আশির দশকের শুরুতে, দমদমে এইচএমভি-র স্টুডিয়োতে মুখোমুখি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। আরও উপস্থিত সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গৌরীপ্রসন্নকে দেখে উল্লসিত শক্তি বললেন, “তোমার ‘নাই আসি হেথা ফিরে’-র ‘হেথা’ শব্দটা আমায় একেবারে পেড়ে ফেলেছে গৌরীদা।” উত্তরে মৃদু হাসলেন গৌরীপ্রসন্ন। বললেন, “তোমরা তো আমায় কবি মনে করো না...”
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের শতবর্ষে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এই আক্ষেপ নিয়েই অসময়ে চলে গিয়েছিলেন বাংলা গানের ‘স্বর্ণযুগ’-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার— তাঁর কবিসত্তার যথেষ্ট স্বীকৃতির অভাব নিয়ে আক্ষেপ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে বলতেন, “গৌরী, তোমার কবি হতে কি কিছু বাকি আছে? কে তোমায় কবি ভাবল, তাতে কী যায় আসে!”
অন্য কথায় যাওয়ার আগে সেই ‘হেথা’ শব্দটায় ফিরে যাই এক বার। “আগামী পৃথিবী, কান পেতে তুমি শোনো— আমি যদি আর না-ই আসি হেথা ফিরে, তবু আমার গানের স্বরলিপি লেখা র’বে।” চলিত শব্দের প্রবাহের মধ্যে আলোকোজ্জ্বল দ্বীপের মতো জেগে থাকে ‘হেথা’ শব্দটি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো জানতেন, কী অমোঘ কাব্যিক সম্ভাবনা এমন আকস্মিক গুরুচণ্ডালির। ‘হেথা’ শব্দটা কি অকস্মাৎ মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের কথা— ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোন্খানে’? গৌরীপ্রসন্ন কি তারই অনুরণন ঘটাচ্ছেন, ‘হেথা’ না-ফেরার কথায়? ‘হেথা’-য় যে ‘নূতন খেলা’ আরম্ভ হয়েছে— আবার রবীন্দ্রনাথেই ফিরছি আমরা— পুরাতন যদি সেখান থেকে চলেও যায়, তবু তার গানের স্বরলিপি অনস্বীকার্যই।
তাঁর গান বিনোদনের বেড়া পার করে ঢুকে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঠ্যক্রমে। ‘মেঘ কালো, আঁধার কালো’ গানটির কথা বলছি। এ গানের সেই অমোঘ পঙ্ক্তির কাছে থমকে দাঁড়ায় আমার বিস্ময়— “যে কালিতে বিনোদিনী হারালো তার কুল/ তার চেয়েও কালো কন্যা তোমার মাথার চুল।” কী অনুভবে লিখেছেন এমন শব্দমালা! কাব্যের ধারা যেন বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, রবীন্দ্রনাথ হয়ে ঘর বাঁধল গৌরীপ্রসন্নের কলমে। বাংলা ভাষার কোন গভীর দোয়াতে ডুবিয়েছেন জীবনের কলম যে, এমন কলি জেগে ওঠে অক্ষরে!
