খুনের কারণ রাজনীতি না সম্পদ দখল, আলাদা করা মুশকিল
Rampurhat Violence

দীর্ঘলালিত হিংসার সংস্কৃতি

বলতে হয় ঘরে-বাইরে মহিলাদের হয়রানি ও নির্যাতনের কথাও, যা হিংসাকে ভারতের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ অংশ করে তুলেছে।

Advertisement

অশোক সরকার

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২২ ০৭:২১
Share:

রামপুরহাটে এক জন নির্বাচিত পঞ্চায়েত উপপ্রধানকে বোমার আঘাতে হত্যা করা হল; সেই রাতেই গ্রামের একটি বাড়িতে আগুন লাগল, আট জন দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারালেন। মাত্র ক’দিন আগে দু’টি জেলায় দু’জন নির্বাচিত পুরপ্রতিনিধি প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হয়ে গিয়েছেন। তার আগে ঘটে গিয়েছে আনিস খানের হত্যাকাণ্ড। পশ্চিমবঙ্গে ঠিক কত জন রাজনৈতিক হিংসায় আক্রান্ত, সে বিষয়ে যথাযথ তথ্য পাওয়া কঠিন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো রাজনৈতিক হিংসার তথ্য দেয় বটে, কিন্তু তা পুলিশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। ২০০৯, ২০১০, এবং ২০১১ সালে যথাক্রমে ৫০, ৩৮ এবং ৩৮টি রাজনৈতিক খুন নথিভুক্ত হয়েছিল, কিন্তু ২০১৪-র পর থেকে সে সংখ্যা নেমে এসেছে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র একটা করে রাজনৈতিক হত্যা হয়েছিল বলে জানিয়েছিল এ রাজ্যের পুলিশ! গড় সংখ্যা ধরলে, ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছর এই রাজ্যে কুড়ি-বাইশটি রাজনৈতিক খুন হয়ে থাকে।

Advertisement

তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক হত্যায় শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র, কেরল-সহ নানা রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসা হয়। সব রকম হত্যাকে এক সঙ্গে গুনলে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে উপর থেকে চার নম্বরে, কিন্তু রাজনৈতিক হত্যা পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি। গত কয়েক বছরে রাজ্যবাসীও ক্রমাগত প্রশ্ন করছেন— উত্তরপ্রদেশ, বিহারের ভোটেও যেখানে খুন, সম্পত্তি ধ্বংস, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, প্রার্থীদের মারধর, বিরোধী সমর্থকদের ঘরছাড়া করার ঘটনা অনেকটাই কমে এসেছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে কেন এখনও এ সব অবাধে ঘটে চলেছে?

তার একটা কারণ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার-সহ ভারতের নানা রাজ্যে হিংসা প্রধানত জাতি পরিচিতিকে কেন্দ্র করে ঘটে থাকে। দলিত ও আদিবাসীদের প্রতি উচ্চবর্ণের ক্রূর হিংসার কাহিনি বহু রাজ্যে প্রায় রোজকার খবর, হাথরসের গণধর্ষণ ও হত্যা যার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। তার সঙ্গে মনে রাখতে হবে কৃষিজমির বিধিব্যবস্থাও। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়সমেত বিস্তীর্ণ এলাকা জমিদারি ব্যবস্থার অন্তর্গত ছিল, এবং এখানেই গরিব কৃষকদের উপর অত্যাচার ছিল সবচেয়ে বেশি। স্বাধীনতার পরে জমিদারি লুপ্ত হওয়ার আইন হলেও, সামন্ততান্ত্রিক হিংসা এই অঞ্চলগুলিতেই এখনও সবচেয়ে বেশি। নকশাল-মাওবাদী হিংসাও এই এলাকাগুলিতেই বেশি হয়েছে।

Advertisement

হিংসার তৃতীয় সামাজিক ভিত্তি হল, উৎপাদনের উপর নিয়ন্ত্রণ। দেশের অর্থনীতির যে বিশাল অংশকে আমরা ‘অসংগঠিত’ ক্ষেত্র বলে থাকি তার একটা বড় অংশে বস্তুত বেআইনি, কিন্তু সুসংগঠিত এক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যা বলপ্রয়োগের দ্বারা নানা ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, পণ্য সরবরাহ বা পরিষেবার উপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখছে। এর মধ্যে রয়েছে জমি, বালি, চন্দন এবং অন্যান্য বহুমূল্য কাঠ, কয়লা, সেই সঙ্গে বিভিন্ন চোরাচালানের কারবার, ইমারতি দ্রব্য ও নির্মাণ, এমন নানা ক্ষেত্রে সংগঠিত অপরাধ চক্র, যাদের ‘মাফিয়া’ নামে ডাকা হয়। তার বাইরেও ইটভাটা, বাজি কারখানা-সহ বহু এমন উৎপাদন ব্যবস্থা রয়েছে, যা নিয়ত শোষণ-নিপীড়ন-ভীতিপ্রদর্শনের উপরেই দাঁড়িয়ে।

বলতে হয় ঘরে-বাইরে মহিলাদের হয়রানি ও নির্যাতনের কথাও, যা হিংসাকে ভারতের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ অংশ করে তুলেছে। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মেয়েদের উপর শুধু শারীরিক নির্যাতনের খবরই প্রায় ১১ লক্ষ।

এই চার ধরনের সামাজিক হিংসার দৈনন্দিন উপস্থিতি সমাজ-মানসে হিংসাকে ‘স্বাভাবিক’ করে তুলেছে। এই স্বাভাবিকতার মধ্যে এক ধরনের নৈতিকতাও খুঁজে পান বহু মানুষ, বিশেষত মেয়েদের প্রতি ও জাতি-হিংসার ক্ষেত্রে। তবে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার আরও একটি সামাজিক উৎস আছে। এখানে শ্রেণিসংগ্রামের মতাদর্শের আশ্রয়ে হিংসার রাজনীতির সামাজিক বিস্তার হয়েছে
দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে। ষাটের দশকে জমি দখলের আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে, নকশালবাড়ি আন্দোলনের হিংসাত্মক ‘বিপ্লবী’ রাজনীতি হয়ে, সিপিএম-এর এলাকা দখলের রাজনীতি পর্যন্ত রাজনৈতিক হিংসার ধারাবাহিকতায় কোনও ছেদ পড়েনি। শ্রেণিসংগ্রামের ধারণা দিয়ে জোতদারকে কোতল করা ‘নৈতিক’ বলে ব্যাখ্যা দেওয়া চলে, অন্য মতাদর্শের স্কুল শিক্ষক, ডাক্তার, বা অন্য দলের রাজনৈতিক কর্মীকে খুন করার ন্যায্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রতিহিংসার রাজনীতিও কিছু কম হয়নি— সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলের বিপুল কংগ্রেসি হিংসা ভোলার নয়। সম্প্রতি বিজেপির উত্থানের মধ্যেও একই বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে।

ষাট বছর ধরে রাজনৈতিক হিংসার এত দীর্ঘ উপস্থিতির ফলে, একটা সময়ে এসে হিংসা মতাদর্শ অতিক্রম করে সমাজে নিজেই নিজের জায়গা করে নিয়েছে। তৃণমূল আমলে শ্রেণিসংগ্রামের ধারণা তামাদি হলেও, এলাকা দখলের পরিচিত রাজনীতিটাই বহাল থাকল। পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক রাজনৈতিক হিংসার ধারাবাহিকতার পিছনে আছে একটা হিংস্র পার্টি-সমাজ যা মতাদর্শ, শ্রেণি, জাত, লিঙ্গ, ধর্ম, নির্বিশেষে কেবল রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কর্মসূচি অবলম্বন করে বেঁচে থাকছে। পাশাপাশি উৎপাদন-পরিষেবার সিংহভাগই পশ্চিমবঙ্গে আজ অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেখানে পার্টি-আশ্রিত মাফিয়ারাজ সক্রিয়। এলাকা দখলের রাজনীতি আর মাফিয়া অর্থনীতি ক্রমশ মিলেমিশে গিয়েছে। এলাকার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে খুন হল, না কি বালি-কয়লার মতো সম্পদের দখলের লড়াইতে খুন হল, আলাদা করা যাচ্ছে না।

এত ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক হিংসার সুবাদে গ্রামে গ্রামে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ছড়িয়েছে, যা আরও হিংসাকে সহজ এমনকি অনিবার্য করে তুলছে। অন্য দিকে পুলিশ আর নাগরিকের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক পৌঁছেছে একেবারে তলানিতে। রাজনৈতিক মেরুকরণের জন্য পুলিশকে এমনিতেই ক্ষমতাসীন ও বিপক্ষ দলের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলতে হয়। একটা ক্ষীণ ভদ্রলোক শ্রেণি বাদ দিলে, সমাজের অধিকাংশ যেখানে জীবিকার পরিসরে আর সামাজিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নেতা অথবা মাফিয়াদের উপর নির্ভরশীল, সেই সমাজের কোল থেকে হিংসা দমনের সহমত তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। ফলে পুলিশের পক্ষে লোক-দেখানো কিছু পদক্ষেপ ছাড়া খুব কিছু সম্ভব নয়। এই সুযোগে পুলিশের একাংশ হিংসার এই রাজনৈতিক সামাজিক প্রক্রিয়া ও তার কুশীলবদের সঙ্গে হাত মেলায়, স্বচ্ছন্দে হিংসার অংশীদার হয়ে যায়।

হিংসার জন্য পরিচিত বিহার-উত্তরপ্রদেশে জাতি-হিংসা, ভূমিব্যবস্থা-প্রসূত হিংসা ও মাফিয়ারাজ, সবই আছে। মাফিয়ারাও অনেকেই দলের মধ্যে শক্তিশালী। কিন্তু এরা জাতি-মাফিয়া, এবং রাজনৈতিক হিংসা সংগঠিত হয় মূলত এই মাফিয়া গ্যাং-এর মাধ্যমে, এবং প্রয়োজন অনুসারে। নির্বাচনে জাতি-সমীকরণ পাল্টে গেলে এদের ভাগ্য বদলে যায়। রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনও এত হিংস্র হয়ে ওঠেনি। তাই হিংসা দমন এবং আইনশৃঙ্খলার উন্নতি একটা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হতে পারে, এবং হয়েছেও। পশ্চিমবঙ্গে যে কোনও নির্বাচনকে ঘিরে যে পরিমাণ রাজনৈতিক হিংসা দেখা যাচ্ছে, তার তুলনা অন্য রাজ্যে নেই। ‘রাজনৈতিক হিংসা দমন করব’ এই নির্বাচনী স্লোগান গলায় নিতে পারবে, পশ্চিমবঙ্গে এমন কে আছে?

আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement