কাশ্মীরের দৃশ্য।
হারানের মেয়েটির উপরে সমানে অত্যাচার চলছে। বেমক্কা ধাক্কায় তিনি ছিটকে গিয়ে পড়লেন কাঠের গুঁড়ির উপর। পিঠে বিঁধল ভাঙা কাঠের ধারালো কোনা। তিনি সংজ্ঞা হারালেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে চোখ মেলে দেখলেন, গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁর স্বামী।
যাক, তবুও তো ওঁর স্বামী আছেন! ওই দেখুন, আর এক হতভাগা মেয়ে। ২০ বছর ধরে তিনি স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু বিশ্বাস করেন, স্বামী এক দিন ফিরবেন। দরজায় কড়া নাড়বেন। ছেলেও অপেক্ষায় থাকে, বাবা ফিরবে। বৃথা আশা তাই মরতে মরতেও মরে না।
স্বামীর জন্য মহিলারা কত কী করেন! শত্রু শিবিরে পর্যন্ত যেতে হয়। তার পরেও স্বামী ফেরেন না। লাঞ্ছনা, হেনস্থা, অত্যাচারের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তবুও ওঁরা স্বামীর আশা ছাড়েন না। বড় পরিবার প্রেম তাঁদের!
এ বার, এ দিকে আসুন। ওই যে, গঙ্গাবল লেকের পাশের জমিটা দেখতে পাচ্ছেন? কী যেন একটা চকচক করছে। সিলভার ঝুমকো? নীল কসবা? ওটা নিশ্চয়ই ওই অষ্টাদশীর। মেধাবী মেয়ে। হাসিখুশি। তার পরে এক দিন হারিয়ে গেল। পরে তার দেহ মিলল। জানা গেল, জলে ডুবেই নাকি সে মারা গিয়েছে!
যদিও সে কথা বিশ্বাস করেন না গ্রামের মানুষ। লুরকোটি গ্রামের মেয়ের মতো কত মেয়ের পড়া শেষ হল না। স্কুল কিংবা কলেজে যাওয়ার স্বপ্ন বুনতে বুনতে নিখোঁজ হয়ে গেল পথেই। কাশ্মীরের মাটিতে মিশে রয়েছে এমন বহু মেয়ে। ভূস্বর্গও এমন ভয়ঙ্কর হতে পারে!
ওঁরা বলছেন, ‘মারলে এখনই মেরে ফেলুন। সরাসরি গুলি করুন। কিন্তু অত্যাচার নয়।’ কিন্তু সে কথা শুনছে কে? ওই বন্দুকবাজ কী বলছে শুনুন! সে বলছে, ‘কাশ্মীরি মেয়েদের উপর অত্যাচার হবে না? ওরা কী সুন্দর! এটাই তো স্বাভাবিক। নন ফ্যামিলি স্টেশনে এমন এক-আধটু হবেই। তা ছাড়া এক মেয়েকে শাস্তি দিলে যদি হাজার জনের প্রতি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা যায় তবে তো কাশ্মীরি মেয়েদের এটুকু সইতেই হবে! কেন এত সুন্দর ওই দেশের মেয়েরা?’
সত্যিই তো, কেন সুন্দর ওই দেশের মেয়েরা? সুন্দর বলেই তাঁকে অত্যাচার সইতে হবে। সুন্দর বলেই তাঁকে রোজ মরে গিয়েও বেঁচে থাকতে হবে। আর সুন্দর বলেই তো কাশ্মীরি মেয়েদের হন্যে হয়ে ‘সার্চ’ করছে লোকজন। আঙুর ফল টক ছিল এত দিন। এখন আর রইল না!
প্রথমে অতিথি হিসেবে প্রবেশ। তার পরে খাওয়া-দাওয়া, তল্লাশি, অত্যাচার এবং হত্যা। এমনটা সইতে সইতে কাশ্মীরি মেয়েরা ক্লান্ত। ১৯ থেকে ৩৩ বছরের বহু মেয়েরা জানাচ্ছেন, তাঁদের মনে হয় অবিরাম দেহে যেন হেঁটে যাচ্ছে বিষাক্ত পোকা! আবার পাগল কুকুরের মতো ভয়ঙ্কর জানোয়ারের তাড়া খেতে খেতে তাঁরা হাঁপিয়ে উঠেছেন। দলবেঁধে আত্মহত্যাও করছেন তাঁরা। শ্রী মহারাজা হরি সিং হাসপাতালের রেজিস্টার জানাচ্ছে, এমন বহু মেয়ে অত্যাচারের ভয় আর নির্মম যন্ত্রণার কারণে তাঁদের বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলেছেন।
কাশ্মীর তো এখন দিঘা, পুরী, দার্জিলিংয়ের মতো হয়ে গেল। সপরিবারে এক বার ঘুরে আসুন। পারলে এক বার কান পাতুন গুলমার্গের নিংলে নাল্লায়। শুনতে পাবেন বুকফাটা কান্নার আওয়াজ! সম্মান করুন। কদর করুন কাশ্মীরের মেয়েদের। নাগিন লেকের সামনে গিয়ে হাততালি দিন। প্রতিধ্বনি ফিরে এলে জানবেন স্বামীহারাদের লড়াইয়ের মর্যাদা দিলেন। ডাল লেকে ভেসে থাকা পদ্ম পেলে কাশ্মীরি মহিলার সহনশীলতাকে সম্মান জানান।
হাইজিন ভ্যালিতে ফুটে থাকা লাল ফুল কিংবা আরু ভ্যালির গোলাপি টিউলিপ দেখতে দেখতে দেখবেন আপনারও মনে হবে, ১১ বছরের ফুলের মতো মেয়েটার জীবনও এমন রঙিন হতে পারত। মেহবিশ মেহেরাজ জার্গরকে মনে আছে?
কাশ্মীরের যে মহিলা বারুদের গন্ধ উপেক্ষা করে প্রথম ক্যাফে খোলার সাহস দেখিয়েছিলেন। পারলে তাঁকেও দেখে ফিরুন। এ বার মুঠোফোন খুলুন। কাশ্মীরি মেয়েদের না খুঁজে টাইপ করুন, Ocean of Tears। কাশ্মীর নিয়ে ৭৮ মিনিটের তথ্যচিত্র। কেটেছেঁটে মাত্র ২৭ মিনিট রাখা হয়েছে।
কাশ্মীর ঘোরা শেষ হলে ফেরার পথে কুর্নিশ করুন কাশ্মীরি সুন্দরীদের! ভুল সংশোধন করতে লজ্জা কিসের? কাশ্মীর থেকে ফিরুন ওঁদের প্রতি অগাধ ভালবাসা নিয়ে। দেখবেন, এই সরল সুন্দর, মার্জিত, পরিবারপ্রেমী কাশ্মীরি মহিলাদের সম্মান দিয়ে আপনার নিজেরও বেশ গর্ব হবে।
শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল
ঋণ—
১) Rape, Impunity And Justice In Kashmir: Kazi Seema
২) Speaking Peace: Women's Voices From Kashmir: Urvashi Butalia
৩) Conflict Rape Victims: Abandoned And Forgotten: Hashmi, Syed Junaid
৪) Deccan Herald: Married to Brutality (25 Feb, 2006)
৫) Asia Watch & Physicians for Human Rights (Vol 5, Issue 9): Rape in Kashmir: a crime of war