চাই বিনিয়োগকারীর স্বাধীনতা রক্ষার ব্যবস্থা, এবং বিধি-মান্যতা
Life Insurance Corporation

LIC Disinvestment: কেন এই ‘গেল গেল’ রব?

‘সরকার সমস্ত কিছু বিক্রি করে দিচ্ছে’, এই চালু ধারণা নতুন ভাবে গতি পেয়েছে, সন্দেহ তীব্রতর হয়েছে।

Advertisement

নীলাঞ্জন দে

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২১ ০৪:৪২
Share:

শঙ্কা: এলআইসি শেয়ার বাজারে ছাড়ার প্রস্তাবে যুব কংগ্রেসের প্রতিবাদ কর্মসূচি, কলকাতা, ২০২০

পৌনে দু’লক্ষ কোটি। সংখ্যাটি দেখেও না দেখার ভান করতে পারেন, কারণ ভারতের মতো বৃহৎ, জটিল দেশে এটি হয়তো তেমন কিছুই নয়। তবে হ্যাঁ, চলতি অর্থবর্ষ ২০২১-২২’এর বিলগ্নিকরণের লক্ষ্য এই পরিমাণ টাকা, যেটির একটি প্রধান অংশ এলআইসি-র শেয়ার বিক্রি থেকে উঠে আসার কথা। অতি সম্প্রতি ক্যাবিনেট কমিটি অন ইকনমিক অ্যাফেয়ার্স এই বিলগ্নিকরণের প্রস্তাবে সায়ও দিয়েছে। এ কথা আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, দেশের বৃহত্তম বিমাসংস্থার অন্তত কিছু শেয়ার সাধারণ লগ্নিকারীর হাতে থাকা বাঞ্ছনীয়— বরং তা না হলেই ক্ষতি।

Advertisement

এই পর্যন্ত লিখে ভাবলাম, ঠিক হচ্ছে কি? এলআইসি-র বিলগ্নিকরণের সপক্ষে বড় বেশি উদার মনোভাব দেখাচ্ছি না তো? পর ক্ষণেই চিন্তাটি মন থেকে দূরে নিক্ষেপ করলাম স্রেফ একটি কথা ভেবে— বিমাসংস্থাটির যে বিপুল সম্ভাবনা আছে শেয়ার বাজারে, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কি তা উপভোগ করতে পারবেন না? সংস্থাটির ব্যবসায়িক সাফল্যের অংশীদার কি তাঁরা হবেন না? এলআইসি-র স্টকটি বাজারে নথিভুক্ত না হলে, তাঁরা কি বঞ্চিত হবেন না? উত্তরটি সবারই জানা।

এলআইসি-র আকার-আয়তন নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। ঠিক কতটা বিস্তৃত এই সংস্থাটির ব্যবসা, তা নিয়েও আলাদা ভাবে আলোচনা করছি না। আপনি যদি পরিসংখ্যান-প্রেমী নাও হন, তা হলেও সংস্থাটির বাৎসরিক প্রিমিয়াম আদায়ের অঙ্ক বা নতুন পলিসির বহর এই প্রতিযোগিতার বাজারেও আপনাকে অবাক করবে।

Advertisement

তবে আমি এই আলোচনাটিকে একটা অন্য দিকে নিয়ে যেতে চাই— সরাসরি প্রান্তিক মানুষের দিকে; এমনই একটি অল্প জানা, স্বল্পচর্চিত ক্ষেত্রের দিকে, যা প্রায়শ প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকে।

