আবার পরিসংখ্যান? যেন সেই রাজা, যিনি ‘পুঁথির পাতে’ লেখা ‘নেড়া যায় বেলতলাতে’ দেখে সন্তুষ্ট না হয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘কিন্তু প্রশ্ন ক’বার যায়?’ এই সংখ্যা রাজার কোন কম্মে লাগবে, তা অবশ্য জানা যায় না। আর এই আপাত-অনাবশ্যক তথ্য নিয়ে ভেবে অস্থির হওয়া রাজাকে নিয়ে সবাই চিন্তায় আকুল— ‘রাজা বুঝি ভেবেই মোলো’। তবে সব পরিসংখ্যানই এমন অনাবশ্যক হয় না। আর সে সব নিয়ে ভেবে আকুল হওয়ারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
বলছি ভারতীয় জনশুমারির কথা, যার ইতিহাস ঠিক দেড়শো বছরের। ১৮৭২-এ প্রথম, তার পর প্রতি দশকের গোড়ায় জনগণনা হয়ে এসেছে নিয়মমাফিক, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ২০১১ পর্যন্ত। সার্ধশতবর্ষে এসে এই প্রথম তার ব্যতিক্রম হল। ২০২১ সালের জনগণনা এখনও হল না। আপাত কারণ কোভিড অতিমারি। ২০২২-এরও অর্ধেক অতিক্রান্ত হতে চলল— এখনও জানা যায়নি যে, কবে হবে। এ ভাবে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে গণনা স্থগিত রাখা সেনসাসের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। ছোট-বড় অনেকগুলি রাজ্যে নির্বাচন সম্পন্ন হতে দেখলাম এই কোভিড কালেই। নির্বাচন ঘিরে বিপুল জনসমাবেশও হল। সে সবে সংক্রমণের ঝুঁকিও ছিল যথেষ্ট। তুলনায় মানুষ গোনার কাজটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তা মনে করার কোনও কারণ আছে কি? বস্তুত, মাস্ক পরে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেও দিব্যি করে ফেলা যায় কাজটি। অন্তত দু’টি দেশকে জানি, যেগুলি কোভিড অতিমারির প্রকোপের হিসাবে অনেক উপরে থাকলেও এর মধ্যেই জনগণনার কাজটি সেরে ফেলেছে। ২০২০-র নভেম্বর-ডিসেম্বরে চিনে জনগণনা হয়েছে, ২০২১-এর মে মাসে তার পরিসংখ্যানও জনপরিসরে এসে গিয়েছে। আমেরিকাও ২০২০-তে গণনা সেরে ফেলেছে, গত বছর অগস্ট মাসে পরিসংখ্যানও প্রকাশ করেছে। অতিমারির জন্য জনগণনা স্থগিত রাখার কথা সে দেশগুলি ভাবেনি। তা হলে কি বুঝতে হবে যে, এখানে অতিমারি ব্যতিরেকে অন্য কারণও আছে? থাকলে সেটি যে কী, তা জানার উপায় নেই।
জনগণনার কাজটি যে এ বার সোজাসাপ্টা হবে না, সে কথা তখনই বোঝা যাচ্ছিল, যখন কেন্দ্রীয় সরকার সেনসাস-এর সঙ্গে ‘ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার’ (এনপিআর) তৈরির কাজটিও জুড়ে দিতে চাইছিল। এনপিআর হল জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজ়েনস বা এনআরসি) নির্মাণের প্রথম ধাপ। এনপিআর-এর প্রকাশ্য উদ্দেশ্য ছিল ‘দেশের স্বাভাবিক অধিবাসী’-দের তালিকা প্রস্তুত করা; আর প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্যটি ছিল কোনও বিশেষ জনগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে সেই তালিকার বাইরে রাখা। অসমে এনপিআর চালু করে যে কাণ্ডটি হল, তা সকলেরই জানা। ১৯ লক্ষ মানুষ নাগরিক তালিকার বাইরে পড়ে গেলেন, যার মধ্যে সব সম্প্রদায়ের মানুষই রয়েছেন। এনপিআর নিয়ে এই প্রথম ধাক্কাটি সম্ভবত অপ্রত্যাশিত ছিল, তাই সামলাতেও সময় লাগবে। ২০২১-এ যদি সেনসাসের সঙ্গে এনপিআর জুড়ে সারা দেশে তথ্য সংগ্রহ শুরু হত, সম্ভবত ধুন্ধুমার বেধে যেত। ক্ষুব্ধ মানুষজন তথ্য সংগ্রাহকদের সঙ্গে সহযোগিতা করতেন না। তাই কি প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত করার চেষ্টা?
