কয়েক দিন আগে এক তরুণ লেখক বলছিলেন লেখার জগতের প্রচ্ছন্ন পুরুষতান্ত্রিকতা নিয়ে। অনেক লেখক নাকি এমন ভাব করেন যে, মেয়েদের ভাল লেখাগুলি তাঁরা পড়েননি, বা তাঁদের কথা জানেন না। মেয়েদের ভাল লেখার উল্লেখ না করাটাই যেন সমাজমাধ্যমে স্বাভাবিক। বললাম, কেবল সমাজমাধ্যমে কেন, ছাপা লেখাতেও আছে। মেয়েরা অনেকটা ভূতের মতো। আছেন, লিখছেন, কিন্তু তাঁদের লেখক অস্তিত্ব সবাই দেখতে পায় না। মানুষ কেন দেখতে পাচ্ছে না, ভূত তা বোঝে না, সে ভাবে, কেন তার সঙ্গে কথা না বলে, তাকে ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে লোকজন। উত্তরে তরুণটি বলেছেন, “অদৃশ্য নন, আপনারা পারমাণবিক। পরমাণুর মতো অসীম শক্তি ধরেন।” বেশ লাগল শুনে!
তিরিশ বছর আগে গদ্য লেখার গোড়ার দিকে, লেখক বন্ধুর মুখে শুনেছি, “আপনাদের তো ফাঁকা মাঠে গোল।” মানে, আমাদের, মেয়েদের মাঠ আলাদা, খেলাটাও আলাদা। মূল প্রাঙ্গণটা ওঁদের। কবিতাই লিখি তখন। তবু সদ্যপ্রকাশিত গল্পের কথা বলতে গিয়েছিলাম এক যুবক লেখককে, যিনি তখন নামজাদা গল্পকার। কাষ্ঠ হেসে বলেছিলেন তিনি, “মেয়েরা আর এক বিশেষ সম্প্রদায়, যা লিখবে তাই ছাপা হবে।” অজ্ঞতা? ঈর্ষা? হীনম্মন্যতা? এই তো সে দিন, ব্যতিক্রমী লেখক যিনি জন্মসূত্রে নারী, তাঁর প্রশংসায় অগ্রজ পুরুষ লেখক বললেন, “মেয়েদের মধ্যে তুমি খুব ভাল লিখছ।”
অর্থাৎ, একটা স্পষ্ট বিভাজন আছে। এক দিকে ‘লেখকরা’ আর অন্য দিকে ‘মেয়েরা, যাঁরা লেখেন’। এটা সবার মাথায় নেই। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের অগ্রজ পুরুষ লেখকদের এই মনোভাব সহজে আয়ত্ত করতে দেখেছি পরবর্তী অনেককে। লেখক, সমালোচক, গবেষক। এবং সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানগুলি। খেলার নিয়ম এঁরাই তৈরি করেন। দাদাদের ক্রিকেট কাউন্সিল।
‘সেন্সরশিপ অব সাইলেন্স’ মেয়েদের লেখার ক্ষেত্রে পৃথিবীর সর্বত্র আছে, এ দেশে, এই বাংলায়। সাক্ষাৎকারে গুরুত্বপূর্ণ লেখা, লেখকের প্রসঙ্গ এলে, একশোর মধ্যে নিরানব্বই জনের মতামতে মেয়েদের কোনও উল্লেখ দেখি না। দশকওয়াড়ি কবি-লেখকদের উল্লেখে তালিকা তৈরি করতে গিয়ে মেয়েদের নাম প্রায় মনেই আসে না গবেষকদের। জীবনের প্রথম সাহিত্য পুরস্কার নিয়েছিলাম এক খ্যাতিমান পুরুষের কাছ থেকে। তিনি বলেছিলেন, “ওর লেখা পড়িনি। নিশ্চয়ই ভালই লেখে। কাজকর্মও ভাল করে। কাজেই লেখা চালিয়ে যেতে পারবে।” লেখা তো চালিয়ে গিয়েছি, কিন্তু কিছু ভুলিনি দেখে আশ্চর্য লাগে।
সাড়ে তিন দশক আগেকার স্মৃতি। খ্যাতিমান প্রবীণ লেখক বলছেন, “তোমার অমুক বইটা না, দারুণ হয়েছে।” উৎসুক আমি জানতে চাই, আপনি পড়েছেন? “নাহ্। আমার স্ত্রী বলছিলেন। ও খুব পড়ে।” অনেক অনেক বছর পার হয়ে কোনও এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে ঢোকার মুখে ঝকঝকে তরুণ লেখকের হাসি আমাকে থামায়— “আপনার অমুক উপন্যাসটা দিদি, ওহ্ অসাধারণ!” এত দিনে ঔৎসুক্য অনেক কম, তবু মুখে হাসি এনে বলি— তুমি পড়েছ? “আমি না, আমার পিসিমা বলছিলেন। উনি আপনার সব লেখা পড়েন।” পঁয়ত্রিশ বছরে সহলেখকদের বৌদিদের হাত থেকে ব্যাটন পিসিমাদের হাতে পৌঁছে গিয়েছে জেনে চমৎকৃত হই। মনে মনে এই নারীদের পেন্নাম করি, যাঁরা পার্শ্ববর্তিনী হয়ে আমাদের লেখা পড়ে চলেছেন। (না কি এঁরাই ছদ্মবেশী পুরুষ!)