যদি বিমা-নিয়ন্ত্রক আইআরডিএ-র শেষ বার্ষিক রিপোর্টটি দেখেন, দেখবেন মাইক্রো ইনশিয়োরেন্সের ক্ষেত্রেও এলআইসি-র অবদান ঠিক কত। এ সেই মাইক্রো ব্যবসা, যে দিকে সবাই মন দেন না— কেন, সেটাও বেশ বোধগম্য। অর্থবর্ষ ২০১৯-২০’তে এলআইসি ‘ইন্ডিভিজুয়াল নিউ বিজ়নেস’-এর খাতে ৮.৫৯ লক্ষ পলিসি করেছে। প্রিমিয়ামে তুলেছে ২২২ কোটি টাকা। তুলনায় বেসরকারি সংস্থাগুলি কেবল ১.৬৯ লক্ষ পলিসি করে প্রিমিয়াম বাবদ পেয়েছে ৪.৫৭ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, মাইক্রো ইনশিয়োরেন্স মূলত স্বল্প রোজগেরে মানুষের জন্য পরিকল্পিত, যাতে তাঁরা সামান্য হলেও বিমার সুবিধা পান, কিছুটা হলেও সমাজের মূলস্রোতে আসতে পারেন।

এ লেখার উদ্দেশ্য কেবল বৃহত্তম জীবনবিমা কোম্পানিটির মাহাত্ম্যের কথা বলা বা বেসরকারি সংস্থাগুলির খামতি নিয়ে চর্চা করা নয়। ঘটনাচক্রে ‘প্রাইভেট প্লেয়ার’রা বেশ কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে, ব্যবসাও তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। তবে সে সব নিয়ে আলোচনা অন্য দিনের জন্য তোলা থাক। আজ এও আলোচনা করছি না, কেন এমপ্লয়িজ় প্রভিডেন্ট ফান্ড অর্গানাইজ়েশন এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড বা ইটিএফ-এ সুচারু ভাবে লগ্নি করে লাভবান হয়েছে। তবে সূক্ষ্ম ইঙ্গিত নিশ্চয় ধরাই যাচ্ছে।

এত কিছু সত্ত্বেও এলআইসি-র শেয়ার বাজারে ছাড়া হবে শুনে নাগরিকদের একাংশ ‘গেল গেল’ করে উঠেছেন। ‘সরকার সমস্ত কিছু বিক্রি করে দিচ্ছে’, এই চালু ধারণা নতুন ভাবে গতি পেয়েছে, সন্দেহ তীব্রতর হয়েছে। হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে, বাজারে নথিভুক্ত হলে মোট শেয়ারের একটি ভাগ বিনিয়োগকারীর হাতে থাকে, স্টক বেচা-কেনা হয় এবং নানা কারণের জন্য দাম বাড়ে-কমে। যে কোনও স্টকই এই নিয়মরীতির আওতায় আসে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এবং এ কথাও ঠিক যে, মুষ্টিমেয় বৈভবশালী লগ্নিকারী চলতি বাজার থেকে অনেক শেয়ার নিজেদের কুক্ষিগত করতে পারেন— অন্তত সাবেক বাজারি তত্ত্ব তাই শেখায়। বিশাল মাপের ‘ডিল’— বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলি যা করে থাকে— প্রতিনিয়ত বাজারে হয়ে চলে। সাম্প্রতিক অতীতে এমন অনেক উদাহরণ আছে।

তবে প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে যে যুক্তিটি সহজে পেশ করা যায়, তা দেশের অন্যান্য ‘স্ট্র্যাটেজিক সেক্টর’ সংক্রান্ত। আজ কি স্টক মার্কেটে কোল ইন্ডিয়ার শেয়ার ট্রেডিং হয় না? স্টক এক্সচেঞ্জে কান পাতলেই আজ শুনতে পাবেন যে, কোল ইন্ডিয়ার গড় ‘ট্রেডিং ভলিউম’ খুব জোরদার, এবং তা দেশের অগ্রণী সূচক নিফটি-ফিফটির অন্তর্গত— যে জন্য সেটি দেশি-বিদেশি বহু ধরনের লগ্নিকারীর অতি পছন্দের। মনে রাখবেন, কয়লা আমাদের দেশে খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয়, রাজনৈতিক ভাবেও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এ ছাড়াও বলি, যদি ভারতীয় রেলের প্রোমোট করা দু’একটি সংস্থার শেয়ার নথিভুক্ত হতে পারে, তা হলে এলআইসি কেন নয়? বিমার ক্ষেত্রে তো বেসরকারি এবং বিদেশি কোম্পানির আবির্ভাব সেই কবেই শুরু হয়েছে, সম্প্রতি বিমা আইনের সংশোধন এনে বিদেশি ‘ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’-এর সীমা ৭৪ শতাংশ করার জন্য সরকার যথেষ্ট সক্রিয়তাও দেখিয়েছে। বিমাক্ষেত্রে লগ্নি (জীবন ও সাধারণ, দুই-ই) অন্য দেশ থেকে এসেছে, এ কথা আজ নতুন নয়।

জীবনবিমার ক্ষেত্রে বিলগ্নিকরণের বিরুদ্ধে যাঁরা সরব হয়েছেন, তাঁদের অনেকে বলেন যে, দেশের অন্যতম নামী ‘অ্যাসেট’ বিদেশিদের হাতে চলে যাবে শেয়ার ছাড়ার পরবর্তী অধ্যায়ে। কিঞ্চিৎ অতিসরলীকরণ শোনালেও সন্দেহটি একেবারে অমূলক নয়, তাই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে এরই সঙ্গে বলা দরকার যে, মার্কেট নিয়ন্ত্রক সেবি-কে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বাধীনতা রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। ট্রেডিং যাতে বিধিসম্মত হয়, সে ব্যাপারেও সতর্কতা দরকার। শুধু এলআইসি-র বেলায় নয়, সমস্ত ধরনের স্টকের ক্ষেত্রেই। এবং আগামী দিনে সম্ভাব্য শেয়ার হোল্ডারদেরও গঠনমূলক ভূমিকা নিতে হবে, এ কথাও এখানে জোর গলায় শোনানো কর্তব্য। গড়পড়তা একক লগ্নিকারী এলআইসি-র স্টকটি ধরে রেখে ‘প্রাইস ডিসকভারি’র পূর্ণ সুবিধা পেতে চাইবেন।

একটু আগে যে কোল ইন্ডিয়ার কথা বললাম, সেই শেয়ারটিও বহু মানুষ একেবারে প্রথম দিকে নিয়ে আজও রেখে দিয়েছেন, আমার এই অনুমানও ভ্রান্ত নয়। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস একটি ভাল স্টকের সার্থকতা সেটির কেনা-বেচার মধ্যেও অন্তর্নিহিত থাকে। এলআইসি যদি বাজারে না-ই আসে, ট্রেডাররা নিরাশ হবেন, তাই নয় কি?

আরও একটি কথা। বিদেশের শেয়ার বাজারে অনেক বিমা সংস্থার শেয়ার আজ নথিভুক্ত, নিয়মিত হাতবদল হয়ে থাকে। বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের দৃষ্টান্ত দিই। বহু বিনিয়োগকারী স্টকটি নিতে আগ্রহী, এবং তা বিনা কারণে নয়। কোম্পানিটি তেমন ভাবে জানেন না? বিশ্বের এই অন্যতম সফল লগ্নিকারী ওয়ারেন বাফেট ও এই সংস্থাটি প্রায় সমার্থক।

জানি, তুলনাটা সম্পূর্ণ ঠিক হল না— এলআইসি-র শেয়ার লিস্টিংকে একটু ভিন্ন স্বাদের বিষয় হিসেবেই দেখা উচিত। ভারতীয় আমজনতার যে অংশটি বাচ্চাদের নিয়মিত স্কুল ফি দেন, পাড়ার দোকানে ধার রাখেন না, ব্যাঙ্কের পরিষেবায় ফাঁক থাকলে অসন্তুষ্ট হন— সেই নাগরিকদের পোর্টফোলিয়ো সমৃদ্ধ হবে এলআইসি-র অন্তর্ভুক্তিতে। মার্কেটের অধিষ্ঠাতা ঈশ্বর যদি তাঁর পতাকা দেন, সেটি বইবার শক্তিও তিনিই দেবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement