মোটা মাইনের চাকুরেদের সাফল্য দিয়ে শ্রমিকের সাফল্যের সম্ভাবনাকে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে।
বিগত শতাব্দীর শেষে এবং নতুন শতকের গোড়ায়, ২০০০-২০০১ সাল নাগাদ উৎপাদিত দ্রব্যের সামগ্রিক রফতানির দিকে তাকালে বোঝা যায় তা পণ্য ও পরিষেবা— দুইয়ের সমাহার ছিল। এ ক্ষেত্রে পরিষেবার পরিমাণটি ছিল রফতানিকৃত দ্রব্যের অর্ধেক মাত্র। এক দশক পরে, ২০১০-২০১১ নাগাদ ভারতের সামগ্রিক রফতানি দ্রব্যের বৃহত্তম অংশ জুড়ে রয়েছে উৎপাদিত দ্রব্য। কিন্তু তার অভ্যন্তরীণ বিভাজনে খানিক পরিবর্তন এসেছে। গত আর্থিক বছরে, অর্থাৎ ২০২০-২০২১-এ পরিষেবা রফতানি (২০৬ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার) উৎপাদিত দ্রব্য রফতানির মোট পরিমাণের (২০৮ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার) প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে, যেখানে মোট রফতানির অর্থমূল্য ৪৯৮ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। দুই দশকের মধ্যে পরিষেবা রফতানি বৃদ্ধির বিষয়টি কিন্তু লক্ষণীয়।
যদি কেউ সামগ্রিক পরিমাণের দিকে না তাকিয়ে বৃদ্ধির দিকে নজর রাখেন, দেখতে পাবেন তার গতিপ্রকৃতি আরও দুর্বার। ২০২০-২০২১ নাগাদ পরিষেবা রফতানির বৃদ্ধি ছিল ৮১ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার, যা সেই সময়ে উৎপাদিত পণ্যের রফতানির (৩৭ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার) দ্বিগুণেরও বেশি। ভারতের পরিষেবা ও পণ্য রফতানির আনুপাতিক ফারাক বর্তমানে সেই ছবিটিকেই দেখায়, যা আমেরিকা এবং অন্যান্য উত্তর-শিল্পায়িত দেশের অর্থনীতির উৎপাদিত দ্রব্যের সঙ্গে চিন বা পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির উৎপাদিত দ্রব্যের অনুপাত। এমন অনুপাত কোনও বৈচিত্রময় ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির পক্ষে একান্ত লক্ষণীয়।
চলতি বছরে এই গতিপ্রকৃতি যেন উলটে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। পরিষেবার তুলনায় পণ্যের রফতানির গতিছন্দ দ্রুততর হয়েছে। সম্ভবত বর্ধিত মূল্যের পেট্রলজাত পণ্যের রফতানির কারণেই এমন ঘটেছে। এই পরিবর্তিত গতিছন্দ যে বজায় থাকবে, এমন আশা করা অনুচিত হবে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ভারতের প্রাথমিক সুবিধার জায়গাটি হল তার জনশক্তি ব্যবহারের অপেক্ষাকৃত কম খরচ। শিক্ষিত শ্রমশক্তি, বিশেষ করে সফটঅয়্যার পরিষেবা সংক্রান্ত রফতানির ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকার বিষয়টি মনে রাখা দরকার। সেই সঙ্গে চিপ উৎপাদনের থেকে চিপ ডিজাইন রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের স্থানটি যে বেশ পোক্ত, তা-ও মনে রাখা প্রয়োজন। পাশাপাশি, ওষুধ এবং বিশেষ রাসায়নিকের মতো মেধাভিত্তিক পণ্য রফতানির ক্ষেত্রেও ভারতের সাফল্য লক্ষণীয়। আর এই ধরনের রফতানিতে লাভের অঙ্কটিও মন্দ নয়।
পরিষেবার তুলনায় পণ্যের রফতানির গতিছন্দ দ্রুততর হয়েছে।
শ্রম-মূল্যের তুলনামূলক হিসেব থেকে বোঝা যায়, ভারতের এই সুবিধাজনক অবস্থানে কৃষিপণ্যের রফতানির গুরুত্বও বেড়েছে। কৃষিশ্রমিকের অস্বাভাবিক কম মজুরি এবং কৃষিক্ষেত্রে লাভের অঙ্ক কম থাকলেও বিষয়টি সত্য। এ সব মাথায় রেখেও এ কথা বলাই যায় যে, কৃষিপণ্যের রফতানিও (৬৮ শতাংশ) গত দশকে উৎপাদিত পণ্য রফতানির (২২ শতাংশ) তুলনায় দ্রুত গতিতে বেড়েছে।
এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি অনিবার্য, সেটি এই— পোশাক এবং জুতোর মতো (পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি প্রাথমিক ভাবে এই দু’টির রফতানিতেই সাফল্যের মুখ দেখেছিল) শ্রমনিবিড়, উচ্চ পরিমাণ অথচ কম লভ্যাংশের পণ্যের রফতানির ক্ষেত্রে কেন এই সস্তা শ্রমের বিষয়টি ভারতকে সাফল্য এনে দিল না। এর উত্তর খুবই সরল এবং সেটি হল— নীতিগত ব্যর্থতা। এই সব পণ্য উৎপাদনকারী ক্ষুদ্র শিল্পগুলির (আয়তনের কারণে উৎপাদনেও স্বল্পতা) প্রতি এক রকম প্রাথমিক অনীহা কাজ করেছে, কঠোর শ্রম আইন শ্রম-ক্ষেত্রগুলিকে অনমনীয় রেখেছে, পুঁজি-নিবিড় শিল্পগুলিতেই লভ্যাংশ থেকে শ্রমিকদের পাওনা আবদ্ধ থেকেছে। এই সব সমস্যার কয়েকটির দিকে নজর পড়লেও বেশির ভাগই নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টির বাইরে থেকে গেছে।
তা হলে কি শ্রম-নিবিড় উৎপাদনকে রফতানি-বাজারের উপযুক্ত করার সময় পার হয়ে গিয়েছে? না, উঁচু শ্রমমূল্য সত্ত্বেও চিন এখনও পর্যন্ত পোশাক রফতানিতে ভারতের থেকে এগিয়ে রয়েছে। ভারতের সামনে বাধা মূলত একটিই। সেটি হল ভারতীয় টাকার আন্তর্জাতিক বিনিময় মূল্য। ভারত যদি শুধুমাত্র পণ্যভিত্তিক বাণিজ্য করে, তা হলে ১৫০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের ঘাটতি (মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি-র ৫ শতাংশ) টাকার বিনিময়মূল্যের উপর চেপে বসবে। এর ফলে রফতানির বাজারে ভারতে উৎপাদিত পণ্য সস্তায় বিকোবে, আমদানিকৃত পণ্যের তুলনায় দেশজ উৎপাদন সস্তা হয়ে যাবে। কিন্তু মুদ্রার মূল্যমান-ঘটিত সংশোধন ক্রিয়াটি কখনওই ঘটে না। কারণ, পণ্যের বাণিজ্যে ঘাটতি অধিকাংশ সময়েই পরিষেবা-ঘটিত বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত আয়ের দ্বারা পুষিয়ে দেওয়া হয়। সোজা ভাষায় বললে, মোটা মাইনের চাকুরেদের সাফল্য দিয়ে শ্রমিকের সাফল্যের সম্ভাবনাকে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে।
সমস্যাটি অনুধাবন করে ভারত ‘রিজিওনাল কম্প্রিহেন্সিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ’ (১৫টি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের মধ্যেকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি)-এর মধ্যে প্রবেশের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। যাতে পরিষেবা-বাণিজ্যের বিনিময়ে পণ্যের বাণিজ্যে কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু এই দেশগুলির মধ্যে যেগুলি চিন বা অন্যান্যদের দ্বারা প্রভাবিত, তারা যে এতে সবিশেষ পাত্তা দিচ্ছে, এমন নয়। সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে যাচ্ছে। এ কথা সত্য যে, ভারত বহিরাগত পুঁজি প্রবেশের পথটিকে যত প্রশস্ত করছে, ততই জটিলতা বাড়ছে। এই পুঁজির প্রবেশ টাকার বিনিময় মূল্যে তার প্রভাব রাখছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুবিধা করে দিতে গিয়ে দেশের কর্মনিযুক্তির বাজার চাপে পড়ছে।
পড়ে-থাকা উদ্বৃত্ত ডলার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কিনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ এই ডলার তার দরকারই ছিল না। ফলে বৈদেশিক বিনিময়ের ভাঁড়ারে চাপ বাড়ছে। এমন কর্মকাণ্ডের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যার কারণে কম লভ্যাংশের উৎপাদিত পণ্যের রফতানির ক্ষেত্রে ভারতীয় টাকার মানকে মহার্ঘ বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে এখনও পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতায় পূর্ণ ভারতীয় পরিমণ্ডলে তা ভাল ভাবে অনুভূত হচ্ছে। এর মধ্যে একটিই স্বস্তির খবর, সাম্প্রতিক বাজেটে সরকার ঋণপত্রের (বন্ড) বাজারের দরজা আন্তর্জাতিক পুঁজির সামনে হাট করে খুলে রাখেনি। যদিও অনেকে তা চেয়েছিলেন। তেমন কিছু ঘটলে পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হয়ে দাঁড়াত।