কেউ বলতে পারেন, এখনকার মতো এনপিআর মুলতুবি রেখে ঠিক সময়ে জনগণনার কাজটি তো নিয়মমাফিক করা যেত। মনে রাখতে হবে, সেনসাস এবং এনপিআর— দু’টির দায়িত্বই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। অনুমান করছি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অগ্রাধিকার তালিকায় সেনসাস-এর স্থান এনআরসি বা এনপিআর-এর ঊর্ধ্বে নয়। অতীতের সেনসাস থেকেই পরিসংখ্যান নিয়ে এবং যুক্তি দিয়ে দেখানো যায় যে, ‘অনুপ্রবেশ’ একটি অতিকথা। অতএব ওই দিক থেকে সেনসাস নিয়ে মন্ত্রকের আগ্রহের কারণ নেই। এই অভূতপূর্ব বিলম্বের ক্ষতির দিকটি তাঁদের মনোজগতে কতটা স্থান পাবে, তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে। আপাতত তাঁরা কোন মসজিদের নীচে কোন মন্দির অদৃশ্য হয়ে আছে, তা খুঁজে বার করতে বেজায় ব্যস্ত।
ক্ষতিটি কিন্তু সামান্য নয়। ভারতীয় সেনসাস এমনই এক তথ্যভান্ডার, যার বিকল্প নেই। একেবারে গ্রাম থেকে শুরু করে, বা শহরের ওয়ার্ড থেকে, জেলা, রাজ্য হয়ে কেন্দ্রীয় স্তর পর্যন্ত অধিকাংশ পরিকল্পনাই সেনসাস পরিসংখ্যান ছাড়া অসম্ভব। ভারতের যে কোনও গ্রামে বিভিন্ন সামাজিক বর্গের বয়স-ভেদে নারী-পুরুষের সংখ্যা, তাঁদের মধ্যে সাক্ষরতার হার, কত জন কর্মরত ইত্যাদি সেনসাস থেকেই পাই। সব মিলিয়ে প্রতিটি গ্রামের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক চরিত্রের একটি প্রাথমিক ধারণা সেনসাস থেকে পেয়ে যাই, যা পিছিয়ে পড়া বা এগিয়ে থাকা গ্রামকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। আবার সেনসাস থেকেই জানতে পারি যে, ছ’বছর বা তার কম বয়সের শিশুদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ের অনুপাত কমছে না বাড়ছে। বাড়লে বুঝতে হবে পুত্র সন্তানের দিকে পক্ষপাতিত্ব কমার বদলে বেড়ে চলেছে, অতএব উদ্বেগের কারণ আছে।
সেনসাস-এর তথ্যের পরিধি বিপুল। যেমন, বিভিন্ন বয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে কত শতাংশ স্কুল-কলেজে যাচ্ছে, এই তথ্যও সেনসাস থেকে পাওয়া যায় এবং অন্য তথ্যসূত্রগুলির তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য, যদিও দশ বছরে এক বার পাওয়া যায় বলে স্বল্পকালীন পরিকল্পনায় তাকে তেমন কাজে লাগানো যায় না। নারী-পুরুষের মধ্যে কর্মনিযুক্তির হার থেকে শুরু করে কৃষিক্ষেত্রে কত জন নিজেকে খেত মজুর (ভূমিহীন) পরিচয় দিচ্ছেন আর কত জন নিজেকে কৃষক বলছেন, এ সবই জানা যায় সেনসাস থেকে। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিতে যুক্ত মানুষের সংখ্যা দ্রুত কমার কথা, কিন্তু ভারতে তা হয়েছে ধীর গতিতে। কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে এর পার্থক্যটিও কম নয়— সে কথাও জানা যায় সেনসাস থেকেই। তালিকা আর দীর্ঘ করব না। এক কথায়, দশ বছর অন্তর এই তথ্যাবলি থেকে দেশের প্রতিটি ক্ষুদ্রতম অঞ্চলেরও আর্থ-সামাজিক প্রগতির একটা দশক-ওয়ারি আন্দাজ মেলে, উন্নয়নে যার গুরুত্ব প্রশ্নাতীত।
