পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের যাবতীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মুসলিম সমাজে স্ত্রী-সাক্ষরতার হার সবচেয়ে কম। ছবি: পিটিআই।
মিশরের কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে শতাধিক বছরের পুরনো এক মুসলিম তরুণীর মূর্তি রয়েছে, যে কি না তার হিজাবটিকে তুলে ধরছে। মূর্তিটি প্রতীকী। তার উপর চাপিয়ে দেওয়া পিতৃতান্ত্রিকতার মানসিক এবং অন্যান্য নিগড়গুলিকে ছিন্ন করে মেয়েটি যেন স্বাধীনতাকে আহ্বান করছে। প্রসঙ্গত, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রম-ইসলামীভবনের বিষয়টিও লক্ষণীয়। এ কথা মনে রেখে বলাই যেতে পারে, ইসলামের যাবতীয় রূপভেদ নির্বিশেষে হিজাব বিষয়টি বাধ্যতামূলক নয়। কায়রোর সেই মূর্তি, যা ইসলামের পুনর্জাগরণের কালে মেয়েদের কী করা উচিত জানাতে চেয়েছে, ভারতের ঘটমান বর্তমানকে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তার বিপরীত স্রোত বলা যেতে পারে। এ দেশে মুসলমান মেয়েরা আরও বেশি করে রক্ষণশীল পোশাককে আঁকড়ে ধরছেন, এমনকি সেই সব জায়গায় হিজাব বা বোরখা পরে হাজির হচ্ছেন, যেখানে সে সব পোশাক পরার কথাই নয়।
উদারপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সামাজিক প্রগতিবাদীরা বা মূলত মানবতাবাদীরা এই প্রবণতায় দুর্ভাবনাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন এই ভেবে যে, এর দ্বারা গণপরিসরে ধর্মীয় ভাবনার প্রদর্শন বেড়ে চলবে। তাঁরা এ কথা ভেবে আরও আতঙ্কিত হবেন যে, এই প্রবণতা কোনও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। কিন্তু তাঁদেরও স্বীকার করতে হবে যে, হিজাব একটি সম্প্রদায়ের আত্মপরিচয়ের অভিজ্ঞান হতেই পারে, যেমন শিখ পুরুষদের ক্ষেত্রে পাগড়ি। শিখদের পাগড়ি অথবা ভস্মের তিলক যদি স্কুল বা কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশাধিকার পেয়ে থাকে, তা হলে কেউ হিজাবকে নিষিদ্ধ করতে পারেন কি? এই প্রশ্নের উত্তর যদি নেতিবাচক হয়ে থাকে, তবে হিজাব ছাড়িয়ে বোরখার সমর্থনেও যুক্তি গড়িয়ে যেতে পারে।
কায়রোর সেই হিজাব তুলে ধরা সেই তরুণী-মূর্তি, যা মেয়েদের স্বাধীনতাকে আহ্বান করছে। ফাইল চিত্র।
এ এক গোলমেলে এবং একই সঙ্গে পিচ্ছিল পথ। কিন্তু কোনও কোনও সমাজ অন্যের চাইতে অধিকতর মাত্রায় তাত্ত্বিক। ভারতীয় সমাজ সেই তাত্ত্বিকতায় যেন দিন দিন বেশি করে দীক্ষিত হচ্ছে। ভারতের মতো এক নানা ভাষা, নানা ধর্মমতের দেশের পক্ষে কি তা মঙ্গলজনক? সম্ভবত নয়। এক কড়া ধাঁচের ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে কি এই সমস্যার সমাধান সম্ভব? এই প্রশ্নেরও উত্তর— সম্ভবত না। যদিও যাবতীয় ইউনিফর্ম (তা স্কুলের পোশাকই হোক বা সামরিক উর্দি) প্রবর্তনের উদ্দেশ্য বিভেদের যথাসম্ভব দূরীকরণ, তার মধ্যেও একটি নমনীয়তার অবকাশ থাকে— বিবিধ প্রকারের দাড়ি রাখার বিষয়টি নিয়েও কথা ওঠে। এই সমস্ত প্রশ্নের এক কথায় কোনও উত্তর হয় না বললেই চলে।
বর্তমান কলাম-লেখকের উদ্দেশ্য সেই সব বিষয়ে কলমচারণা নয়, যা অন্যেরা অনেক বেশি জ্ঞাত। বরং এই লেখা সেই বিতর্কের দিকেই নজর দিতে চায় যে, সমাজের চাহিদার তালিকায় নারীশিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের মতো বিষয় থাকবে কি না। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের যাবতীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মুসলিম সমাজে স্ত্রী-সাক্ষরতার হার সবচেয়ে কম। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও মুসলমান সমাজের অংশগ্রহণের মাত্রা তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে ন্যূনতম। এই পরিসংখ্যানে ইতিবাচক পরিবর্তন অবশ্যই ঘটছে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য বদল এখনও নজরে আসেনি। সুতরাং মুসলমান মহিলা এবং তরুণীদের মধ্যে যাঁরা স্কুল ও কলেজে পড়তে যেতে তীব্র ভাবে আগ্রহী, তাঁদের স্বাগত জানানো এবং উন্নততর জীবন যাপনের উপযুক্ত করে তোলার সুযোগ প্রদান সর্বাগ্রে প্রয়োজন। পোশাকের বিষয়ে কারও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে তর্ক-বিতর্কে কালহরণের কোনও মানে হয় না।
উন্নততর জীবন যাপনের উপযুক্ত করে তোলার সুযোগ প্রদান সর্বাগ্রে প্রয়োজন। পোশাকের বিষয়ে কারও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে তর্ক-বিতর্কে কালহরণের কোনও মানে হয় না। ছবি: পিটিআই।
এরই সংলগ্ন বিষয় হল, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি। কর্মনিযুক্তির নির্ধারিত বয়সের মধ্যে অবস্থানরত যাবতীয় সম্প্রদায়ের মহিলাদের মধ্যে যাঁরা কাজ করতে ইচ্ছুক, পরিসংখ্যান অনুযায়ী তাঁরা হলেন মোট জনসংখ্যার মেরেকেটে ৩০-২০ শতাংশ। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান ৮০ থেকে ৭৫ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান অবশ্য অতিমারি পর্বের আগেকার। গত দু’বছরে এই সংখ্যা নিম্নগামী হয়েছে। নারীদের মোট সংখ্যার অনুপাতে কর্মে আগ্রহী মুসলিম নারীদের সংখ্যা ২০ শতাংশেরও নীচে নেমে গিয়েছে। যদি শিক্ষাকে কর্মনিযুক্তি ও জীবনধারণের অভিমুখে ভাবা যায়, তবে মুসলমান মেয়েদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক, উভয় প্রকার ক্ষেত্রের প্রত্যক্ষ ও আনুষঙ্গিক সুবিধা লাভের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে তাঁদের সন্তান-ধারণের সংখ্যা কমাতে হবে, তাঁদের সমাজের প্রতি জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে সাধারণত যে কটাক্ষ ধাবিত হয়, তার বিরোধিতা করতে হবে।
পরিশেষে থেকে যায় দারিদ্রের প্রসঙ্গ। উদ্বৃত্ত শ্রমের এই দেশে একক ভাবে আয়কারী কোনও শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে দারিদ্ররেখার ঊর্ধে উঠে পরিবার প্রতিপালন দুরূহ। এবং কর্মনিযুক্তির পরিস্থিতি আগের চাইতেও অনিশ্চিত। এমতাবস্থায় মেয়েদের কর্মনিযুক্তি অনেক বেশি নিরাপত্তা নিয়ে আসতে পারে, সর্বোপরি অতিরিক্ত আয়কে নিশ্চিত করতে পারে। এমন নয় যে, এর ফলে নারী ও পুরুষের মধ্যে কর্মনিযুক্তি নিয়ে সঙ্ঘাতের পথ প্রশস্ত হবে। বহু নিয়োগ-নিবিড় ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে যে কোনও সম্প্রদায়ের নারীদের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ প্রস্তুত হতে পারে। এর মধ্যে দু’টি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল— পোশাক শিল্প এবং বৈদ্যুতিন শিল্পের সেই ক্ষেত্র, যেখানে যন্ত্রাংশ একত্রকরণের কাজ হয়। শিক্ষকতা এবং নার্সিংয়ের মতো নারী-শ্রম ভিত্তিক চিরাচরিত ক্ষেত্রগুলির বাইরে অবস্থান করছে এই সব এলাকা। এই ক্ষেত্রগুলিকে ব্যবহার করে কেরল নারীমুক্তির নতুন পথ দেখাতে পেরেছে। ইতিমধ্যে করা বেশ কিছু সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে, উপজাতীয়, মুসলমান এবং দলিতরাই এ দেশের দরিদ্র জনসংখ্যার সিংহভাগ অধিকার করে রয়েছেন। এই সব সম্প্রদায়ের মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার বিষয়টি যে সামাজিক কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক প্রগতির জন্য একান্ত প্রয়োজন, তা আলাদা করে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না।