G7 Summit

জননেতা থেকে জোটসঙ্গী

পাশ্চাত্যের দেশগুলির উদ্দেশ্য, ওই বৈঠকে ইউক্রেনের পক্ষে বিভিন্ন দেশ, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলির সমর্থন আদায় করা, এবং ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে কোণঠাসা করা।

Advertisement

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০২৪ ০৭:৩১
Share:

সব কিছু ঠিকঠাক চললে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১৩-১৫ জুন ইটালিতে জি৭ বৈঠকে যোগ দেবেন। এটাই হবে তৃতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পরে মোদীর প্রথম বিদেশ ভ্রমণ, এবং বহুপক্ষীয় একটি সমাবেশে অংশগ্রহণ। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলির একটি সংগঠন জি৭, যার সদস্যরা প্রতি বছর মিলিত হয় বিশ্বায়িত অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা প্রভৃতি নিয়ে আলোচনায়। সম্প্রতি আলোচনার তালিকায় যোগ হয়েছে কৃত্রিম মেধাও। ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, যিনি মোদীর বিশেষ অনুরাগী, তিনি তো অবশ্যই উপস্থিত থাকছেন। আরও থাকবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাকরঁ, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ়। ব্রিটেন, কানাডা, জাপানের প্রধানমন্ত্রী, এবং আরও কিছু আন্তর্জাতিক নেতা উপস্থিত থাকবেন।

Advertisement

ইটালির সম্মেলনের পর সম্ভবত মোদী সুইৎজ়ারল্যান্ডে যাবেন না, ইউক্রেন শান্তি সম্মেলনে যোগ না দিয়েই দেশে ফিরবেন। গত কয়েক মাস ইউরোপের নেতারা ওই বৈঠকে মোদীর উপস্থিতির জন্য তদবির করে আসছেন। পাশ্চাত্যের দেশগুলির উদ্দেশ্য, ওই বৈঠকে ইউক্রেনের পক্ষে বিভিন্ন দেশ, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলির সমর্থন আদায় করা, এবং ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে কোণঠাসা করা। বাস্তব এই যে, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলি ইউক্রেনকে ক্রমাগত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র জোগান দেওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া এই যুদ্ধ জিতছে। অতএব একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চেপুতিনের বিরোধিতা, নিন্দা করাই এখন উদ্দেশ্য। ভারত যদিও ইউক্রেনে শান্তির পক্ষে, কিন্তু যে শান্তি বৈঠকে রাশিয়াকে বাইরে রাখা হয়েছে, তার সমর্থনে মোদী দাঁড়াবেন, তা মনে হয় না।

ইটালির জি৭ বৈঠকে গিয়েও সুইৎজ়ারল্যান্ডের শান্তি সম্মেলনে না গিয়ে মোদী সম্ভবত বোঝাতে চাইছেন যে, ভারত তার নিজস্ব, স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে বিচলিত হবে না। রাশিয়ার উপর পশ্চিমের দেশগুলি যে চাপ তৈরি করতে চাইছে, মোদী তা সমর্থন করবেন না। ইউক্রেন শান্তি সম্মেলনে বিশ্বের অন্তত নব্বইটি দেশ আসছে। বেশ কিছু দেশের প্রতিনিধি হিসাবে আসছেন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি। কিন্তু এই সম্মেলন প্রধানত পশ্চিমের শক্তিশালী দেশগুলির সমর্থকদের, উন্নয়নশীল দেশগুলির অনেকেই এই বৈঠকে নেই। যেমন, চিন এবং ব্রাজ়িল থাকছে না। রাশিয়াকে নিঃসঙ্গ, কোণঠাসা করার পশ্চিমি উদ্যোগে ভারত খুব বেশি উৎসাহী হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, নয়াদিল্লি বহু দশক ধরে রাশিয়াকে আস্থাযোগ্য সঙ্গী বলে মনে করে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, যে আন্তর্জাতিক নেতারা সর্বাগ্রে মোদীকে তাঁর সাম্প্রতিক জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন, তাঁদের অন্যতম পুতিন।

Advertisement

তবে, ইটালির বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি উপস্থিত থাকবেন, এবং সেখানে মোদীর সঙ্গে তাঁর কথা হতে পারে। তবে মোদীর এ বারের ইটালি সফর তাঁর আগেকার বিদেশ সফরগুলির থেকে কিছুটা অন্য রকম হওয়াই প্রত্যাশিত। এই প্রথম মোদী একটি জোট সরকারের প্রধান হিসেবে যাচ্ছেন। এর আগে মোদী যেখানেই গিয়েছেন, বিমানবন্দরে, রাস্তার দু’ধারে অভিবাসী ভারতীয়দের বিপুল ভিড় তাঁকে স্বাগত জানিয়েছে। তাঁর সভায় এত মানুষের জমায়েত হয়েছে যে, আমন্ত্রণকারী ব্রিটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার সরকার বিস্মিত, অভিভূত হয়েছে। মোদীর ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক নেতাদের মনে এই ধারণা তৈরি করেছিল যে, মোদী অপরাজেয়। তাঁর দল বিজেপি তাঁর অধীনে আরও বেশি জনসমর্থন আদায় করবে, এমনই প্রত্যাশা কাজ করেছে দীর্ঘ দিন।

তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলায় মোদী সফল হয়েছেন বলেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতি বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে। ভারতে মোদীর জনপ্রিয়তা, অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধি, বৃহৎ বাজার, এবং সেই সঙ্গে চিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভারতের অবস্থান, যা ভারত মহাসাগর-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে শক্তির টানাপড়েনে ভারসাম্য আনতে পারে, এ সবই বিশ্বের নেতাদের আকর্ষণ করেছিল। পাশাপাশি, ভারতে গণতন্ত্রের জমি হারানো— সংখ্যালঘুদের হয়রানি, মিডিয়া এবং নাগরিক সমাজের হয়রানি, এবং সরকার-বিরোধিতার পরিসরের দ্রুত ক্ষয়, এ সব নিয়েও বহু কথা হয়েছে।

এ বারের সাধারণ নির্বাচন এবং তার ফলাফল ভারতের বাইরেও যথেষ্ট আলোচিত হচ্ছে। মোদীর নেতৃত্বে জোট সরকারের স্থায়ীত্ব নিয়ে যে আগামী পাঁচ বছর বার বার প্রশ্ন উঠবে, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলও ওয়াকিবহাল। ফলে দশ বছর পরে ভারতের বহুদলীয় গণতন্ত্রের দিকে তাঁদের নজর গিয়েছে। বিদেশের নানা সংবাদমাধ্যমে ভারতকে গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসার জন্য অনেকেই অভিনন্দন জানিয়েছে। ভারতের নির্বাচনী ফলকে সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের জয় বলে তারা দেখছে।

এর ফলে হয়তো ভারতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপরে আক্রমণ বিশ্বের নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তার বিষয়সূচিতে স্থান পেতে পারে। আগে যা ভাবাই যেত না। ভারতের গণতন্ত্রের উপর আঘাত করলে বিদেশ থেকে বিরূপ সমালোচনা, যথাযথ পদক্ষেপ করার জন্য চাপ, এগুলোরও মোকাবিলা মোদী সরকারকে করতে হতে পারে। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলির কাছে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী, তাই মোদী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সঙ্গে দেশগুলি কথাবার্তা চালিয়ে যাবে। তবে মোদীই যে ভারতে শেষ কথা নয়, তা-ও এখন তাদের কাছে স্পষ্ট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement