গর্ব: অমর্ত্য সেনের সমর্থনে পথে নেমেছিলেন বাংলার বিশিষ্ট জনেরা। ২৭ ডিসেম্বর ২০২০।
আমি কখনও কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য হইনি। বামপন্থীরা যে সাম্য ও সর্বজনীনতার কথা বলেন, তার প্রতি চিরকাল আকর্ষণ বোধ করেছি। আবার, গোটা দুনিয়ার প্রগতিশীল চিন্তকরাও আমায় আকর্ষণ করেছেন— তাঁদের মধ্যে বাংলারও বেশ কয়েক জন মনীষী আছেন। আমার যুক্তি কোন পথে চলবে, আমি কী বলব, তার উপর যে কোনও ধরনের বাধানিষেধই আমার পক্ষে সহ্য করা মুশকিল। আমি জীবনে প্রথম ভোট দিতে গিয়েছিলাম মা-বাবার সঙ্গে। বাবা কেশবচন্দ্র বসু এক সময় কলকাতার মেয়র ছিলেন, কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য। আমি বাবার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। কিন্তু কংগ্রেসকে ভোট দিইনি। দিয়েছিলাম বামপন্থীদের।
২০০৯ সালে যখন মনমোহন সিংহ আমায় ভারতের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদে ডাকলেন, আমি তাঁকে বলেছিলাম যে, তিনি যে আলোকপ্রাপ্ত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ছবি নিজের মনের ভিতরে রাখেন, আমিও সেই ছবিই দেখি— কিন্তু, প্রতিটি প্রশ্নে দলের লাইন মেনে চলা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। ডক্টর সিংহ আমায় বললেন, তিনি শুধু এক জন উপদেষ্টাকে চান, যিনি সেরা আইডিয়াগুলোকে আলোচনায় নিয়ে আসবেন। যে তিন বছর আমি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কাজ করেছি, তার অভিজ্ঞতা দারুণ। দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা বা আত্মকেন্দ্রিক আমলারা কি ছিলেন না? ছিলেন। কিন্তু, নীতিনির্ধারকদের যে গোষ্ঠীর সঙ্গে আমি কাজ করেছি, তাঁরা অসাধারণ ছিলেন। কোনও সঙ্কীর্ণ পরিচিতির ভেদরেখা ছিল না— ধর্ম নয়, জাত নয়, ভাষা নয়— আমাদের চালনা করেছিল সম্মিলিত ভারতের ধারণা।
আমার সৌভাগ্য, এই গোটা সময়টা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছিলেন। রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ ছিল না। তাঁর চিন্তার কেন্দ্রে ছিল ভারত, আর ভারতীয় অর্থব্যবস্থা। সেই চিন্তা ফলপ্রসূ হয়েছিল, সন্দেহ নেই। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা অতি দ্রুত বেড়েছিল, ভারত গোটা দুনিয়ায় আলোচ্য হয়েছিল। একটা উন্নয়নশীল দেশ, তার যাবতীয় উদারনীতি— বাক্স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা— বজায় রেখে দুনিয়ার প্রায় সব দেশের চেয়ে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বজনের নজর কেড়েছিল।
শুরুতে এতগুলো ব্যক্তিগত কথা বললাম, কারণ গত কয়েক বছরে চার পাশে যা ঘটছে, তা দেখে অত্যন্ত দুঃখিত বোধ করছি। ২০১৬ সালের পর থেকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার যে নাটকীয় পতন হয়েছে— বৃদ্ধির হারের নিরিখে ভারত এখন দুনিয়ায় ১৬৪তম স্থানে— সে কথা বলছি না। সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাতের রাজনীতি, মুসলমান বা খ্রিস্টানদের মতো সংখ্যালঘুদের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ, যে ঘটনাগুলো দেশ জুড়ে ঘটছে, পশ্চিমবঙ্গেও কিছু কিছু ঘটতে আরম্ভ করেছে— আমি মূলত উদ্বিগ্ন, দুঃখিত তা নিয়েই। দিলীপ ঘোষের মতো রাজনীতিকরা যে ভাষায় কথা বলছেন— শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেই নয়, অমর্ত্য সেনের মতো সর্বজনশ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবীকে যে ভাষায় আক্রমণ করছেন— সেটা অতি দুর্ভাগ্যজনক। আমি কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতি দায়বদ্ধ নই। আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, এক-এক জন মানুষের এক-এক রকম রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকবে। কিন্তু যে দল মেরুকরণের রাজনীতি করে, ঘৃণা ছড়ায়, সঙ্কীর্ণতার কারবার করে, আমি কখনও সেই দলকে ভোট দেব না। কারণ, সেটা মানবধর্মের বিরোধী।
বাংলা বলতে আমরা যা বুঝি, এটা তারও বিরোধী। ভারতের সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞানকেন্দ্রিক ভাবনার জগতে বাংলা চিরকাল প্রথম সারিতে থেকেছে। সম্প্রতি গোপালকৃষ্ণ গাঁধী এক সংবাদপত্রে একটি নিবন্ধে ভারতের পাঠকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারতের প্রগতিবাদী ভাবনায় স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান কতখানি। ইতিহাস যে বাংলাকে ভারতের চিন্তা ও অনুভবের জগতে শিরোমণি করেছে, তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
দেশ আজ যে ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আছে, যে ভাবে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান হচ্ছে, বাক্স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, গণতান্ত্রিক অধিকার পদদলিত হচ্ছে— তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলার এক মস্ত ভূমিকা নেওয়ার আছে। এই নিবন্ধ লিখতে লিখতেই খবর পেলাম, কেরলের কয়েক জন তরুণী খ্রিস্টান ধর্মযাজিকা ইস্টার পালন করতে দিল্লি থেকে ওড়িশায় যাচ্ছিলেন— বজরং দলের বাহুবলীরা তাঁদের ঝাঁসি স্টেশনে জোর করে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিয়েছে, তাঁদের অপমান করেছে। কেরল এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু, এটা তো শুধু কেরলের ব্যাপার নয়; শুধু খ্রিস্টানদেরও ব্যাপার নয়। এই বাংলায় গড়ে উঠেছে রামকৃষ্ণ মিশন, মাদার টেরিজ়ার সিস্টার্স অব চ্যারিটি, বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠান, যাদের মূল মন্ত্রই হল উদারতা, উন্মুক্ততা এবং সহনশীলতা। বাংলাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে; স্পষ্ট বলতে হবে যে, এই রাজ্য কোনও ভাবেই এই অন্যায় শক্তিকে স্থান দেবে না।
সন্দেহ নেই, মাঝেমধ্যেই বিচ্যুতি ঘটেছে। নীতিগত ভুলও হয়েছে। কিন্তু মোটের উপর বাংলার প্রগতিশীল ট্র্যাডিশন বজায় থেকেছে— কংগ্রেস, বাম এবং তৃণমূল, সব রাজনৈতিক জমানাতেই। ২০১০ সালের ১৪ মে আমি দেশের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কলকাতায় এসেছিলাম— বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে একটা দীর্ঘ বৈঠক ছিল। আমরা রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছিলাম; সিনেমা আর বই নিয়েও। অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে তর্ক হয়েছিল। তিনি যে আর্থিক নীতির কথা বলছিলেন, তার অনেকগুলোর সঙ্গেই আমি একমত হইনি। কিন্তু, তাঁর ভদ্রতা ও আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম, এখনও মনে আছে। আমাদের তর্ক হয়েছিল আর্থিক নীতির প্রকরণ নিয়ে, তার অভীষ্ট নিয়ে নয়। তিনি নিজের গৌরববৃদ্ধি করতে উদ্গ্রীব ছিলেন না; কিছু সাঙাতকে পাইয়ে দিতেও নয়। বুদ্ধদেববাবু যখন মনমোহন সিংহের সম্বন্ধে অত্যন্ত ইতিবাচক ভঙ্গিতে কথা বললেন, আমি অবাক হইনি। বৈঠক সেরে দিল্লিতে ফিরলাম একটা আশাবাদ নিয়ে।
গত কয়েক বছরে ভারতীয় রাজনীতি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এবং, তা মূলত বন্ধুবান্ধব আর সাঙাতদের পাইয়ে দেওয়ার খেলায় পরিণত হয়েছে। অথচ, অর্থব্যবস্থা এখন যে গভীর বিপদের মধ্যে রয়েছে, এবং অতিমারি যে ভাবে ফের ফণা তুলছে, তাতে রাজনীতি ভুলে এখন এই সব সমস্যার দিকেই সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার কথা। এখানেই পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের এক বিশেষ গুরুত্ব আছে। তাঁরা এখন ভোট দিচ্ছেন। তাঁদের মনে রাখতে হবে যে, যথার্থ মূল্যবোধ রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁদেরই।
ভারতের অর্থব্যবস্থা এখন যতখানি খারাপ অবস্থায় আছে, কয়েক বছর আগে তা কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু, তাকেও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার চেয়ে বড় দুঃসংবাদ বিভিন্ন সূচকে আছে— দেখা যাচ্ছে, গরিব মানুষের দুর্দশার দিকে কেউ মনোযোগ দিচ্ছেন না। মনোযোগের কেন্দ্রে রয়েছে বড় কর্পোরেট সংস্থা— গরিবের জন্য বরাদ্দ শুধুই স্লোগান। ২০১৮ সালের পর থেকেই ভারতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেকারত্বের হার বাড়ছে। এখন তা ২৩.৭৫ শতাংশ। ১৯৯১ সাল থেকে পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখছি, এত বেশি বেকারত্ব ভারতে কখনও ছিল না। অপুষ্টি সংক্রান্ত পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। এনএফএইচএস-এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, যে ২২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে ১৬টিতে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশুর অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ভাবে অপুষ্টি বেড়ে যাওয়া অতি বিরল ঘটনা। এবং, আমরা যে গরিবদের অবহেলা করছি, এটা তার লক্ষণ।
এই অন্ধকারে দাঁড়িয়েও আমি আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। কলকাতা এবং বাংলার গ্রামাঞ্চলে থাকা আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, চার পাশে কী ঘটছে, সে বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সচেতন। এমনকি, বেশ বিশ্বাসী কিছু হিন্দু আত্মীয়ও আমায় বললেন, ধর্মের নামে আসলে সাঙাততন্ত্র চলছে— এটাকে তাঁরা সমর্থন করতে পারেন না। বাংলার বেশ কিছু শিল্পী, অভিনেতা এগিয়ে এসে ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে বার্তা দিচ্ছেন, ভিডিয়ো বানাচ্ছেন, এটাও দেখে ভাল লাগছে। আমেরিকায় হলিউডের বেশ কিছু অভিনেতা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়াছিলেন, এবং সেটা শেষ পর্যন্ত দেশটাকে রক্ষা করল— কলকাতার অভিনেতাদের ভিডিয়ো দেখে আমার এই কথাটা মনে পড়ল।
যারা ঘৃণা আর বিভাজনের রাজনীতি ছড়াচ্ছে, তাদের গলার জোর অনেক। কিন্তু, আমি বিশ্বাস করি, তারা সংখ্যায় কম। আমি এই লেখার পাঠকদের একটা কথাই মনে করিয়ে দিতে চাই— ভারত একটা যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একতা ও বিশ্বাসের মূল্যবোধকে অক্ষুণ্ণ রাখার যে লড়াই, বাংলাকে তার নেতৃত্ব দিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক সমৃদ্ধি কিন্তু এর উপরই নির্ভর করবে।
অর্থনীতি বিভাগ, কর্নেল ইউনিভার্সিটি