আমি জানি, সহৃদয় পাঠক, আপনি কী বলবেন। আসলে সময়টাই যে বড় অন্য রকম। সমাজমাধ্যমে নিত্য জন্ম নিচ্ছেন লেখক, সেখানে অবিরল গদ্য ও কবিতা লিখে অজস্র ‘লাইক’ পান, অথচ অতীত বর্তমানের কোনও মুদ্রিত সাহিত্যই পড়েন না। নিজের লেখা ক্রমাগত পাঠাচ্ছেন অন্যের ইমেলে, হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে। ক্রমাগত চাইছেন অপ্রকাশিত লেখার উপর মতামত। কিন্তু অন্যের লেখায় লাইক দিতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যান।
এর মধ্যে কোথায় আনব নারী-পুরুষের বিভাজন? যাঁরা ভাল লেখেন, অথচ কোনও প্রতিষ্ঠান বা সংবাদপত্রে নেই, এবং নিজের শর্তে লিখতে চান, তাঁদের সবার সমস্যা কি এক নয়? নারী হন বা পুরুষ? এর উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলতে পারলেই খুশি হতাম। কিন্তু ইতিহাস যে ছাড়ে না, শরীর-মনে লেগে থাকে তার তৈরি বৈষম্যের শিকল। যে দেশে চিতায় পুড়লেও দলিত দলিতই থাকে, সে দেশে মেয়েদের লেখকজীবনও চার পায়ে দড়ির ফাঁস বাঁধা ঘোড়ার জীবনের মতো। একশোর মধ্যে পঁচানব্বই জন মেয়েকে লিখতে হয় অফিসের দায়িত্ব, ঘরের নানা কাজ, আত্মীয়পরিজন, আচার লৌকিকতা সামলে। সন্তান ধারণ, সন্তান পালন এমন মৌলিক দায়িত্ব যা একান্ত মেয়েদেরই। শরীর মনের উপর চাপ দেয়, সময়ের উপর থাবা মারে প্রতিনিয়ত। সব দায়িত্ব শেষ করে যখন মেয়েটি লেখার টেবিলে এসে বসেন, তখন তাঁর শক্তি নিঃশেষ, রক্ত জল। গত আট মাসের লকডাউন পর্বে স্যানিটাইজ়ার-সাবানে অসংখ্য বার হাত ধুয়ে, বাসন মেজে, কাপড় কেচে, হাতের রেখাসমূহ মুছে যায়নি, কোমরে ঘাড়ে হয়ে যায়নি চিরস্থায়ী ব্যথা, এমন লেখক মেয়েরা হাত তুলুন!
তবু যে মেয়েরা লিখতে চান, ভালবেসে লেখেন এবং সৃষ্টি করেন মননশীল সাহিত্য। সর্বদা সাম্মানিক না পেয়েও, রয়্যালটি বঞ্চিত হয়েও লেখেন, এটাই ভাষা-পৃথিবীর এক অষ্টম আশ্চর্য।
কিন্তু আলাদা মাঠে খেলে কি কোনও ক্ষতি হয়েছে মেয়েদের? লেখা ছাপা হয়নি? বই বেরোয়নি? পুরস্কৃত হয়নি লেখা? তবে সমস্যাটা কী? তা হলে আমরা কেন মন থেকে উপড়ে তুলে দিতে পারি না উল্লিখিত, আলোচিত না হওয়ার কাঁটাগুলি? কেন ভুলি না সহলেখকদের ঈর্ষা, হীনম্মন্যতা? আমরা যে এই রকমই। কিছু ভুলতে পারি না, ফেলতে পারি না প্রাণ ধরে কিছু। ক্ষমতার তন্ত্রের উল্টো দিকে দাঁড়ানো মেয়েরা তাই দার্শনিক হন না।
সত্যিই তো, অনেক কিছু বদলেছে। যেমন ওই তরুণ, যিনি প্রাণ ধরে আমাদের বললেন, পারমাণবিক! লেখার চিন্তাভাবনায় যাঁরা সক্রিয়, তাঁদের জন্য ভাল প্রকাশকের দরজা খোলা, আছে নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠীও। অন্নপূর্ণার মন্দিরের প্রসাদের মতো বড়সড় পুরস্কারও মেয়েরা পেয়ে যান একটু বিকেলের দিকে, কী করা যাবে, তাঁদের যে খুঁজতে হয় দূরবিন দিয়ে! দেখতে দেখতে কত অনুবাদ হল মেয়েদের লেখা! রাসসুন্দরী দেবী থেকে বেবী হালদার! জাতীয় প্রকাশনায় মেয়েরা থাকায় দূরবিনটা অণুবীক্ষণ যন্ত্র হয়েছে অনেকটাই।
কথাসাহিত্যিক বন্ধু, যাঁরা সাম্প্রতিক সাহিত্য নিয়মিত পড়েন, তাঁদের অভিনিবেশ পাই। পিঠ চাপড়ানি নয়, ভাল লেখার জন্য চাই অভিনিবেশ। আর চাই খেলার সমান নিয়ম, এক লেভেলের মাঠ। এটা চাইতে চাইতে অবশ্য অনেকেরই জীবন ফুরিয়ে যায়।
আকাশের তারা হয়ে আশাপূর্ণা, মহাশ্বেতা, নবনীতার মতো ফুটে থাকলে তবে মেয়েদের বলে সাহিত্যিক, বলে লেখক, বলে কবি। নক্ষত্রমণ্ডলীতে কোনও বিভাজনরেখা নেই।