রাজনৈতিক গুরুত্বের নিরিখেও সেনসাসের তথ্য সবার উপরে। নির্বাচন কেন্দ্রগুলি পুনর্বিন্যস্ত হয় সেনসাস তথ্যের ভিত্তিতে। ভারতের পুনর্বিন্যাস কমিশন এ কাজটি করে, যা নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। অতি সম্প্রতি জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য পুনর্বিন্যাস কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আঞ্চলিক দলগুলি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। কাশ্মীরে বিধানসভা আসন বেড়েছে একটি, আর হিন্দুপ্রধান জম্মুতে বেড়েছে ছ’টি। কাশ্মীর অংশে অনেকগুলি আঞ্চলিক দলের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি হলে শুধু জম্মুর আসন সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বিজেপির একক দল হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ল। জনবিন্যাসের কোন তথ্যের ভিত্তিতে কমিশন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল, সে প্রশ্ন উঠছে জোরদার।
এ বারের সেনসাস পুরোটাই ‘ডিজিটাল’ হওয়ার কথা। সেনসাসের ইতিহাসে এই প্রথম। গণনাকারীরা ফোন কিংবা ট্যাবলেটে সরাসরি তথ্য ঢুকিয়ে নেবেন, সেখান থেকেই ‘পোর্টাল’-এ চলে যাবে। এর ফলে এক দিকে যেমন খরচ কমবে, অন্য দিকে গণনা থেকে পরিসংখ্যান প্রকাশের মধ্যে সময়ের ব্যবধানও কমবে। তবে কি সরকার চাইছে না যে, ২০২৪-এর নির্বাচনের আগে সেনসাসের তথ্য জনপরিসরে এসে পড়ুক, আর সে কারণে তথ্য সংগ্রহের সময়টিকেই পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে? এমন অনুমানের কারণ আছে। ‘অনুপ্রবেশ’ কিংবা হিন্দু-মুসলমান নিয়ে অনেক অতিকথা এবং ভ্রান্ত তথ্য সমাজমাধ্যমে ঘুরপাক খেতে দেখি, যার কোনও তথ্যভিত্তি নেই। জনগণনা যথাযথ হলে এমন অনেক ভ্রান্তিরই নিরসন হতে পারে; অবশ্য তা হতে পারে তাঁদেরই মধ্যে, যাঁরা পরিসংখ্যানকে অন্ধবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে স্থান দেন। আশা করব অনুমানটি মিথ্যা প্রমাণিত করে সরকার এখনই সেনসাসের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দেবে।
সংখ্যা নিয়ে রাজনীতির ঘোলা জলে এ বার জনগণনার মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড যে ভাবে পাক খেয়ে চলেছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। উল্লেখ্য, ২০১৭-১৮ সালে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (এনএসএস) রিপোর্টকে চেপে দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন রিপোর্টটিকে ছাড়পত্র দিয়েছিল। কিন্তু সরকার সে রিপোর্ট প্রকাশ করতে দেয়নি। প্রতিবাদে কমিশনের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেন। তখনও পর্যন্ত কমিশন পরিসংখ্যান-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলির অভিভাবকত্বের ভূমিকা স্বাধীন ভাবে পালন করার চেষ্টা করত। একের পর এক স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে নড়বড়ে করে দেওয়ার সেই বিপজ্জনক প্রবণতায় আতঙ্কিত ১০৮ জন অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী এক যৌথ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। প্রতিবাদীদের যথারীতি পাত্তা দেয়নি সরকার। এ বার জনগণনার বিলম্ব নিয়ে অবশ্য এখনও তেমন সমবেত প্রতিবাদী কণ্ঠ শোনা যায়নি।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা