Children Creche

লালন-পালনের পরিষেবা

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা থেকে কারখানার অস্থায়ী কর্মী, এমন মেয়ে নেই যাঁকে মা হওয়ার খেসারত (মাদারহুড পেনাল্টি) দিতে হয়নি।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৪ ০৭:৩৫
Share:

রোজ রাতে তিন-চার কিলো চাল-ডাল ভিজিয়ে রাখেন দেবযানী সর্দার। ভোর চারটেয় উঠে শিলে বাটেন। বাটা, ফেটানো শেষ করার পর মনে হয়, শরীরে কিছু নেই। তবু কাজ বাকি থাকে শালিকা-র (মগরাহাট ২, দক্ষিণ ২৪ পরগনা) এই বধূর— বড়ি তৈরি, রোদে শুকোনো, প্যাকেটে ভরা, বাজারে বিক্রি। এত খেটেও আয় মাসে হাজার-দেড় হাজার টাকা। খোঁটা শুনতে হয় বাড়িতে: সারা দিন কী করো? “আমি কি মাসে দশ-পনেরো হাজার টাকা রোজগার করতে পারি না?” ভিজে চোখে দপ করে জ্বলে ওঠে আগুন। “যদি সকালে বেরিয়ে যাই, সারা দিন খাটি, আমিও পারি। কিন্তু ছেলেমেয়েদের দেখবে কে?”

Advertisement

ছেলেমেয়ে হওয়ার আগে টিটাগড়ের মিনা খাতুন কাজ করতেন চটকলে। দৈনিক মজুরি চারশো টাকা। মা হওয়ার পর কাজ ছেড়েছেন। দশটা-ছ’টা ডিউটি করলে দুই সন্তানের কী হবে? এখন মিনা কাগজকুড়ানি। দিনে রোজগার দেড়শো টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা থেকে কারখানার অস্থায়ী কর্মী, এমন মেয়ে নেই যাঁকে মা হওয়ার খেসারত (মাদারহুড পেনাল্টি) দিতে হয়নি। যাঁরা চাকরি আঁকড়ে থাকেন, তাঁদের ভিতরে চলে জল আর আগুনের লড়াই— কিছু করে দেখানোর জ্বলন্ত জেদ, আর অপরাধবোধে গলে যাওয়া। যাঁরা সন্তানের মুখ চেয়ে সরে আসেন কাজ থেকে, তাঁদের গোপন অশ্রু দিয়ে লেখা হয় পরিসংখ্যান— দক্ষিণ আফ্রিকায় পঞ্চাশ শতাংশ মেয়ে রোজগেরে গিন্নি, ব্রাজ়িলে পঞ্চান্ন শতাংশ, চিনে একষট্টি শতাংশ, আর ভারতে মাত্র একুশ শতাংশ, বলছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার রিপোর্ট (২০১৯)।

Advertisement

অভাবের তাড়নায় যে মেয়েরা ঘরে বসে যা হোক কিছু কাজ করতে চান, তাঁদের শ্রমের পুরোদস্তুর সুবিধা তোলেন ব্যবসায়ীরা। শাড়িতে এমব্রয়ডারি, কাপড়ে জরি বা চুমকি বসানো, বিড়ি বাঁধা, পাট থেকে দড়ি বানানো, নানা শৌখিন হস্তশিল্প— মেয়েদের দিয়ে বিপুল পরিশ্রমের কাজ করানো হয় অবিশ্বাস্য কম মজুরিতে। অনেক ধরনের কাজ আসলে দক্ষ শ্রমিকের, এমনকি শিল্পীর— কিন্তু মেয়েরা মজুরি পান ঘণ্টা হিসাবে দেড় টাকা থেকে চার-পাঁচ টাকা। কোভিডের পরে মজুরি আরও কমছে। তেমনই, বাড়ির কাছাকাছি কাজ খোঁজেন বলে মেয়ে-খেতমজুরদের মজুরি পুরুষদের চেয়ে অনেক কম— বারুইপুরের পেয়ারা বাগানেছ’ঘণ্টা কাজ করে পুরুষ পায় ৫০০ টাকা, মেয়েরা ১৭০ টাকা।

এ ভাবে শিশুর পরিচর্যা-সহ সব ঘরের কাজ মেয়েদের উপরে চাপিয়ে পরিবারের পুরুষরা আসলে বাজারকে পথ করে দিচ্ছে নারী-নিষ্পেষণের। মাতৃত্ব যতই মহান হোক, গৃহবন্দিত্ব মেয়েদের দাসশ্রমিক করে রেখেছে।

অথচ, ভারতের আইনেই এর সমাধান রয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রকল্প তৈরি হয়েছে, বাজেটে বরাদ্দও আছে। সেই সমাধান, ক্রেশ। শিশু-পরিচর্যার প্রতিষ্ঠান। যেখানে ছ’বছর পর্যন্ত শিশুদের দিনে সাত-আট ঘণ্টা রাখা যাবে। শিশুরা তিন বার খাবার পাবে, প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা পাবে। আর মায়েরা নিশ্চিন্তে কাজে যাবেন, ন্যায্য মজুরির কাজ খুঁজে নেওয়ার স্বাধীনতা পাবেন।

‘আইন তো কতই আছে’ বলে একে উড়িয়ে দিতে চাইলে ভুল হবে। গত চার-পাঁচ বছরে ভারতের নানা রাজ্যে সরকার ক্রেশ চালু করেছে। সেগুলির পরিকল্পনায়, এবং ব্যয়ভার বহনের নকশায়, বেশ কিছুটা বৈচিত্র দেখা যায়। যেমন, কেন্দ্রের ‘পালনা স্কিম’ (২০২৩) এবং এনআরইজিএ-কে কাজে লাগাচ্ছে কর্নাটক সরকার। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে সাত ঘণ্টার ক্রেশ করে তুলেছে। পরিকাঠামোর খরচ রাজ্যের, ক্রেশ-কর্মীরা মজুরি পাচ্ছেন জব কার্ডে।

ভারতে প্রথম ‘ক্রেশ নীতি’ (২০২২) চালু করেছে হরিয়ানা। তারা কর্মক্ষেত্রে ক্রেশ তৈরি করছে। ক্রেশ-কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে হরিয়ানা কৌশল রোজগার নিগম, বেতন (কর্মী পনেরো হাজার টাকা এবং সহায়ক সাত হাজার টাকা) দিচ্ছে নারী ও শিশু কল্যাণ দফতর। রাজ্য সরকার ক্রেশগুলির সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করছে।

কেরলে আর একটা মডেল দেখা যাচ্ছে। সেখানে বণিকসভা সিআইআই-এর সঙ্গে যৌথ ভাবে রাজ্য সরকার চোদ্দোটি ক্রেশ চালাচ্ছে, কেরলে আগত পরিযায়ী শ্রমিকদের শিশুদের জন্য। কোচির পেরুমবাভুরে অনেকগুলি প্লাইউড কারখানা রয়েছে, যেখানে পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজ করেন। সেখানে একটি ক্রেশের ব্যয়ভার বহন করা হচ্ছে এ ভাবে— আসবাবপত্র, কর্মীদের বেতন দিচ্ছে সিআইআই; শিশুদের খাবারের টাকা দিচ্ছে প্লাইউড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন; ক্রেশ-কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে রাজ্য সরকার।

ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড এবং ছত্তীসগঢ়ের জনজাতি-প্রধান জেলাগুলিতে কয়েক হাজার ক্রেশ চলছে একটি অসরকারি সংস্থার পরিচালনা ও ব্যয়ে, স্থানীয় পঞ্চায়েতগুলি নানা ভাবে তাদের সহায়তা করছে। এ ছাড়াও ওড়িশা সরকার তিন বছরের কম শিশুদের জন্য ক্রেশ চালায়। কেওনঝড়ে ২০১৮ সাল থেকে কয়েকশো ক্রেশ চলছে, তাতে অপুষ্টি অনেক কমানো গিয়েছে। টাকা দিচ্ছে ‘ডিস্ট্রিক্ট মিনারেল ফাউন্ডেশন।’

আর পশ্চিমবঙ্গ? এ রাজ্যে সরকারি তরফে ক্রেশ চালানোর কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। ২০১৭ সালে মাতৃত্বের সুবিধা আইনে (১৯৬১) সংশোধনের ফলে যেখানে পঞ্চাশ জনের বেশি কাজ করেন, সে সব কর্মক্ষেত্রে ক্রেশ তৈরি বাধ্যতামূলক। পশ্চিমবঙ্গে এমন কর্মক্ষেত্রের (কারখানা থেকে কর্পোরেট দফতর, বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজ ধরলে) সংখ্যা হাজার পনেরো তো হবেই। অথচ, চা বাগানের বাইরে পনেরোটি ক্রেশও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ। পুর কর্তৃপক্ষ, পঞ্চায়েত বা জেলা প্রশাসনের দেওয়া জায়গায় কিছু ক্রেশ হয়তো ইতিউতি চলে, কিন্তু সাধারণত খরচ জোগায় অসরকারি সংস্থা।

তার মানে, কর্নাটক বা হরিয়ানার সরকার যেখানে ক্রেশকে ‘অত্যাবশ্যক জনপরিষেবা পরিকাঠামো’-র অংশ বলে দেখছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একে ঐচ্ছিক পরিষেবা ভাবছে। যদিও এ রাজ্যে প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে অন্তত এক জন অপুষ্টিতে ভোগে। এবং সরকারি সমীক্ষা (পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে, ২০১৯) অনুসারে, এ রাজ্যে মেয়েদের কর্মনিযুক্তির হার জাতীয় হারের তুলনায় কম।

সম্ভবত এমন একটা মনোভাব কাজ করছে যে, সরকার অঙ্গনওয়াড়ির খিচুড়ি দিচ্ছে, রেশনে চাল দিচ্ছে, মায়েদের অনুদান দিচ্ছে। আর কত পরিষেবা দেবে? এখানেই ফের চিন্তার দরকার। অনুদান নিঃসন্দেহে গরিব মেয়েকে সাহায্য করে, কিন্তু তাঁর রোজগারের জায়গা নিতে পারে না। ঘরেই কাজ করুক আর বাইরে, মায়ের কর্মব্যস্ততা— বিশেষত অল্প টাকার জন্য যখন তাঁকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়— সংসারের কাজের সময় খেয়ে নেয়। দিনে তিন বার শিশুকে বসিয়ে খাওয়ানোর সময় কর্মরত মায়ের থাকে না। মধ্যবিত্ত মা টাকা দিয়ে অন্য মেয়েকে নিযুক্ত করেন, সেই পরিচারিকার সন্তান ধুলোয় খেলে বেড়ায়। টাকার অভাবের চেয়ে বড়দের সময়ের অভাবে (টাইম পভার্টি) শিশুর খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়ার ক্ষতি হয়।

মায়ের হাতে টাকা, চাল ধরিয়ে দিয়ে যে শিশু-অপুষ্টি কমেনি, তা তো স্পষ্ট। বাড়েনি মেয়েদের কর্মসংযুক্তিও। তাই শিশুপুষ্টি, মেয়েদের রোজগারের জন্য নতুন করে চিন্তা করা দরকার। কর্নাটকের মতো পশ্চিমবঙ্গেও কেন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রকে সারা দিনের ক্রেশ করা হবে না? কেন হরিয়ানার মতো এ রাজ্যেও কর্মক্ষেত্রে ক্রেশ চালু হবে না? কেন কেরল, ওড়িশার মতো শ্রমজীবীর সন্তানের জন্য বিশেষ ক্রেশ চালু হবে না?

সর্বোপরি, কেন ক্রেশের জন্য বরাদ্দ কেন্দ্রের টাকা আজ পর্যন্ত দাবি করেনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার? কী দোষ করেছে আমাদের শিশুরা?

শিশু-পরিচর্যার পরিকাঠামো— ক্রেশ, অঙ্গনওয়াড়ি, স্কুল, হস্টেল— একবিংশ শতকে অত্যাবশ্যক পরিষেবা। এগুলি তৈরি না করে মেয়েদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেওয়া নাকের বদলে নরুন দেওয়ার শামিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement