প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়ন: এই ধারণাই বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি। অভিযোগ, পিএম কিসান নিধি হইতে বাংলার কৃষকদের বঞ্চিত করিয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ভিত্তিতে আঘাত করিয়াছেন। অভিযোগ, প্রতিযোগীকে মাঠেই নামিতে দিবেন না, ইহাই তাঁহার অভিপ্রায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এই সকল অভিযোগ অসার নহে। রাজ্যের সত্তর লক্ষাধিক চাষির নিকট কেন্দ্রের অনুদান পৌঁছাইতে দেয় নাই রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তর: রাজ্য ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্প চালু করিয়াছে, অতএব পিএম কিসান নিধি-র প্রয়োজন নাই। বিচিত্র যুক্তি। প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গে, ঐতিহাসিক কারণেই, বহু কৃষকের জমি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নথিপত্র নাই, ফলে সরকারি প্রকল্পে তাঁহাদের প্রাপ্তি অনিশ্চিত। মুখ্যমন্ত্রী সমস্যার সমাধানে এক ধরনের ‘চাহিলেই পাইবেন’ নীতির কথা বলিয়াছেন, কিন্তু বাস্তবে রাজ্য সরকারের অনুদান শেষ অবধি কত শতাংশ চাষির উপকার করিতে পারিবে তাহা লইয়া প্রশ্ন আছে। দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা ‘অভিযোগ’: মোদী জনপ্রিয়তা পাইবার উদ্দেশ্যে ওই প্রকল্পের প্রচলন করিতে চাহিতেছেন। এই পাল্টা দাবিটির গোড়ায় গলদ। ভারতীয় গণতন্ত্রে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বিরোধিতা তখনই কোনও রাজ্য করিতে পারে, যদি তাহাতে কোনও নৈতিক সঙ্কট বা আর্থ-সামাজিক অনিষ্টের আশঙ্কা থাকে। বৎসরে ছয় হাজার টাকার কেন্দ্রীয় অনুদানে নিশ্চয়ই বাংলার চাষির ক্ষতির সম্ভাবনা নাই। তাহার আর্থিক দায়ও কেন্দ্র বহন করিতেছে। তাহা হইলে আপত্তি কিসের? ফসলের দাম অনিশ্চিত, চাষের খরচ সাধ্যাতীত, এই সময়ে কেন্দ্রের অনুদান বাংলার কৃষক পরিবারগুলির প্রয়োজন নাই— এমন দাবি কেবল অবাস্তব নহে, নিষ্ঠুর পরিহাসের শামিল। চাষিকে অনুদান দিলে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার দলের জনপ্রিয়তা বাড়িবে, সেই সম্ভাবনায় তৃণমূল নেত্রী মমতার মাথাব্যথা হইতে পারে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাহাতে বাধা দিতে পারেন না।
মুখ্যমন্ত্রীর আরও আপত্তি: সরাসরি নাগরিককে অনুদান পাঠাইলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যাহত হয়, পিএম কিসান নিধি প্রকল্পের টাকা রাজ্যকে দিতে হইবে, রাজ্য তাহা চাষিদের নিকট পাঠাইবে। এই বিষয়ে কেন্দ্রের সহিত তর্ক চলিতেই পারে, তবে রাজ্যের আপত্তির পক্ষে যুক্তি যথেষ্ট জোরদার নহে। উন্নয়নের যে সকল সিদ্ধান্ত আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণ করা প্রয়োজন, সেখানে রাজ্যের মতকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হইবে, কিন্তু পিএম কিসান নিধি বা আয়ুষ্মান ভারতের ক্ষেত্রে তেমন আপত্তির কারণ নাই। এহ বাহ্য। মুখ্যমন্ত্রী তর্ক চালাইতে চাহেন চালান, কিন্তু ইত্যবসরে রাজ্যের স্বার্থে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সদ্ব্যবহারই তাঁহার কর্তব্য। প্রসঙ্গত, অন্য কোনও রাজ্য এই প্রকল্প খারিজ করে নাই, এমনকি কেরল, পঞ্জাবের মতো বিরোধী রাজ্যও নহে। ইহাতে উপকার ওই সকল রাজ্যের কৃষকদের। যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো বাঁচাইবার দায় কি কেবল পশ্চিমবঙ্গের মানুষের?
নেতাদের অকারণ কুৎসিত দ্বন্দ্বে পীড়িত বোধ করিতে পারেন নাগরিক। তাঁহারই প্রদত্ত করের অর্থে সরকারের কর্মসূচি চলে। অথচ সরকারি প্রকল্পে যে সকল পণ্য বা পরিষেবা সরবরাহ হয়, তাহাতে কোনও এক নেতার মুখের ছবি বা স্বাক্ষরিত পত্র এমন ধারণা তৈরি করিতে চাহে যে, নাগরিক ওই নেতার প্রতি দায়বদ্ধ। অনেক নেতাই খেলাটি খেলিয়াছেন, কিন্তু নরেন্দ্র মোদী তাহাতে একটি সম্পূর্ণ নূতন মাত্রা যোগ করিয়াছেন। ফলে সরকারি প্রকল্প রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের অস্ত্র হইয়াছে। রাজনৈতিক কারণেই রাজ্য সরকার কেন্দ্রের প্রকল্প বাতিল করিয়া, রাজ্যের ব্যয়ে একই প্রকল্প চালাইতেছে। নাগরিক তাঁহার ন্যায্য প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত হইতেছেন, আবার তাহার উপর ঋণের বোঝাও বাড়িতেছে। ইহাই কি নাগরিকের প্রাপ্য?