কলেজপড়ুয়া গৌরীপ্রসন্নের কথায় সুর দিয়েছিলেন শচীন দেব বর্মন। পরবর্তী কালে গৌরীপ্রসন্ন অসংখ্য গান লিখেছেন তাঁর প্রিয় শচীনকত্তার জন্য। হ্যামলিনের বাঁশির মতো আজও আমাদের টানে এই জুটির সেই মায়াবী সৃষ্টি— ‘ডাকাতিয়া বাঁশি’। মনে হয়, এ-গানে গৌরীপ্রসন্ন কথা এঁকেছেন এক পরম মায়ায়। “শ্রবণে বিষ ঢালে শুধু বাঁশি/ পোড়ায় প্রাণ গরলে/ ঘুচাব তার নষ্টামি আজ আমি/ সঁপিব তায় অনলে।” মনে হয়, গ্রামবাংলার একান্ত আপন কীর্তনের রসে সিক্ত হয়ে আছেন এই দুই স্রষ্টা। কৃষ্ণ আর রাধার মতো যেন প্রেমে ডুবে আছে এই গানের সুর আর কথা।
এমনই এক স্বর্গীয় বন্ধনে বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছে গৌরীপ্রসন্ন এবং নচিকেতা ঘোষের জুটি। কত কত অবিস্মরণীয় গান, কত কত গান হয়ে ওঠার গল্প। ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই’, ‘ওগো সুন্দর জানো নাকি’, ‘সূর্য ডোবার পালা’, ‘মৌ বনে আজ মৌ জমেছে’, ‘মানুষ খুন হলে পরে’, ‘লাল নীল সবুজেরই মেলা বসেছে’, ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতি’। কী ভাবে তৈরি হয়ে ওঠে একটা গান, তার মোক্ষম উদাহরণ আমার গানের স্বরলিপি। গৌরীপ্রসন্ন কথা লিখে দেওয়ার পর তাতে সুরারোপ করেছিলেন নচিকেতা ঘোষ। লেখাটির গায়ে একটা সুরের ইঙ্গিত অবশ্যই ছিল। তা খুবই বিমূর্ত। সঙ্গীতকার নচিকেতা ঘোষ লেখার ভিতরে সেই বিমূর্ত সুরের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন। কড়ি-কোমলের চড়াই-উতরাইয়ে আকস্মিক ও অনবদ্য সব সুর সংযোজনা করে নচিকেতা ঘোষ তাতে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। ধাপে ধাপে গান এগিয়ে গিয়েছে বিস্ময়ের কিনারা ছুঁয়ে। গৌরীপ্রসন্ন নিজেই আসলে সেই সব অদৃশ্য স্বরলিপি লেখার ভিতরে স্থাপন করে গিয়েছেন। ঠিক যে রকম জার্মান কবি গোয়টের কবিতায় সুরের ইঙ্গিত টের পেয়েছিলেন ফ্রানজ় শুবার্ট। বা আর এক জার্মান কবি শিলারের কাব্যগীতিতে সঙ্গীত সংযোজন করেছিলেন বেঠোফেন, তাঁর ‘নাইন্থ সিম্ফনি’র শেষ অংশে।
এক-এক সুরকারের এক-এক চলন। সব সুরকারের সুরেই সমান সাবলীল গৌরীপ্রসন্ন। তাই হয়তো তিনিই হয়ে উঠেছেন সুরকারদের প্রথম পছন্দ। শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, অনিল বাগচি, নচিকেতা ঘোষ ও তাঁর পুত্র সুপর্ণকান্তি— সব প্রজন্মের সুরকারই মুগ্ধ ছিলেন গৌরীপ্রসন্নে। সুরকারদের নিজস্ব মেজাজ, সেই বিশেষ গানটির মেজাজ, সুরের গল্পের সঙ্গে কথার গল্প জড়িয়ে ফেলায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। পরিচালকেরাও পেতে চাইতেন তাঁর কলমের কেরামতি। শোনা যায়, নিশিপদ্ম ছবিটিতে পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় গল্প পরিবর্তন করেছিলেন শুধুমাত্র ‘না না না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’ গানটির জন্য।
সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছবিটির কথা ভাবুন। অনিল বাগচির সুরে কথা লিখলেন গৌরীপ্রসন্ন— এমন এক জন মানুষের মুখে, যিনি বাঙালি নন, বাঙালি হয়ে উঠছেন, ভাষা শিখছেন তৎসম শব্দের সূত্র ধরে। সেখানে দাঁড়িয়ে গৌরীপ্রসন্ন যেন নিজেই জাতিস্মর হয়ে উঠছেন। মান্না দে’র কণ্ঠে ফুটে উঠছে সেই চিরন্তন প্রেম-ভাষা: “মম সরসীতে তব উজল প্রভা বিম্বিত যেন লাজে।” আমি যেন গীতগোবিন্দ-র ভাষা খুঁজে পাচ্ছি। অ্যান্টনি সাহেব যেন গৌরীয় কাব্যগীতিতে হয়ে উঠছেন প্রেমিক জয়দেব! অন্য দিকে, মৃণাল সেনের নীল আকাশের নীচে ছবিতে একই নামাঙ্কিত গানটি লিখেছেন গৌরীপ্রসন্ন। সুরকার ও গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।এ গান শুনলে মনে হয়, কান্না নিজেই যেন এক প্রবহমান নদী, যার কোনও শেষ নেই। এ গানে বারে বারে ফিরে এক প্রশ্ন— ‘তুমি দেখেছ কি?’ ‘তুমি শুনেছ কি?’ এ-গান শুধু আর গান হয়ে থাকে না, হয়ে ওঠে না-বলা প্রান্তিক জীবনের দলিল।
এর পাশাপাশি, লুকোচুরি ছবির ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ গানটির কথা ভাবুন। শোনা যায়, কিশোর কুমারের অনুরোধে ড্যানি কায়ে-র ‘ওহ বাই জিঙ্গো’ গানটিকে বাংলা রূপ দেন গৌরীপ্রসন্ন। পাঠক, আমি অনুরোধ করব, এক বার এ দু’টি গান পাশাপাশি শুনুন— বুঝতে পারবেন, কী অসাধ্যসাধন করেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। আমার তো মনে হয়, এই গান উৎসর্গ করা হয়েছে সুকুমার রায়কে। এবং, একমাত্র সুকুমার রায় ছাড়া এ-গান শুধু গৌরীপ্রসন্নই লিখতে পারেন। আবার তিনিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আবহে লিখেছিলেন, “শোনো, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি।” এই গান স্লোগান হয়ে আলোড়ন তুলেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর উৎসাহে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয় গৌরীপ্রসন্নকে।
সুরকার অনুপম ঘটকের সুরে তিনি লিখেছিলেন, ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’। মনে হয়, যেন কোনও বিদেশি অপেরায় কণ্ঠ ডুবিয়ে দিচ্ছেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তৈরি হচ্ছে অসামান্য এক কাব্যগীতি। আবার, যে গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাঙালি শ্রোতার মনে গীতা দত্তের আসনটি অক্ষয় করে দিলেন, সেই ‘তুমি যে আমার’ গানটির গীতিকারও গৌরীপ্রসন্ন। মৃণাল সেনের রাত ভোর সিনেমায় সলিল চৌধুরীর সুরে সব ক’টি গানই লিখেছেন গৌরীপ্রসন্ন। এর মধ্যে শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে ‘ও মাঝি রে’ গানটি বুঝিয়ে দেয়, সলিল চৌধুরীর মতো এক জন শক্তিশালী কবি কেন এত বিশ্বাস করতেন গৌরীপ্রসন্নের কলমের শক্তিকে। মৃণাল সেন বলেছিলেন, “সলিল তো তখন নিজেই অসাধারণ গান লিখছে। তবু সলিলই জোর করেছিল গৌরীপ্রসন্নকে নিতে, গান লিখবার জন্য।” কলম চিনতে ভুল হয়নি সলিল চৌধুরীর।
বাংলা ও ইংরেজি, দুই ভাষায় স্নাতকোত্তর, মেঘদূত-এর ইংরেজি অনুবাদ করা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তাঁর অনতিদীর্ঘায়ু জীবনটিকে উৎসর্গ করেছিলেন বাংলা আধুনিক গানের জন্য। তাঁর লেখা অজস্র গানের কলি এখনও গুনগুন করে বাঙালি। তবু মাঝেমধ্যে সংশয় হয়, যে সম্মান প্রাপ্য ছিল তাঁর, আমরা দিতে পেরেছি কি? চিনতে পেরেছি কি তাঁর ‘কবি মন’টিকে?