ধর্ষণ এবং তার নিদারুণ পরিণতি দেশের এক বৃহৎ অংশের মানুষকে অনেক দিন ধরেই এক সুতীব্র যন্ত্রণায় দগ্ধ করে চলেছে। এক একটা ধর্ষণের ঘটনা সংবাদের শিরোনামে আসে, আর তার প্রতিকারে কঠোর সিদ্ধান্ত, দ্রুত শাস্তি এবং চরম শাস্তির দাবি ওঠে চারিদিকে। বিপক্ষে যুক্তিবাদী, মানবাধিকার-সচেতন মানুষ এমন চটজলদি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সওয়াল করেন, বিচারব্যবস্থার মৌলিক উদ্দেশ্য কী, কেন সেই উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকা আবশ্যক, সে বিষয়ে বক্তব্য পেশ করেন। তার জবাবে আবার প্রতিযুক্তি শোনা যায়: কতকগুলো তাত্ত্বিক যুক্তি নিয়ে অনর্থক তর্ক না করে বাস্তব পরিস্থিতিকে স্বীকার করা দরকার, বোঝা দরকার যে, চটপট কঠোরতম শাস্তির ভয় যদি না থাকে, তা হলে এই সব নৃশংস অপরাধ দমন করা অসম্ভব, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে।
সমস্যাটা জটিল, সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল, এই সমস্যা নিয়ে কত দূর চিন্তাভাবনা করছে আমাদের যুক্তিবাদী মন? ক’টা সরকার ছক-ভাঙা এবং কার্যকর পদক্ষেপ করেছে? একটা কথা পরিষ্কার করে বলা দরকার। ধর্ষণ-জর্জরিত পরিবার কিসের ভরসায় বিচারব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে থাকবেন— সে কথাটাও তো বুঝতে হবে। প্রশাসন এবং আইন-আদালতের গোটা কাঠামোটাতে ঠিক কোন ধরনের সংস্কারের ফলে তাঁদের বিশ্বাস ফিরবে সেটা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তাভাবনার সময় পাইনি আমরা। এখনও পাচ্ছি কি? ধর্ষণের মতো নৃশংস অপরাধে অভিযুক্ত লোক ধরা পড়লেই তাকে মেরে ফেলতে হবে— এমন একটা যুক্তিহীন বক্তব্যের পাশাপাশি আপাতযুক্তিতে ঠাসা অবাস্তব, ইতিহাসবিরোধী এবং সামাজিক পটভূমি সম্পর্কে খানিকটা অজ্ঞ সদিচ্ছাসর্বস্ব বক্তব্য— এই দুই বিপরীত মেরুর অবস্থান নিয়ে নির্মোহ আলোচনা প্রয়োজন।
ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাপুষ্ট সামাজিক বাতাবরণ, মানবাধিকার, সভ্য এবং অসভ্য সমাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সব মিলিয়ে আইনের উদ্দেশ্য আসলে কী? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়, কিন্তু শুধু মানবাধিকার বলবৎ করার দোহাই দিয়ে দিনের পর দিন বিচারপ্রার্থীদের করুণ দুরবস্থা, সময়ের অপচয়, অপরাধীদের ক্ষমতার অলিন্দে ক্রমবর্ধমান যোগাযোগ ও বিচারব্যবস্থার বাস্তব নিষ্ক্রিয়তাকেই কি উপেক্ষা করে চলছি না আমরা? বিচারব্যবস্থা এখনও আমাদের কাছে দুরাত্মার অন্যায়ের প্রতিকারের শেষ অস্ত্র, নির্দোষকে রক্ষা করার শেষ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি, লালফিতের ঘেরাটোপ, দুর্নীতি, সময়ের হিমালয়সদৃশ অপচয়— এই সব নিয়ে ভেবে দ্রুত সংশোধনের প্রয়োজন এখনই।
ধর্ষণ ও ধর্ষণের কারণে মৃত্যুর বিচার ও শাস্তির প্রসঙ্গেই সেই উদ্যোগের সূত্রপাত হতে পারে। ‘ধরে ফেললেই গুলি’র প্রশ্ন নয়, কিন্তু আইনের সংস্কার এবং তাকে বিদ্যুৎগতিতে কার্যকর করার জন্য সুব্যবস্থা— দুটোই ভীষণ প্রয়োজন। ধরা পড়লে এক মাসের মধ্যে বিচারের প্রক্রিয়া শেষ করে নিরপরাধদের ছেড়ে দেওয়া এবং অপরাধীকে সঙ্গে সঙ্গে চরম শাস্তি দেওয়া— সবেরই ব্যবস্থা করতে হবে। এটা করা গেলে এ ধরনের অপরাধ দ্রুত কমে যাওয়ার সম্ভাবনাও খুবই বেশি।
পাশাপাশি, অশিক্ষিত, অসুস্থ, অপরাধপ্রবণ মানুষদের চিহ্নিত করে অপকর্ম করা থেকে নিবৃত্ত করতে হবে। সমাজে এদের সংখ্যা কমানোর নিশ্চয়ই অনেক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন— বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন শিক্ষা ও মানসিক রোগব্যাধি নির্মূল করার ব্যাপারে। কিন্তু এ কথা সর্বৈব সত্য যে, মানুষ যথেষ্ট ভয় পেলে অপরাধ করে না, বিচার ও শাসন প্রক্রিয়াপ্রসূত ভয় তাকে অপকর্ম থেকে বিরত করে। কোন আইনানুগ সুচিন্তাপ্রসূত প্রক্রিয়া সেই কার্যকর ভয়ের সঞ্চার করতে পারে, সেটা দেখা দরকার। যদি অর্থনীতির শিক্ষাপ্রসূত তাত্ত্বিক অনুশাসনের কথা মন দিয়ে বিবেচনা করা হয় তা হলে বলতেই হবে যে, এখানে একটা কস্ট-বেনিফিট বা লাভ-লোকসানের খতিয়ানের ব্যাপার আছে। সহজ করে বললে ব্যাপারটা হল— ধর্ষণ ও নৃশংস অত্যাচার থেকে বিকৃত মন যে আনন্দ পায়, তার ঠিক পাশাপাশি অপরাধের নিশ্চিত হাড়হিম করা শাস্তির ভয় যদি ওই আনন্দের পরিমাণকে অনেকটা ছাপিয়ে যায়, তখনই আমরা সেই অপরাধ থেকে নিবৃত্ত হব। মানুষের আচরণে সচরাচর এমনটাই প্রত্যাশিত। এই আচরণ শতকরা একশো জন মানুষের ক্ষেত্রে সত্য হবে কি না, সেটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন নয়। অধিকাংশ, এমনকি অনেক মানুষের ক্ষেত্রে যদি এটা ঘটে, বাস্তবের পক্ষে সেটাই মূল্যবান।
এটা বোঝা কঠিন নয় যে— অপরাধীকে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলা, দ্রুত তার যথাযথ বিচার করা এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া— এই তিনটি সম্ভাবনা সম্মিলিত ভাবে সংস্কারের ফলাফল নির্ধারণ করবে। এক অর্থে, তিনটি সম্ভাবনার এক ধরনের গুণফলই গুরুত্বপূর্ণ, যোগফল নয়। অর্থাৎ যে কোনও একটির সম্ভাবনা জোরদার না হলে অন্য দু’টি খুব বেশি হলেও কাজের কাজ হবে না। যদি শতকরা একশো ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধী ধরা পড়ে এবং চরম শাস্তি পায়, কিন্তু মাত্র শতকরা পাঁচ ভাগ ক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি বিচার হয়, তা হলে লাভ হবে না।
ধর্ষণের অপরাধ ও সে বিষয়ে সমাজের সচেতনতা যে আকার ধারণ করছে, তাতে অপরাধ প্রমাণের চেয়ে যেন তেন প্রকারেণ চরম শাস্তি দেওয়াই সমাজের এক বড় অংশের দাবি। কিন্তু বিচার ও শাসনের প্রক্রিয়ায় সংস্কার সাধন করে বাস্তবকে সামনে রেখে তাত্ত্বিক ভালমন্দের বাইরে বেরিয়ে যদি নিজেদের মনেই ‘কার্যকর ভয়’-এর সঞ্চার না ঘটাতে পারি, তা হলে এক ধরনের নৈরাজ্যই আমাদের চিন্তাভাবনাকে গ্রাস করবে। তার পরিণামে ভোটতন্ত্র প্রশ্রয় দেবে ওই নৈরাজ্যকেই।