আজকাল ‘ফেক নিউজ়’-এর অত্যাচার থেকে রবীন্দ্রনাথও বাদ যান না। বাঙালিদের প্রাতঃস্মরণীয় মানুষেরা, বিশেষত রবীন্দ্রনাথ, আজ বেঁচে থাকলে কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করতেন, কোন দল তাঁদের প্রতি বেশি শ্রদ্ধাশীল— এই সব দাবি নিয়ে এত অসংখ্য অ-রাবীন্দ্রিক মানুষের মধ্যে এত বেশি কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছে যে, দেখলে মনে একটি প্রশ্ন জাগে— এই সব দাবিদাওয়ার সরব ও সহিংস তর্কে (মনে রাখবেন, মনীষীদের মূর্তি ভাঙাও এই সব তর্কের অংশ) কি আদৌ কোনও ভোটার ভোলে?
সম্প্রতি দু’টি অভিজ্ঞতার কারণে এই লেখাটির জন্ম। কিছু দিন আগে দুই অপরিচিত ভদ্রলোকের কাছ থেকে একটি মেল পাই। তাঁরা সমাজমাধ্যমে চালু রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি তুলে দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন উক্তিটি ঠিক কি না। উক্তিটি ছিল এই— “পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরোধিতা অত্যুগ্র— সে হচ্ছে খৃস্টান আর মুসলমান ধর্ম। তারা নিজেদের ধর্ম পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এই জন্য তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার আর অন্য কোন উপায় নেই।”
এর কিছু দিন বাদেই দেখলাম, একটি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে এক রাজনৈতিক দলের প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত এক জন তরুণ ঠিক ওই উক্তিটিই তুরুপের তাসের মতো ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে তর্কে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করছেন। কিছুটা হয়তো করলেনও। ওই সভায় এক জন শ্রদ্ধেয় বিদ্বান প্রবীণ মানুষ ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনা কারও কণ্ঠস্থ থাকা সম্ভব নয়। উদ্ধৃতিটি ছিল রবীন্দ্রনাথের একটি প্রকাশিত চিঠি থেকে। এবং উদ্ধৃতিটি থেকে রবীন্দ্রনাথকে আপাত ভাবে ইসলাম-বিরোধী বলেই মনে হয়। তখন তর্কে কিছুটা মুশকিলে পড়ে গিয়েই যেন বিদ্বান মানুষটি বললেন, একটি চিঠির উক্তি রবীন্দ্রনাথের অন্য সব কথার সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে তো! সাধারণ যুক্তি হিসেবে তাঁর কথাটা ঠিকই ছিল। কিন্তু সত্য হল এই যে, উদ্ধৃতিটি রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যটিকে অত্যন্ত খণ্ডিত, বিকৃত ও একপেশে করে হাজির করে। রবীন্দ্রনাথ কোনও দিনই একপেশে মানুষ ছিলেন না। কিন্তু ভোটযুদ্ধ যত তীব্র হবে ও বাজারে অর্ধসত্যের কারবারে রমরমা দেখা দেবে, অনুমান করা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের এই আপাত ভাবে মুসলিম-বিরোধী উক্তির ব্যবহারও বাড়বে। তাই উক্তিটি নিয়ে একটু আলোচনা প্রয়োজন মনে করছি। আশা করি, ফেক নিউজ়ের কারখানা চালু রাখার জন্য আমরা রবীন্দ্রনাথকেও কাঁচামালে পরিণত করব না। এই উদ্বেগই আমার এই রচনাটির উৎস।
রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিটি পাওয়া যাবে কালান্তর গ্রন্থে প্রকাশিত কালিদাস নাগ মশাইকে লেখা একটি পত্রে। শতবার্ষিকী সংস্করণের ত্রয়োদশ খণ্ডের ৩৫৫-৩৫৮ পৃষ্ঠায়। চিঠিটির তারিখ শ্রাবণ ১৩২৯, অর্থাৎ ১৯২২ সালের জুলাই-অগস্ট মাসে লেখা। ১৯২০-র মোপলা বিদ্রোহ হয়ে গিয়েছে, ১৯২১-এর কিছু হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গাও হয়ে গিয়েছে, আর কিছু দিন বাদেই ১৯২৫-২৬ সাল নাগাদ হিন্দু-মুসলমান কাজিয়া তুঙ্গে উঠবে। একটি সাময়িক ভাবে শান্ত বছরে চিঠিটি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর মন সেই স্বদেশি আমল থেকেই চিন্তিত। চিঠির এই অংশটি আর একটু পড়া যাক। উদ্ধৃত অংশের ঠিক পরেই রবীন্দ্রনাথ লিখছেন— “খৃস্টানধর্মালম্বীদের সম্বন্ধে একটি সুবিধের কথা এই যে, তারা আধুনিক যুগের বাহন; তাদের মন মধ্যযুগের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়। য়ুরোপীয় আর খৃস্টান এই দুটো শব্দ একার্থক নয়। ‘য়ুরোপীয় বৌদ্ধ’ বা ‘য়ুরোপীয় মুসলমান’ শব্দের মধ্যে স্বতোবিরুদ্ধতা নেই। কিন্তু ধর্মের নামে যে জাতির নামকরণ ধর্মমতেই তাদের মুখ্য পরিচয়। ‘মুসলমান বৌদ্ধ’ বা ‘মুসলমান খৃস্টান স্বতই অসম্ভব’ (পৃ ৩৫৬-৩৫৭)।” বলতে বাধা নেই, এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মতামত আজকের যুগে সর্বজনগ্রাহ্য হবে না। কিন্তু তিনি যে মুসলমানদের এখানে কিছুটা সমালোচনা করেছিলেন, তা নিয়েও সন্দেহ নেই।
আমাদের রাজনৈতিক প্রবক্তা ভদ্রলোক কিন্তু এক বারের জন্যেও উল্লেখ করেননি যে, এই সব কথার অব্যবহিত পরেই হিন্দু ধর্মের সম্বন্ধে কী বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেটাও পড়া যাক! বলেছিলেন, “অপর পক্ষে হিন্দুজাতিও এক হিসাবে মুসলমানদেরই মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রাকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহ্য প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয়— অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের non-violent non-cooperation। হিন্দুর ধর্ম জন্মগত ও আচারমূলক হওয়াতে তার বেড়া আরো কঠিন। মুসলমানধর্ম স্বীকার করে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ। আহারে ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখ্যান করে না, হিন্দু সেখানেও সতর্ক। তাই খিলাফত উপলক্ষে মুসলমান নিজের মসজিদে ও অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারেনি” (পৃ ৩৫৭)। রবীন্দ্রনাথ এমনও বলছেন যে, হিন্দুধর্মের ‘‘প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ ও প্রত্যাখ্যান।’’ ‘‘এক সময়ে ভারতবর্ষে গ্রীক পারসিক শক নানা জাতির অবাধ সমাগম ও সম্মিলন ছিল’’ বটে— কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “মনে রেখো, সে ‘হিন্দু’ যুগের পূর্ববর্তী কালে। হিন্দুযুগ হচ্ছে একটা প্রতিক্রিয়ার যুগ— এই যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল... সকল প্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুণ কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কথাও সৃষ্টি হয় নি।”
এমন রবীন্দ্রনাথকে নিছক মুসলিম-বিদ্বেষী বলে চালানো শক্ত। কালান্তর গ্রন্থে আরও একটি রচনা আছে ‘হিন্দুমুসলমান’ নামে। রচনাকাল শ্রাবণ ১৩৩৮, অর্থাৎ, এখানে আলোচ্য চিঠির প্রায় দশ বছর পরে লেখা। সেখানেও রবীন্দ্রনাথ বরাবরই যা ছিলেন, তা-ই— হিন্দু-মুসলমানের মিলনকামী মানুষ, বিভেদকামী নন। লিখছেন, “... আজকাল হিন্দু-মুসলমান পৃথক হয়ে গিয়ে সাম্প্রদায়িক অনৈক্যকে বাড়িয়ে তুলেছে, মনুষ্যত্বের মিলটাকে দিয়েছে চাপা। আমি হিন্দুর তরফ থেকেই বলছি, মুসলমানের ত্রুটিবিচারটা থাক— আমরা মুসলমানকে কাছে টানতে যদি না পেরে থাকি তবে সেজন্যে যেন লজ্জা স্বীকার করি” (পৃ ৩৬৭)। হিন্দু ও মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়কেই মধ্যযুগীয় মনোভাব পেরিয়ে আসতে হবে— “য়ুরোপ সত্যসাধনা ও জ্ঞানের ব্যাপ্তি ভিতর দিয়ে যেমন করে মধ্যযুগের ভিতর দিয়ে আধুনিক যুগে এসে পৌঁচেছে, হিন্দুকে মুসলমানকেও তেমনি গণ্ডির বাইরে যাত্রা করতে হবে” (পৃ ৩৫৭, কালিদাস নাগকে লেখা চিঠি)।
আজকের ঐতিহাসিক রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত ইতিহাসের সঙ্গে একমত না হতেই পারেন। কিন্তু কারও তো অধিকার নেই জ্ঞানত রবীন্দ্রনাথকে খণ্ডিত ও বিকৃত করে তাঁর চিন্তা সম্বন্ধে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার। মানুষটাকে অর্ধসত্যের শিকার না-করে অনেক বেশি সৎ রাজনীতি করা যেত এটা স্বীকার করে নিলে যে, আজকে যাঁরা ‘হিন্দু’র নামে ভোট চান, তাঁরা আর যা-ই হন, রবীন্দ্রনাথের পথের পন্থী নন। অবশ্য আজ যখন মুহুর্মুহু ‘বদলে গেল পথটা, পালটে নিলুম মতটা’র যুগ এসেছে, তখন এই সততা হয়তো আশা করাই বাতুলতা।
ইতিহাস বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো