নরেন্দ্র মোদী এবং বরিস জনসন।
এই ছুটিছাটার মরসুমে কিছুটা আলস্যের ঢংয়েই দেখা যাক গত গ্রীষ্মে জনৈক ভাষ্যকার এক প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কী লিখেছিলেন। ‘তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) ব্রত হল দেশের আত্মবিশ্বাসের পুনরুদ্ধার, দুর্বল এবং ক্ষয়ে আসা এবং আশাহীন পরাজয়মনস্কতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া।’ এবং তা সত্ত্বেও, ‘অনেকের কাছে তিনি জনগণের চোখে এক পতিত সত্তার পরাকাষ্ঠা এবং এই উত্তর-সত্য ভিত্তিক রাজনীতির কালে তাঁর কঠোরতম সমালোচকদের কাছে তিনি এমন একজন বাগাড়ম্বরপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, যিনি দেশের শীর্ষস্থানে নিজেকে অধিষ্ঠিত রাখতে অসংখ্য মিথ্যার আশ্রয় নেন, গণতন্ত্রকে বিপদের কিনারায় নিয়ে আসেন এবং যিনি তাঁর নিজের স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া অন্য কিছুতেই বিশ্বাস রাখেন না... তিনি তাঁর দেশের অর্থনীতি এবং নির্বাচনী মানচিত্রকে এক চরমবাদী পুনর্বিন্যাসের পথে নিয়ে চলেছেন।’
ওই ভাষ্যকার এ কথাও লিখেছেন যে, ‘দেশপ্রেমের ইতিবাচক দিকটিকে তুলে ধরতে তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) যুক্তির পিছনে সুস্পষ্ট আবেদন রয়েছে।’ কিন্তু, ‘আশ্চর্যজনক ভাবে এই সব আবেদনের মোড়কটি হয়তো রূঢ়তায় আচ্ছাদিত থেকে যায়। তিনি কি দেশের জন্য কাজ করছেন, নাকি তাঁর নিজের জন্য?... এক কথোপকথনে তিনি বলেছিলেন যে, মানুষের নিজের মাপের চাইতে বৃহত্তর কিছু ভাবার প্রয়োজন রয়েছে... এবং তাদের ঐতিহ্য এবং সামাজিক সংযোগগুলির ক্ষয় নিয়ে দুর্ভাবনাকে নিশ্চয়ই উৎসাহ দান করা হচ্ছে না।’
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
অতিমারির মোকাবিলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তীব্র ভাবে সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু ‘জনগণ তাঁর কাজের দিকে আরও বেশি ধৈর্য নিয়ে তাকিয়েছে, আরও বেশি করে তাঁর ত্রুটিগুলি ক্ষমা করেছে। কারণ, রাজনীতিক বলতে আক্ষরিক অর্থে যা বোঝায়, তিনি ঠিক তা নন।’ আর এটিই নাকি তাঁর বিরোধীদের হতাশ করে তুলছে। ভাষ্যকার লিখছেন, ‘কোনও কিছুই যে তাঁর ভাবমূর্তিতে দাগ ফেলতে পারে না, এই বিষয়টিই বিরোধীদের ক্ষিপ্ত করে তোলে... যত বার তাঁকে নিয়ে কোনও বিতর্কের উদয় হয়েছে, তিনি অবিচলিত থেকেছেন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পিছনে তাঁর সেই প্রতিভাই ক্রিয়াশীল থেকেছে যে, তিনি তাঁর বিরোধীদের সরল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধা দিয়েছেন। বিরোধীদের অসূয়া এখানেই যে, তিনি জনপ্রিয়। এবং তাঁরা এই জনপ্রিয়তার বিপরীতে কিছুই করতে পারেন না।’
‘তাঁর কাছে রাজনীতি, এবং খানিক অর্থে জীবনও কিছু তথ্য নিয়ে কলহপর হওয়া নয়। বরং মানুষের কাছে বিশ্বস্ত এক বিবরণীকেই তুলে ধরা তাঁর উদ্দেশ্য... কারণ মানুষ এক কল্পনাশক্তিসম্পন্ন প্রাণী।’ তাই তাঁকে যখনই গণমুখাপেক্ষী জাতীয়তাবাদী হিসেবে উপহাস করা হয়, ‘... দৃশ্যত তা এক অন্যায় বিদ্রোহ, যার পিছনে ক্রোধ ছাড়া অন্য কোনও প্রণোদন নেই।’
আমেরিকার খ্যাতনামী লেখক-সাংবাদিক জোয়ান ডিডিওনের ভাষায়, বিষয়টিকে ‘ড্রিমপলিটিক’ বলা যায় (যে ভাবে আমেরিকাইয় সরকারের প্রতি অসন্তোষ পোষোণকারী গ্রামীণ বা মফস্সলি যুবকদের সামনে ‘বাইকার’ সম্প্রদায় অধ্যুষিত সিনেমা উপস্থাপন করে বাইকারদের প্রায় ‘গুণান্বিত বিদ্রোহী’ হিসেবে দেখানো হয়, সে ভাবেই এক অন্তঃসারশূন্য স্বপ্ন এ ক্ষেত্রেও রাখা হচ্ছে)। অতএব প্রধানমন্ত্রী ‘এই মুহূর্তে এমন সব সমস্যার সমাধানে ব্রতী হবেন, যা শুধুমাত্র বিশ্বাস দিয়ে সমাধান করা যায় না। যদি তাঁর অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলি ব্যর্থ হয়, কেউ কেউ আশঙ্কা করেন দেশ সেই দিকে হাঁটবে, যাকে ‘অপর’ থেকে জন্মানো ভীতি বা বিদ্বেষ প্রসূত আত্মপরিচয়ের রাজনীতি বলা যায়... এমনকি, তাঁর ঘনিষ্ঠতমদের একজন এমন দুশ্চিন্তাও ব্যক্ত করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী দেশের সমস্যার বিষয়ে পদ্ধতিবদ্ধ ভাবে ভাবেন না, তিনি আসলে তাঁর অনড় বিশ্বাসগুলির উপরে এতখানিই নির্ভর করেন।’
যে প্রধানমন্ত্রীর কথা এতক্ষণ বলা হল, তিনি কিন্তু নরেন্দ্র মোদী নন। যদিও এই সব বিষয়ই তাঁর সঙ্গে মিলে যায়। উপরের উদ্ধৃতিগুলি আসলে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সম্পর্কে ‘দি আটলান্টিক’-এ প্রকাশিত টম ম্যাকটাগের একটি রচনা থেকে গৃহীত। আপনি মনে করতেই পারেন, দু’জন ব্যক্তি এতখানি বৈসাদৃশ্যহীন হন কী করে! পার্থক্য অবশ্য কিছু আছে। জনসন ইটন কলেজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপজাত। অন্য দিকে, মোদীর সুবিন্যস্ত কেশদাম এবং সদাগম্ভীর হাবভাবের তুলনায় ব্রিটিশ ভদ্রলোকটি খানিক অবিন্যস্ত এবং রসিক।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
যখন তুলনা আনা হয়, তখন মোদীকে সাধারণত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ আরদুহান, হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবান বা ব্রাজিলের জাইর বলসোনারোর মতো গণমুখী স্বৈরশাসকদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসানো হয়। সুতরাং এ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, গণতন্ত্রের দুর্ভেদ্য কেল্লার মধ্যেও এই সব গণমুখীনরা একটি সঙ্ঘ তৈরি করে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন।
এই সঙ্ঘে বরিস জনসনের সদস্যপদকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী ফরাসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে গোঁড়া দক্ষিণপন্থী এরিক জিমুর হয়তো এতে যোগ না-ও দিতে পারেন, কিন্তু কানাঘুষো চলতে থাকবেই। ‘নব্য-উদারপন্থা’-র দিন বিগত এবং যাবতীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপকারী সরকারের যুগ শুরু হয়ে গিয়েছে। অভিবাসনের দিন ফুরিয়েছে। তার উপরে বরং ক্রোধের লাভাপ্রবাহ নেমে আসছে। সংস্কৃতি এসে অর্থনীতির উপরে তুরুপের তাস রাখছে। এবং রাজনৈতিক ভাবে বেঠিকরা জামার কলার তুলে ঘোরাফেরা করছে। ম্যাকটাগ জনসনের বিদেশনীতি বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা এবং ‘রিয়ালপলিটিক’-এর রচয়িতা জন বিউয়ের উক্তি খুব লাগসই ভাবেই তুলে এনেছেন। ‘জাতির রাজনৈতিকতার গতিপথ আসলে নির্ধারত হচ্ছে একটি মাত্র বিষয়ের দ্বারা’, সেটি হল যুগধর্ম। ট্রাম্প যখন গদিচ্যুত, তখনও কথাটি সত্য এবং এই মুহূর্তে জনসনের ক্ষেত্রে ভাল-মন্দ বিচারের সময়ও ফুরিয়ে আসছে। অ্যান্ড দ্য ওয়াটার ইন দ্য টাব মে বি রানিং আউট অন মিস্টার জনসন।’