পীড়ন করিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০০
Share:

—ফাইল চিত্র।

মালদহের হবিবপুরের একটি বিদ্যালয়ে এ বৎসর সরস্বতী পূজা করিয়াছেন ছাত্রী রোহিলা হেমব্রম। পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে পুরোহিত ছিলেন ছাত্রী শ্রেয়া দাস, পুরুলিয়ার নিতুড়িয়ায় পঞ্চম শ্রেণির ঝিলিক। রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে পূজা করিয়াছেন ভগবত মুর্মু। কলিকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটের ছাত্রাবাসে পুরোহিতের দায়িত্ব ভাগ করিয়া লইয়াছেন এক মুসলিম ছাত্র, এক অব্রাহ্মণ ছাত্র এবং এক ছাত্রী। হিন্দু ধর্মকে মনুবাদ হইতে মুক্তি দিবার যে তাগিদ অনুভূত হইতেছে, ইহা তাহার ইঙ্গিত। সরস্বতী পূজার সহিত বিদ্যালয়ের, এবং বিদ্যালয়ের সহিত সমাজের একটি সহজ সংযোগ রহিয়াছে, তাই তাহার আয়োজনে সকল সম্প্রদায়ের ছাত্র-অভিভাবকের অংশগ্রহণ ব্যতিক্রম নহে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় হইতে কলিকাতার উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে পুরোহিতের আসনে অব্রাহ্মণ, অহিন্দু এবং নারীদের বসাইবার আগ্রহটি বলিয়া দেয়, বাহির হইতে আঘাত আসিলে অন্তরে মানুষ শক্তির উৎস অনুসন্ধান করে। আজ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি তাহার সঙ্কীর্ণ রাজনীতির ধারণা লইয়া দেশবাসীকে পীড়ন করিতেছে। বৈষম্য ও বিভেদ সৃষ্টি করিয়া সমাজকে ক্ষুব্ধ ও বিচলিত করিতেছে। দেশবাসী ইহার প্রতিকার খুঁজিতেছেন। প্রতিবাদী জন-আন্দোলন তাহার একটি রূপ। অপর একটি রূপ সমাজ-সংস্কার। ঊনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণে যাহা হইয়াছিল। ধর্মের সঙ্কীর্ণ বিধিনিয়ম ভাঙিয়া, আত্মশক্তিতে উজ্জীবিত মানুষের মিলনভূমি গড়িবার চেষ্টা করিয়াছিলেন সে যুগের চিন্তানায়কেরা। আজ পরিচয়-ভিত্তিক বৈষম্যের ধারণাকে প্রতিহত করিতে ফের উদার ধর্মভাবনায় ফিরিতেছে সমাজ।

Advertisement

প্রশ্ন তবু উঠিবে। আদিবাসী কিশোরী বা মুসলিম তরুণ পূজায় বসিলে তাহা কি উদারতার নিদর্শন, না কি আধিপত্যের ইচ্ছার প্রকাশ? ব্রাহ্মণ না হয় সরিল, কিন্তু তাহার আসনটি তো পাতা রহিল। সকল ধর্মাবলম্বীকে সেই মূর্তির সম্মুখে টানিয়া আনাই কি হিন্দুত্ববাদের দীর্ঘ দিনের লক্ষ্য নহে? কথাটি বিবেচনাযোগ্য। আদিবাসী বালিকা যদি স্কুলের সরস্বতী পূজায় আগ্রহী না হয়, সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রী যদি সেই দিন আসিতে না চায়, তাহাদের কি ‘সঙ্কীর্ণ’ বলা হইবে? ‘সাম্প্রদায়িক’ তকমার ভয়ে কেহ অঞ্জলির লাইনে দাঁড়াইলে তাহা অন্যায়। দেশদ্রোহী তকমার ভয়ে জাতীয় সঙ্গীত বাজিলে খাড়া থাকিবার মতোই বিরক্তিকর। অনেকে তাই শিক্ষা বা কর্ম প্রতিষ্ঠান হইতে ধর্মকে দূরে রাখিতে চান।

কিন্তু তাহাতে উৎসবে ভাটা পড়িয়া যায়। ‘উৎসব’ শীর্ষক রচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন, ‘যাঁহার সম্মুখে, যাঁহার দক্ষিণকরতলচ্ছায়ায় আমরা সকলে মুখোমুখি করিয়া বসিয়া আছি, তিনি নীরস সত্য নহেন, তিনি প্রেম। এই প্রেমই উৎসবের দেবতা, মিলনই তাঁহার সজীব, সচেতন মন্দির।’ প্রথাগত ধর্মাচরণে এই উৎসব-দেবতা অবশ্যই আবদ্ধ নহেন। কিন্তু আজও এ দেশে পূজা, ইদ, খ্রিস্ট-আরাধনার মতো ধর্মীয় উৎসবগুলি মানুষে-মানুষে মিলনের দিন। অতএব তাহাতে সকল মানুষকে সমান স্থান দিতে হইবে বইকি। বিদ্যালয়গুলি যদি সত্যই ধর্মীয় উৎসবে সকলকে সম-মর্যাদার স্থান দিয়া তাহাকে সর্বধর্মের মিলনোৎসব করিতে পারে, তাহা একটি মূল্যবান শিক্ষা হইবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement