Bhupinder Singh

বিলুপ্ত শিল্পের মতো যে গান

ভূপিন্দর নিয়ে গেলেন আমাদের পরীক্ষার আগের সন্ধের শোনা পাশের বাড়ির রেডিয়ো চোয়ানো বিবিধভারতীর গানের কানের ভিতর দিয়ে মরমে ঢুকে আটকে যাওয়া।

Advertisement

যশোধরা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২২ ০৫:১২
Share:

ভূপিন্দর সিংহ (ছবি) চলে গেলেন, আর সঙ্গে নিয়ে গেলেন আমাদের সদ্যপাওয়া যৌবন, আমাদের রুখুশুখু তরুণ বয়স। আমাদের না-আঁচড়ানো, না-খোঁপা-করা খোলা চুল, বারান্দা দিয়ে ঝুঁকে বিকেল কাটানো, না পাওয়া ছেলেবন্ধুদের জন্য দীর্ঘশ্বাস। যারা তখনও ‘বিএফ’ অভিধাপ্রাপ্ত নয়।

Advertisement

ভূপিন্দর নিয়ে গেলেন আমাদের পরীক্ষার আগের সন্ধের শোনা পাশের বাড়ির রেডিয়ো চোয়ানো বিবিধভারতীর গানের কানের ভিতর দিয়ে মরমে ঢুকে আটকে যাওয়া। পর দিন পরীক্ষার হলেও পিছু-না-ছাড়া সুরের মায়াজাল। আমাদের চাকরি না পাওয়ার হতাশা। কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসার বুক দুরদুর। এমনকি প্রথম চাকরি পাওয়ার পরের সেই ঊর্ধ্বশ্বাস দিনকালের ভিতরে ভিতরে অতীত কুঁড়েমির দীর্ঘশ্বাসও। ঘুম ভেঙে আড়মোড়ার (‘আংরাইয়া’ তখন প্রথম শিখলাম) সকাল, গ্রীষ্মরাতের মতো আলস্য, হেমন্তের ‘বিমল কর’-মিঠে রোদ্দুর, শীতের কুয়াশার মতো ভাসা ভাসা ছায়া ছায়া প্রেম। ‘দিল ঢুন্ডতা হ্যায় ফির ওহি ফুরসতকে রাত-দিন’... যে গান বহু দিন আমার মতো আরও অনেকের ফোনের রিংটোন ছিল, যারা কর্মব্যস্ততা আর আলস্যের মধ্যে গসাগু-লসাগু কষতে কষতে একটা নির্ভার যৌবন হারিয়ে ভারী কর্মজীবনের তলায় গিয়ে পড়েছিলাম। যারা আজ পঞ্চাশোর্ধ্ব এবং স্মৃতিকাতর ।

ভূপিন্দর সিংহ চলে গেলেন। রেখে গেলেন ক্যাসেটে গান শোনা এক প্রজন্মের স্মৃতিকথা। ফিতে জড়িয়ে যেত সে সময়ে ক্যাসেটের। পেনসিল দিয়ে টাইট দিতে হত ক্যাসেটগুলোর বাদামিরঙা পাতলা টেপ। বুশ বা ফিলিপ্স ক্যাসেট প্লেয়ারের শোক উথলে উঠছে আমাদের। আমাদের মনে পড়ছে পায়ে পায়ে খুচরো পাথরের কুচির মতো ছড়িয়ে যাওয়া অসমাপ্ত প্রেমেদের। প্রান্তিক সম্পর্ক, না-বলা বাণী, অযৌন চোখে-চোখ রাখার আশ্লেষদের। মনে পড়ছে আমাদের প্রজন্মের নাসিরুদ্দিন শাহ পাগলামি, দীপ্তি নাভাল দীর্ঘশ্বাস ও স্মিতা পাটিল অবসেশন। ছলবলি রত্না পাঠকের কথা মনে পড়ছে অথবা চুলবুলি জারিনা ওয়াহাব। মনে পড়ছে অধুনালুপ্ত পূর্ণ সিনেমা বা প্রিয়া-উজ্জ্বলা সিনেমা। উজ্জ্বলার চানাচুর মনে পড়ছে, রাস্তার রোল কর্নার মনে পড়ছে। মনে পড়ছে অমল পালেকর। বিষণ্ণ বেগানা দেবদাস। একা একা মুম্বই শহরের পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানো বেকার যুবক অথবা সামান্য চাকরির কেরানি।প্রেমে হতাশ। জীবনে ক্ষতবিক্ষত। লড়াকু অথবা অসহায়। গুরু শার্ট বা বেলবটম প্যান্টস। উস্কোখুস্কো চুল, কোটরে বসা চোখ, বিষণ্ণ হাঁটাচলা। তীব্র সংক্ষোভে ঝুঁকে আসা পিঠ— “এক অকেলা ইস শহর মেঁ।”

Advertisement

সেই বুঁদ করে দেওয়া ভরাট কণ্ঠ। ঈষৎ আনুনাসিক্যভরা। দানাদার সুরেলা কণ্ঠ ভূপিন্দরের। অন্য রকম গানের রাজা। ছ’টি কি আটটি গান এমন ভাবে আমাদের মনকে অধিগ্রহণ করেছিল, যা অন্য যে কোনও গায়কের অজস্র গানের পাশে ভাস্বর। প্রতিটি গান মধ্যবিত্ত শিক্ষিত এক ভীরু, আলস্যময় কিন্তু স্বপ্নময় তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করত যেন। তাই সুরকার আর গীতিকারদের দুরন্ত মেলবন্ধনের সঙ্গে সঙ্গে এই অতুলনীয় কণ্ঠটিও প্রবল ভাবে আমার প্রজন্মকে অধিগ্রহণ করেছিল সত্তরের শেষ থেকে আশির দশক চুইয়ে নব্বই দশক অবধি। আমাদের একাকিত্বের প্রজন্মে, বন্ধুদের কাছে টানা আর দূরে ঠেলার প্রজন্মে, ভূপিন্দর যেন এক সাঙ্গীতিক ঈশ্বর।

হারিয়ে যাওয়া প্রেমের বিষাদে নাসিরের ঝুঁকে আসা পিঠ। রুখুদাড়ির নাসির— “করোগে ইয়াদ তো হর বাত ইয়াদ আয়েগি।” যে গানের শেষে আসে অমোঘ সেই স্তবকে, গলির মোড়ে একলা দরজাকে দু’টি অপেক্ষারত চোখের সঙ্গে তুলনা করা। তৃষিত চোখের মতো কারও জন্য উতলা হয়ে থাকা একটি খোলা দরজার অনুষঙ্গ এসে হানা দিল আমাদের সদ্য গজানো কবিজীবনেও। আমাদের কবিতাতেও ছাপ পড়ল তার। যেমন আমাদের অনেকের যৌথ স্মৃতির ভিতরে ঢুকে গেল ‘নাম গুম জায়েগা’ অথবা ‘বিতি না বিতায়ে রৈনা’। ‘কভি কিসিকো মুকম্মল জহাঁ নেহি মিলতা’-র একটা লাইন খচ করে ঢুকে গেল বুকের ভিতরে— বৃষ্টিভেজা দিনের ভিজে সোঁদা গন্ধের মতো মিলিয়ে রইল আমার সত্তাতেও— “জিসে ভি দেখিয়ে উয়ো আপনে আপ মে গুম হ্যায়, জুবাঁ মিলি হ্যায় মগর হামজুবাঁ নেহি মিলতা।” যাকে দেখো, সে নিজেই নিজের ভিতরে মূক হয়ে আছে/ কথা যদি বা পাই, কথা বলার লোক কোথায়?

বিলুপ্ত শিল্পের মতো এই সব গান। কেননা এই সব ‘ভদ্রলোক’ সংস্কৃতি মূল্যহীন আজ। গণবিচ্ছিন্ন এই সব পরিশীলনের একটা আবহমানতা নব্বই দশকের উদারীকরণের পর অর্থহীন। গালগল্পের মতোই। সব ক্ষেত্রে যেমন ঘোর পরিবর্তন ঘটে গেল, এই গানের ক্ষেত্রেও।

ভূপিন্দরের অন্য অনেক টান আমাদের কাছে। তাঁর বাঙালি গিন্নি মিতালি তাঁকে আমাদের আরও আপন করেছিলেন। গিটারিস্ট ভূপিন্দর আকাশবাণীতে কাজের সূত্রে মদনমোহনের চোখে পড়েছিলেন। তার পর এক বিরল যাত্রা তাঁর। এই সময়টাই হিন্দিতে একটা ঘরানার আধুনিক গানের জোয়ার আসছে, তৈরি হচ্ছে গজলের আলাদা শ্রোতা। তখনও আসেনি উদার অর্থনীতি— কিন্তু আর্ট ফিল্ম আর কমার্শিয়াল ফিল্মের দুটো পরিষ্কার বিভেদ রয়েছে। রয়েছে আলাদা শ্রোতা। এলিট বুর্জোয়া শ্রোতাদের জন্য আলাদা প্রডাক্ট হিসেবে এই সব গান উঠে এসেছিল। অনন্য মদনমোহন, অনন্য রাহুল দেব বর্মণের হাতে। গানের কথায় গুলজারের অমোঘ পদচারণা শুরু। আমরা যারা হিন্দি বুঝতাম না তারাও হিন্দি শিখছিলাম নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, শিমলার ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সেই সব দিনে। এই বাঙালিনির মনে মিলেমিশে গেল ভূপিন্দরের গান আর পাহাড়ের গায়ে চরতে থাকা গাভির মতো সাদা মেঘের দল, মিশে গেল পাখিদের উচ্চনাদী টিট্টি রব আর বেদনারঙিন অসহ্যতা। রেখে গেল এক সারা জীবনের গান-প্রীতি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement