মুখে আমরা যতই বলি না কেন আইন-আদালত-সংবিধান, মনে মনে আমরা ভালই জানি এ সবের সীমাবদ্ধতা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বাঙালি কি রেউড়ি চেনে? দিল্লির ইস্কুল পাড়ায় ঠেলাগাড়িতে বিক্রি হয়। তিল মাখানো লজেন্স বললে ভুল হয় না। বাচ্চাদের প্রিয়। নাড়ুর মতো নরম নয়। চিবোতে হয় কড়মড় করে। বিভিন্ন রাজ্যের সরকার যে সব ছেলে-ভোলানো স্কিমের সাহায্যে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করে, শুনলাম প্রধানমন্ত্রী তাদের নাম দিয়েছেন রেউড়ি। ভোটারদের বলেছেন, ‘রেউড়ি কালচার’ হইতে সাবধান। তিনি নিজে লাড্ডুর ব্যাপারি। আমাদের দু’হাতে দুটো লাড্ডু ধরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর কাছে রেউড়ি বিদ্রুপেরই বিষয়।
অন্য দিকে তিনি জানেন, রেউড়ি কালচারের বিপদও কম নয়। এই কালচারই নাকি ডুবিয়েছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। অমর্ত্য সেনের লেখায় শ্রীলঙ্কার সামাজিক নীতির প্রশংসা দেখা যায় কেন? বিজেপি বলেছে, জবাব চাই জবাব দাও। কয়েক জন উদ্বিগ্ন আমলা সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন, রেউড়ি বিতরণ নিষিদ্ধ করতে। কোনটা রেউড়ি, কোনটা লাড্ডু, তা নিশ্চয়ই ‘ফেক নিউজ়’-এর মতো কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োজিত কোনও নিরপেক্ষ সংস্থা ঠিক করে দেবে। আমলারা একটু চিন্তায় আছেন কারণ, পুলিশ প্রশাসনের এখন দুই হাতেই লাড্ডু। তারই প্রমাণ পাওয়া গেল ইউপির নামকরা দুষ্কৃতী আতিক আহমেদের হত্যাকাণ্ডে। তারা চাইছেন না, এই অবস্থায় কোনও পরিবর্তন আসুক।
আতিক আর তার ভাই দু’জনেই ছিল জেলবন্দি। পুলিশ তাদের বেঁধে-ছেঁদে নিয়ে এল স্বাস্থ্যপরীক্ষার জন্য। ছবিতে আমরা দেখলাম, হাসপাতাল চত্বরে পুলিশ তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে। তারই মাঝে হঠাৎ তিন জন আততায়ী পিস্তল বার করে তাদের গুলি করে মারে। সাধারণত এ ধরনের আক্রমণে পুলিশ বাধা দিতে না পারলেও আততায়ীদের লক্ষ্য করে তৎক্ষণাৎ গুলি চালায়। এই ঘটনায় কিন্তু তা দেখা গেল না। পরে জানা যায় পিস্তলগুলি ‘ইমপোর্টেড’। লাখ লাখ টাকা দাম। প্রশ্ন ওঠে, এই হত্যায় কি পুলিশ প্রশাসনের সায় ছিল? সায় যে ছিল না, তা কিন্তু জোর গলায় কেউ বলেননি। সরকারি ভাবে বলা হয়েছে, হত্যাকারীরা সাংবাদিক সেজে এসেছিল। সংবাদমাধ্যমকে ইদানীং প্রশাসনের এত কাছে আসতে দেখা যায়নি।
এই ঘটনায় কি প্রশাসনের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে? একেবারেই নয়। সবাই জানে আতিকরা তৈরি হয় অপরাধ জগৎ আর রাজনীতিকদের যোগসাজশ বা আঁতাঁতে। প্রশাসন বহু চেষ্টা করেছে এই আঁতাঁত ভাঙতে। এনএন ভোরা কমিটি তো এই বিষয়ে একটা গোটা রিপোর্ট তৈরি করেছিল। সরকার পদক্ষেপ না-করলে কী করা যাবে? কিন্তু আঁতাঁত যদি না-ও ভাঙা যায়, দুষ্কৃতীদের কি আইনি উপায়ে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া যায় না? সে ক্ষেত্রে অসুবিধা হল, দুর্ধর্ষ গুন্ডাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে মানুষ এগিয়ে আসে না। এক দিকে দুষ্ট রাজনীতিবিদ, অন্য দিকে অসহায় মানুষ। মাঝখানে প্রশাসনের খুব একটা কিছু করার থাকে না। তার চেয়ে মাঝে মধ্যে প্রকাশ্যে ‘ঠোক দিয়া’ করতে পারলে ক্রাইমও কমে আর মানুষও ভরসা পায়। একেই বলে ‘দোনো হাথ মে লাড্ডু’।
এই খেলার একমাত্র উদ্দেশ্য যে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, তা নয়। এর মধ্যেও রাজনীতি আছে। মহিলারা যেমন ফরসা হলে ভাল, পুরুষদের হওয়া উচিত শক্তিধর। যে মুখ্যমন্ত্রীর রাজত্বে ১৮৩টা ‘এনকাউন্টার’ হয়, অপরাধীদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, তিনি ভোটটাও বেশি পান। প্রকাশ সিংহ ছিলেন বিএসএফের ডিজি। অবসর নেওয়ার পরে তিনি দীর্ঘ দিন সুপ্রিম কোর্টে মামলা চালান পুলিশকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে। সুপ্রিম কোর্ট একগুচ্ছ নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশ মানা হচ্ছে কি না তা দেখার ব্যবস্থাও করা হয়। এক যুগ পরে দেখা যাচ্ছে কিছু নির্দেশ কার্যকরী হলেও কাজের কাজ খুব একটা হয়নি। ইউপির ঘটনার পরে প্রকাশ সিংহ সংবাদমাধ্যমে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানান। তিনিও সেই আঁতাঁতের দোহাই দিয়ে বলেন, আতিক আহমেদের মতো দাগি অপরাধীদের এ ভাবেই মারতে হয়। প্রকাশ যদি এ কথা বলেন, তা হলে তো মেনে নিতে হয় ‘বুলডোজার বাবা’ই ঠিক।
মুখে আমরা যতই বলি না কেন আইন-আদালত-সংবিধান, মনে মনে আমরা ভালই জানি এ সবের সীমাবদ্ধতা। আমরা জানি, সংবিধানকে পিছনে ফেলেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে অমৃতের সন্ধানে। ২১ এপ্রিল ছিল ‘সিভিল সার্ভিস দিবস’। এই একটা দিন অনুমতি আছে সর্দার পটেলকে স্মরণ করার। পটেলের মূর্তির যথার্থ নাম হয়েছে। ‘স্ট্যাচু অফ ইউনিটি’। ভারত নির্মাণে তাঁর অবদান সর্বজনস্বীকৃত। তিনি ভারতের সিভিল সার্ভিসের জনক বলেও পরিচিত। তিনি বলেছিলেন, এ দেশ থাকবে না। টুকরো টুকরো হয়ে যাবে যদি আমরা প্রশাসকদের নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা না দিই। বর্তমান ভারতে আমরা কি নির্ভীক স্পষ্টবাদী নিরপেক্ষ প্রশাসক পেয়েছি? স্বাধীনতার প্রথম ২০-২৫ বছর খারাপ কাটেনি। তার পরে অবস্থায় দ্রুত অবনতি হয়েছে।
সর্দার পটেলের যুগ অতিক্রান্ত। তাঁকে আমরা (‘স্ট্যাচু!’ বলে) থামিয়ে দিয়েছি। তাঁর সাধের স্বাধীনচেতা ‘সিভিল সার্ভেন্ট’দের অবসর দিয়েছি। স্বাধীন নয়, আমরা চাই অনুগত আমলা। এ বছর সিভিল সার্ভিস দিবসে মুসৌরির লাল বাহাদুর শাস্ত্রী অ্যাকাডেমির নির্দেশক যে প্রবন্ধ লিখেছেন তাতে পটেলের নামই নেই। তাঁর মতে, আমলাদের প্রথম মার্গদর্শক হলেন ‘পিএম মোদী’। তিনিই শিখিয়েছেন কী করে নিজেকে বিদেশিদের প্রভাবমুক্ত করে সম্পূর্ণ দেশীয় কায়দায় দেশের উন্নয়ন করতে হবে। বোধ করি কঙ্গনা রানাউত একমত হবেন। এনসিইআরটি তো হবেই। তারা ইস্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে ইতিমধ্যেই ডারউইন আর নিউটনকে বহিষ্কার করেছে একই কারণে। নিউটন তবুও বলতে পারেন আমার তৃতীয় সূত্র গোধরাকাণ্ডে প্রমাণিত। ডারউইন সুযোগ পেয়েও বানরের মনুষ্যত্বপ্রাপ্তির মামলায় কোনও প্রতক্ষ্যদর্শী জোগাড় করতে পারেননি।
প্রশাসনের যাবতীয় সমস্যার পিছনে একটাই কারণ তা ভাবা ভুল হবে। তবুও জানতে ইচ্ছে করে আমলাদের সত্যিকার স্বাধীনতা দিলে পরিস্থিতি কতটা উন্নত হত? সর্দার প্যাটেল যে চরম পরিণতির কথা বলেছিলেন তা ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কি নিয়ন্ত্রণে থাকত? আমলাদের ক্ষমতা যে হ্রাস পেয়েছে তার জন্য কি তারা নিজেরাই দায়ী নন? তা-ই যদি হয় তা হলে আরও স্বাধীনতার ফল কী হত আরও অক্ষমতা? ভেবে দেখার বিষয় বটে।
আমাদের সময়ে অ্যাকাডেমিতে আইপিসি-সিআরপিসি পড়তে হত। ঘোড়ায় চড়া শিখতে হত। নেহেরুজির প্রভাব ছিল স্পষ্ট। আজকের মার্গদর্শক বলবেন, এ সব পরিত্যাগ করে আমাদের ফিরতে হবে গুরুকুলে। ভোর ৪টের সময়ে উঠে স্নানাদি সম্পন্ন করে আশ্রমগুরুর পদপ্রান্তে বসে পড়তে হবে ব্যাদ আর মনু সংহিতা। আর অবশ্যই চাণক্যের অর্থশাস্ত্র। সংরক্ষণ যদি না-থাকে তা হলে আইন শৃঙ্খলাও বজায় থাকবে। তা ছাড়া কোটাল থাকবে গুপ্তচর থাকবে। গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন রাজা থাকবেন। প্রজার উন্নয়নই হবে তাঁর ধ্যানজ্ঞান। বিলেত থেকে আমদানি করা সংসদীয় গণতন্ত্র নয়। আমরা পাব প্রকৃত গণতন্ত্র। প্রাচীন ভারতের অন্যতম অবদান। আমার একটাই দুশ্চিন্তা। মেকলেপুত্র হয়ে স্যুটবুটে অভ্যস্ত হয়েছি। মুখ্য সচিবদের টিকি রাখতে হবে না তো?
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)