গ্রাফিক:- শৌভিক দেবনাথ।
রাজ্যের অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য গত ১১ মার্চ শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করেছেন। এই বাজেটের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা, সরকারের বিত্তীয় পরিস্থিতি এবং নীতির পর্যালোচনা আবশ্যক।
প্রথমে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা। মাথাপিছু আয়ের ক্রমানুসারে পশ্চিমবঙ্গ ১৯৮০ সালে ২৫টি রাজ্যের মধ্যে ৭ নম্বরে ছিল। ২০১৮-১৯ পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ছিল ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ২১ নম্বরে। ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা ছিল প্রগতিশীল মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুর সঙ্গে। এখন সেই তুলনা হয় অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, পঞ্জাব এবং রাজস্থানের সঙ্গে। আমার অনেক সময় মনে হয়, মরণের ওপারে গিয়ে কবিগুরু কি তাঁরই সুরে মা, মাটি, মানুষের পশ্চিমবঙ্গকে গাইতে শুনছেন, ‘পিছিয়ে পড়েছি আমি যাব যে, কী করে?’
পশ্চিমবঙ্গ সমুদ্রের উপকূলে। আমাদের রাজ্যের আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে ভুটান ও বাংলাদেশের সঙ্গে। এবং আমাদের রাজ্য উত্তরপূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার বা গেটওয়ে। পশ্চিমবঙ্গের শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে অদূর অতীতের একটা ঐতিহ্য আছে। তা ছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের সান্নিধ্যে রয়েছে অনেক খনিজ সামগ্রীর উৎস এবং ইস্পাত শিল্প। এতগুলি সুবিধা সত্ত্বেও আমরা শিল্পায়নে এত পিছিয়ে কেন? বাজেটে এর কোনও সদুত্তর নেই। নেই এর প্রতিকারের কোনও চেষ্টাও।
উপকূলবর্তী রাজ্য হয়েও পশ্চিমবঙ্গ শিল্পায়নে এত পিছিয়ে কেন? ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের জন্য সরকার আগের মতোই ধার করে মূলত চলতি বছরের কারেন্ট কনজামশনের উপর জোর দিয়েছে। ২০২১-এর মার্চ মাসের শেষে রাজ্যের দেনার ভার ছিল ৪,৮১,৯৯৯ কোটি টাকা। সেটা বেড়ে ২০২২-এর মার্চের শেষে হতে চলেছে ৫,২৮,৮৩৩ কোটি টাকা। এবং ২০২৩-এর মার্চের শেষে ৫,৮৬,৪৩৮ কোটি টাকা। রাজ্যের আয় বা গ্রস স্টেট ডমেস্টিক (জিএসডিপি)- এর অনুপাতে দেনার ভার সরকারের নিজের ফিসক্যাল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট-এ নির্ধারিত ২৫ শতাংশের অনেক বেশি। দেনার আধিক্যের জন্য পাঞ্জাবের মতো পশ্চিমবঙ্গের অনেকটা রাজস্ব চলে যায় সুদের ভার মেটাতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতিটি টাকার মধ্যে ৪৮ পয়সা আসে কেন্দ্রীয় সরকারের খাজনার অংশ এবং গ্রান্টস-ইন-এড থেকে, আরও ৩৩ পয়সা আসে ঋণ করে। এই অনুপাতগুলি চিন্তাজনক ভাবে বেশি— উদাহরণ স্বরূপ, মহারাষ্ট্রের প্রতিটি টাকার মধ্যে শুধু ২১ পয়সা আসে কেন্দ্রীয় সরকারের খাজনার অংশ এবং গ্রান্টস-ইন-এড থেকে, আরও ২৭ পয়সা আসে ঋণ করে।
খরচে, কোভিড অতিমারির জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিনিয়োগ বা ক্যাপিটাল আউটলেস-এর থেকে ভর্তুকি এবং অনুদানের উপর জোর দিয়েছিল। সাধারণ দরিদ্র মানুষের সাহায্য ছাড়া এর আর একটা যুক্তি ছিল ডিমান্ড স্টিমুলেশন বা চাহিদা বাড়ানো। অতিমারির প্রকোপ কমাতে, ২০২২-২৩-এর বাজেটে পুরো খরচে ভর্তুকির অনুপাত ২০২১-২২ (আরই)-এর ৭ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেটা পরিষ্কার নয় তা হচ্ছে যে, অজস্র জনকল্যাণমূলক প্রকল্প মা, মাটি, মানুষের সরকার চালু করেছিলেন তার কোন কোনটি বন্ধ করা হচ্ছে এবং কোন কোনটিতে কাটছাঁট করা হচ্ছে। ২০২১- ২২-এ ভর্তুকির খাতে বাজেট পেশ করার সময় খরচ দেখানো হয়েছিল ১০,৯৫৫ কোটি টাকা। এই রাশি আরই অর্থাৎ রিভাইজড এস্টিমেট-এ দাঁড়ায় ১৮,৭২০ কোটি টাকা। স্বচ্ছতার অভাবে ভয় ২০২২-২৩-এ ২০২১-২২-এর পুনরাবৃত্তির।
পশ্চিমবঙ্গের ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। ছবি পিটিআই।
সরকারের মূলধনী বিনিয়োগ বা ক্যাপিটাল আউটলে রাজ্যের উৎপাদনী শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভর্তুকির খাতে খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপিটাল আউটলেস ২০২১-২২-এর বিই-তে ৩২,৭৭৪ কোটি টাকা থেকে কমে আরই-তে ১৯,৩৫৫ কোটি টাকা দাঁড়ায়। ২০২১-২২-এ বিনিয়োগের পরিমাণ বিই থেকে আরই-তে বিশেষ ভাবে কমে ১২,৮১৮ কোটি টাকা থেকে ৮,২৪৫ কোটি টাকায় সোশ্যাল সার্ভিসেসের খাতে এবং ৬,১৮৩ কোটি টাকা থেকে ১,৭৪৪ কোটি টাকায় কৃষি, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং স্পেশাল আরএস প্রোগ্রামের খাতে। এত কম মূলধনী বিনিয়োগে সরকার নতুন প্রকল্প বাদ দিলেও যা আছে তার রক্ষাণাবেক্ষণ করতে পারবে কি না সন্দেহ হয়।
২০১২-১৩ থেকে ২০১৮-১৯-এর মধ্যে, ২০১৩-১৪ এবং ২০১৫-১৬ ছাড়া প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপি সমগ্র দেশের আয়ের থেকে কম বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছি এবং এটা খুবই উদ্বেগের কারণ। আমাদের উল্লসিত করতে মন্ত্রী মহোদয়া সুখবর দিয়েছেন যে, চাহিদা বাড়িয়ে অতিমারির পর অর্থনৈতিক পুনরুত্থানে এগিয়ে বাংলা! ২০২১-২২ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপি-র ১২.৮ শতাংশ বৃদ্ধির হার দেশের ৯.২ শতাংশের থেকে বেশ কিছুটা বেশি। যে হেতু আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি, সে হেতু আমাদের সারা দেশের থেকে বেশি হারে উন্নতি করতে হবে এবং ২০২১-২২-এ আমরা যেটা করলাম সেটা কী করে করলাম বুঝতে হবে। ২০২১-২২-এর সম্মন্ধে তিনটি মৌলিক প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। প্রথম, অন্য উন্নত দেশগুলির মতো পশ্চিমবঙ্গ চাহিদার অভাবে ভুগছে না কি উৎপাদন শক্তির অভাবে? দ্বিতীয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডিমান্ড স্টিমুলেশনের কতটা দেশের অন্যান্য রাজ্যকে লাভবান করে এবং কতটা পশ্চিমবঙ্গকে? তৃতীয়, শিল্পায়নের কোনও সঙ্কেত ছাড়া, আমাদের জিএসডিপি এত বেশি কী করে বাড়ছে?
দরিদ্রের এবং দুর্বলের হাতে সাহায্য তুলে দিলে চাহিদা বা এগ্রিগ্রেট ডিমান্ড বাড়ে। চাহিদা বাড়ানোর দরকার না থাকলেও সেই সাহায্য দেওয়া যুক্তিসম্মত। যখন সেই সাহায্য দেওয়া হয় দরিদ্র এবং দুর্বল ছাড়া অন্যদের রাজনৈতিক কারণে, তখন সমস্যা হয়। তখন তাকে বলা যায় ভোট কেনার ব্যবসা এবং প্রায়শই সেই ব্যবসা হয় সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামোগত উন্নয়নকে বিসর্জন দিয়ে। ভর্তুকি এবং অনুদান অপাত্রে না যাওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে স্বচ্ছতা— কারা কারা পাওয়ার যোগ্য তার তালিকা, কে কবে পেয়েছে এবং কে কবে পাবে তার তালিকা প্রকাশ করা।
সত্যি করে এগিয়ে বাংলার জন্য প্রয়োজন রাস্তাঘাট, জল সরবরাহ এবং নিকাশি ব্যবস্থা, সেচ ব্যবস্থা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ইত্যাদি পরিকাঠামোতে মূলধনী বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ ছাড়া দ্রুত শিল্পায়ন সম্ভব নয়। আর শিল্পায়ন ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মতো জনঘনত্বের রাজ্যে যথেষ্ট কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ভারতবর্ষের ৩৮২-র তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে আমরা ১,০৮২ জন বাস করি। ১৯৯০-এর প্রথমার্ধে, যখন বামফ্রন্ট সরকার নিউ ইকোনমিক পলিসি ঘোষণা করে, তখনই বিশ্বের এক খ্যাতনামা কনসাল্টিং সংস্থা শিল্পায়নের জন্য পরিকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা সরকার এবং অন্য সকলের নজরে এনেছিল। প্রায় তিরিশ বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু এখনও নির্বিঘ্নে এবং সুষ্ঠু ভাবে, প্রচুর সময় ব্যয় না করে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ কিংবা দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাতায়াতের ব্যবস্থা হল না। আমাদের উপকূলবর্তী রাজ্যে একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। শিল্পায়ন ও উন্নয়নের নীতি অনুসরণ না করে শুধু ভর্তুকি ও অনুদানের নীতিতে চললে এই সরকার ত্রাণের সরকারই থেকে যাবে। পরিত্রাণের সরকার হবে না। ভর্তুকি এবং অনুদানের রাজনীতিও বেশি দিন চলবে না। সরকারের রাজস্ব বাড়বে না। খরচ বাড়বে। পাওনাদারদের বকেয়া— যেমন কর্মচারীদের বেতন— বাড়বে, ফিসক্যাল ক্রাইসিস বা সঙ্কটের কারণে সরকার প্রতিশ্রুতির খেলাফ করবে। এই সঙ্কট আসার আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত নীতির পরিবর্তন করা, এবং দ্রুত শিল্পায়নের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গকে দেশের অন্য রাজ্যগুলির থেকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
(লেখক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিধায়ক)