কৌশল: আতিফ রশিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন মুসলমান নেতারা, দিল্লি, ৪ জুন। আতিফ রশিদের টুইটার ছবি
বিজেপির কোনও গুরুত্বপূর্ণ নেতা যদি খাস দিল্লিতে মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন, তা সংবাদমাধ্যমের নজর এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। আতিফ রশিদ তেমন পরিচিত বিজেপি নেতা নন। তাই জুন মাসের প্রথম শুক্রবার দিল্লিতে তিনি মুসলিমদের সঙ্গে বৈঠক করলেও কেউ তার খোঁজ রাখেনি। ওই বৈঠকে হাজির ‘পসমন্দা’ বা অনগ্রসর শ্রেণির মুসলমানদের রশিদ বুঝিয়েছিলেন, তাঁরা যদি বিজেপির থেকে দূরত্ব রেখে চলে, তাতে কোনও লাভ নেই। দেশের অধিকাংশ রাজ্যেই এখন বিজেপির সরকার। এই সব সরকারের সাহায্য নিয়ে বরঞ্চ পসমন্দা মুসলিমরা নিজেদের সমস্যার সমাধান খুঁজতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজে ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ। তাই অনগ্রসর মুসলিমদের যন্ত্রণা শুধু তিনিই বুঝবেন।
দিল্লির এই বৈঠকের এক মাসের মাথাতেই, জুলাইয়ের গোড়ায় হায়দরাবাদে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক বসেছিল। প্রধানমন্ত্রী মোদী সেখানে দলকে নির্দেশ দিয়েছেন, মুসলিমদের মধ্যে যাঁরা অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ, সেই পসমন্দাদের কাছে টানতে হবে। ফারসি ভাষায় পসমন্দার অর্থ, যাঁরা পিছনে পড়ে রয়েছেন বা অনগ্রসর। মুসলিমদের মধ্যে পসমন্দাদের সংখ্যা আনুমানিক ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ।
মোদী এখন নিজের মুখে বললেন বটে। আসলে অনেক আগে থেকেই বিজেপি এ কাজ শুরু করেছে। গোটা উত্তরপ্রদেশেই বিজেপির সংগঠন, সংখ্যালঘু মোর্চার নেতৃত্বে পসমন্দা মুসলিমদের তুলে আনা হয়েছে। বিজেপির আতিফ রশিদ তারই উদাহরণ। উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরের বাসিন্দা রশিদ জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন পরিষদের সদস্য। সর্বোপরি পসমন্দা মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি।
বিজেপি যে উত্তরপ্রদেশে এই পসমন্দা মুসলিম ভোটকে পাখির চোখ করেছিল, তা আগে অনেকেই টের পাননি। উত্তরপ্রদেশের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মুসলিম হলেও বিজেপি কোনও মুসলিমকে প্রার্থী করেনি। তাই বিজেপির কোনও মুসলিম বিধায়ক নেই। অথচ যোগী আদিত্যনাথ দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরেই মহসিন রাজাকে সরিয়ে দানিশ আনসারিকে বিধান পরিষদে জিতিয়ে এনে মন্ত্রী করা হয়েছে। মহসিন ছিলেন শিয়া মুসলিম। মুখতার আব্বাস নকভির মতোই। বিজেপি দীর্ঘ দিন শিয়াদের মন জয়ের চেষ্টা করছে। লাভ হয়নি। এ বার লক্ষ্য পসমন্দা। দানিশ আনসারি সেই সুন্নি ওবিসি বা পসমন্দা মুসলিমদের প্রতিনিধি।
যাঁরা ভাবেন, বিজেপি শুধু উগ্র হিন্দুত্বের ধুয়ো তুলে গোটা হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে পকেটে পুরে ফেলতে চায়, তাঁরা ভুল করেন। একই ভাবে যাঁরা ভাবেন, কোনও মুসলমানই বিজেপিকে ভোট দেয় না, তাঁরাও ভুল ভাবেন। স্থানীয় রাজনৈতিক সমীকরণ মেনে বিজেপি মুসলিমদের ৮-৯ শতাংশ ভোট পেয়ে থাকে। একটা সময়ে জাতপাত বা মণ্ডল রাজনীতির মোকাবিলায় বিজেপি হিন্দুত্বের জিগির তুলে কমণ্ডলুর রাজনীতি শুরু করেছিল। লক্ষ্য ছিল, হিন্দু ধর্মের জিগির তুলে জাতপাত নির্বিশেষে সব হিন্দুকে এক ছাতার তলায় আনা। এখন আর বিজেপি হিন্দু ভোট পেতে শুধু ধর্মের জিগির তুলে বসে থাকে না। দলিত, জনজাতি, ওবিসি, অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রেণির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আলাদা ভাবে মন জয়ের চেষ্টা করে। যেমন, উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে কেন্দ্রে একগুচ্ছ ওবিসি নেতাকে মন্ত্রী করা হল। জনজাতি মহিলা বলে দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি ভোটে প্রার্থী করা হল। উপরাষ্ট্রপতি ভোটে তুলে আনা হল জাঠ সমাজের জগদীপ ধনখড়কে। যিনি আবার রাজস্থানে জাঠদের জন্য ওবিসি তকমা আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদী নিজে ওবিসি। তাঁর বিরাট সাফল্য এই ওবিসি ভোটব্যাঙ্কের সিংহভাগকে করায়ত্ত করা। একই ভাবে বিজেপি মুসলিমদের মধ্যেও আলাদা ভাবে পসমন্দাদের মন জয় করার চেষ্টা করছে। এই ভোটব্যাঙ্কের কিছুটা পেলেও ২০২৪-এ জয় সুনিশ্চিত হওয়া তো বটেই, বিজেপির ভোটের হার ৫০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলতে পারে বলে বিজেপির অঙ্ক।
উত্তরপ্রদেশ-বিহারে ওবিসি ভোটকে নিজের পকেটে পুরে রাখা অখিলেশ যাদব, লালু প্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমার জাতিগণনার দাবি তুলেছেন। তাঁদের অঙ্ক, জাতগণনা হলে দেখা যাবে ওবিসি-দের হার দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। তখন ২৭ শতাংশের বদলে ওবিসিদের জন্য আরও বেশি সংরক্ষণের দাবি উঠবে। বিজেপি বিপাকে পড়বে। পসমন্দা মুসলিমরাও যদি জাতিগণনার দাবি এবং সংরক্ষণের দাবি তোলেন, তা মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের স্বঘোষিত ধারকবাহকরা সামলাতে পারবেন তো? ৮০-৮৫ শতাংশ মুসলিমই বিজেপির দিকে চলে গেলে ‘মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক’-এর অবশিষ্ট কী থাকবে?
কয়েকশো বিরাদরি বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত এ দেশের মুসলিম সমাজকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এক, উচ্চবর্ণ বা আশরফ মুসলিম। দুই, আজলফ বা অনগ্রসর মুসলিম এবং তিন, আরজ়ল বা দলিত মুসলিম। আশরফদের পূর্বপুরুষরা পশ্চিম বা মধ্য এশিয়া থেকে এ দেশে এসেছিলেন বলা হয়। যেমন সৈয়দ, শেখ, পঠান এবং এ দেশের মুসলিম রাজপুত, ত্যাগী মুসলিম, গউড় মুসলিম। এদের মধ্যে সৈয়দ বিরাদরি কার্যত হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণদের মতো। উল্টো দিকে আনসারি, কুরেশি, আলভি, সলমনি, হালালখোর, ঘোসি, সইফি, সিদ্দিকি, ইদ্রিসির মতো অনগ্রসর, দলিত ও জনজাতির মুসলিমরা আশরফদের বিরুদ্ধে সামাজিক অসাম্যের অভিযোগ তুলে এসেছেন। তাঁরাই ‘পসমন্দা’ মুসলিম হিসেবে এককাট্টা হয়ে আরও বেশি শিক্ষা-রোজগারের সুযোগ, রাজনৈতিক ক্ষমতা চাইছেন।
নরেন্দ্র মোদী মুসলিমদের মধ্যে এই বিভাজনেরই সুযোগ নিতে চান। চাইলেই সফল হবেন, এমনটা অবশ্যই নয়। কিন্তু বিজেপিকে তিনি এক নতুন রাজনৈতিক মোড়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এক দিকে লোকসভা বা রাজ্যসভায় বিজেপির এক জনও মুসলিম সাংসদ নেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় এক জনও মুসলিম নেই। অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রীর মুখে অনগ্রসর মুসলিমদের কাছে টানার বার্তা।
সাচার কমিশনের রিপোর্টের পরে ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া বাম সরকার অনগ্রসর মুসলিমদের ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় আনে। তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওবিসি তালিকায় মুসলিমদের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে যোগ করতে করতে সিংহভাগ মুসলিমকেই ওবিসি তালিকাভুক্ত করে ফেলেছেন। মণ্ডল কমিশন অ-হিন্দুদের মধ্যে কারা অনগ্রসর, তা চিহ্নিত করার সূত্র বাতলেছিল। সেই কারণেই মুসলিম দলিত, অনগ্রসর শ্রেণিও কেন্দ্র ও রাজ্যের ওবিসি তালিকায় জায়গা পেয়েছে। কিন্তু জাতিগণনার দাবি বরাবরই অনগ্রসর মুসলিমদের ভুলে থেকেছে। পিছিয়ে থাকার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নেই বোঝাতে স্লোগান উঠেছে, ‘দলিত, পিছড়া এক সমান, হিন্দু হো ইয়া মুসলমান’! লাভ হয়নি।
বিজেপির পক্ষে সুবিধা হল, কংগ্রেস বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি মুসলিম তোষণের রাজনীতি করলেও পসমন্দাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কাজে ব্যর্থ। একটি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৫২ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত লোকসভা ভোটে সাড়ে সাত হাজার সাংসদের মধ্যে মাত্র ৪০০ জন মুসলিম ছিলেন। তাঁদের মধ্যে পসমন্দা মুসলিম ছিলেন মাত্র ৬০ জন। বাকিরা উচ্চবর্ণের। উত্তরপ্রদেশের উদাহরণ তুললেই দেখা যায়, কংগ্রেস মহসিনা কিদোয়াই থেকে সলমন খুরশিদের মতো উচ্চবর্ণের মুসলিমদেরই গুরুত্ব দিয়েছে। মুলায়ম সিংহ যাদব বা মায়াবতীর সময়ও পসমন্দারা উপেক্ষিত থেকেছেন।
এক সময় সর্দার পটেল কংগ্রেসের উচ্চবর্ণের মুসলিম বা আশরফদের বিরোধিতা সত্ত্বেও পসমন্দাদের রাজনৈতিক পদে তুলে আনার চেষ্টা করেছিলেন। নরেন্দ্র মোদী সর্দারের জুতোতেই পা গলানোর চেষ্টা করছেন! সফল হবেন কি না, অন্য প্রশ্ন। তবে তাঁর চেষ্টাই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির ঘুম ছুটিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।