বুদ্ধিজীবী শব্দটির অর্থের অপকর্ষ ঘটেছে।
ইদানীং রাজ্যে প্রচারমাধ্যম জুড়ে থাকা খবরগুলির অধিকাংশই সরকারের বা সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে এবং দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে। পাশাপাশি আর একটা কথাও খুব শোনা যাচ্ছে, শহরের বিদ্বজ্জন বুদ্ধিজীবীরা নীরব কেন? এ কালে বুদ্ধিজীবী শব্দটির অর্থের অপকর্ষ ঘটেছে, যা কাম্য ছিল না। বুদ্ধিজীবী বলতে একটা কাল্পনিক বন্ধনী তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে আছেন শিল্পী সাহিত্যিক চলচ্চিত্রকার নাট্যব্যক্তিত্ব, অভিনেতা প্রমুখ। কলকাতার ইতিহাসে এই শ্রেণির মানুষের রাস্তায় নামার ঘটনা বার বার ঘটেছে— প্রথম ও দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট, কংগ্রেস বা বাম আমল, সব সময়েই। খাদ্য আন্দোলনের সমর্থনেই হোক বা বিজন সেতুতে গণহত্যার প্রতিবাদ বা হালের নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনে আমরা এ জাতীয় মিছিল দেখেছি। সে সব মিছিলে রাজনীতি থাকত, কোনও রাজনৈতিক পতাকা থাকত না। তৃণমূল সরকার আসার পর গত এগারো বছরে এ শহর সে রকম কোনও মিছিল দেখেনি। অতএব ঝড় উঠেছে কুকথার। বলা হচ্ছে, বুদ্ধিজীবীরা এখন রাজানুগ্রহ লাভে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ রাজপ্রসাদ লাভেচ্ছায় সব মেনে নিচ্ছেন, তবে সবাইকে এক দলে ফেলা ঠিক নয়।
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই। ১৮৫৭-র ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরে মঙ্গল পান্ডে শ্বেতাঙ্গ ‘প্রভু’দের উপর গুলি চালালেন, ৬ এপ্রিল ফাঁসি হল তাঁর। এ বারে আগুন জ্বলল অনেক দূরে, মিরাটে, শুরু হল সিপাহি বিদ্রোহ। সে যুগে রেডিয়ো ছিল না, খবরকাগজের প্রচারও ছিল সীমিত। কিন্তু এই বিদ্রোহের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। জার্মানিতে কার্ল মার্ক্স সাগ্রহে বিদ্রোহের গতিপ্রকৃতির উপর নজর রাখছিলেন, লিখছিলেন তা নিয়ে। ৩০ জুন, ১৮৫৭ নিউ ইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউন-এ লিখলেন, এই প্রথম ভারতবাসী সম্মিলিত ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডিজ়রেলি পার্লামেন্টে প্রশ্ন করেছিলেন, ভারতে যা হচ্ছে তা কি ‘মিউটিনি’, না জাতীয় বিপ্লব? তাঁর এই কথা উদ্ধৃত করে ২৮ জুলাই মার্ক্স লিখলেন, এ লড়াই নিছক সেনাবাহিনীর মিউটিনি নয়, এ এক বিদ্রোহ যা শুরু হয়েছে জাতীয় স্তরে। দেশের চিন্তানায়কেরাও চুপ ছিলেন না, পক্ষে-বিপক্ষে অনেকেই মুখ খুলেছেন। বিপক্ষের দল ছিল বেশ ভারী, তাঁদের মধ্যে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বর গুপ্ত, যদুনাথ সর্বাধিকারী, রজনীকান্ত গুপ্ত প্রমুখ। বিস্ময় জাগে, বিদ্যাসাগর এই বিদ্রোহ নিয়ে কোথাও কিছু লেখেননি। যে মানুষটি নিজের জীবন তুচ্ছ করে, সংস্কৃত কলেজের চাকরি হেলায় ছেড়ে তৎকালীন বাবু সমাজ ও পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে গিয়ে বিধবাবিবাহ আইন পাশ করিয়েছেন, এবং বহুবিবাহ রোধ আইন পাশের জন্য লড়ছেন, তিনি এ বিদ্রোহ সম্বন্ধে নীরব। বিদ্যাসাগর ব্রিটিশ শাসকের স্তাবক ছিলেন না, খেতাবের জন্য লালায়িত ছিলেন না। দেশাত্মবোধ তাঁর কিছু কম ছিল না, তা হলে তিনি চুপ থাকলেন কেন?
বিদ্যাসাগর আলোর পথযাত্রী, তাঁর সংগ্রাম ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তো বটেই, সব রকম অন্ধকারের বিরুদ্ধে। সিপাহি বিদ্রোহ শুরুর এবং তার অনেক পরেও দেশে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হয়নি। এই বিদ্রোহের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল ধর্মীয়, হয়তো সে কারণে বিদ্যাসাগর এ বিদ্রোহ সম্পর্কে নীরব ছিলেন। ভুললে চলবে না, এর ঠিক আগের বছর, ১৮৫৬-তে পাশ হয়েছে বিধবাবিবাহ বিল, দীর্ঘ লড়াইয়ের পর; এবং তা পাশ করেছে ব্রিটিশ সরকার। শুধু তা-ই নয়, কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহ রদের প্রস্তাব দিয়ে বিদ্যাসাগর ১৮৫৭ সালেই পিটিশন জমা দিয়েছেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। এত কিছুই যদি হয়ে থাকে, তবে বিদ্যাসাগর এই বিদ্রোহের বিরোধিতা করলেন না কেন? করেননি, কারণ তিনি ব্রিটিশের অত্যাচারের ব্যাপারে অবগত ছিলেন পুরো মাত্রায়। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, এত বড় সমাজসংস্কারকের পক্ষে নীরব থাকাটা কতটা যন্ত্রণার ছিল। তিনি ঠিক কাজ করেছিলেন না কি ভুল সে অন্য প্রশ্ন, অনেক ইতিহাসবিদও এই নীরবতার জন্য পরবর্তী কালে বিদ্যাসাগরের সমালোচনা করেছেন। সে বিতর্ক আজও চলছে।
একই ভাবে এই মুহূর্তের পশ্চিমবঙ্গে অনেকে অনেক কিছু দেখেও নীরব আছেন দেখে এমন মনে করার কারণ নেই যে, তাঁরা সব কিছুতেই চোখ বুজে আছেন বা সমর্থন করছেন। তাঁরা চুপ করে আছেন মূলত একটাই কারণে, তা হল বিজেপি নামক ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে লড়াই করার যে ভূমিকা তৃণমূল কংগ্রেস গ্রহণ করেছে তা সারা দেশে আর কোনও জাতীয় বা আঞ্চলিক দলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। আর এই ফ্যাসিস্ট শক্তিকে প্রতিহত না করতে পারলে ২০২৪-এর পর এ দেশে আর নির্বাচন হবে কি না সেটাই প্রশ্নের মুখে পড়ে যেতে পারে।
এটাও বলা দরকার যে, বুদ্ধিজীবী বা সাধারণ মানুষ কারও ধৈর্যই অপরিমিত নয়। রাজ্যের শাসক দল যদি অবিলম্বে তার দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা কর্মী আর ধামাধরাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ও কঠোর পদক্ষেপ না করে, তা হলে তারা প্রকারান্তরে ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থানে সহায়তাই করবে। ইতিহাস কিন্তু তাদের ক্ষমা করবে না।