পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় দিল্লি সফরে গিয়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনের সঙ্গে দেখা করে রাজ্যের জন্য আরও ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা সংক্রান্ত জরুরি সামগ্রীর জোগান সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে দু’বার দেখা করলেও তিনি এক বারও বাংলার ‘ইয়াস’ বিধ্বস্ত জেলাগুলির পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের জন্য আরও কেন্দ্রীয় সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন বলে দাবি করেননি। বাংলার স্বার্থ তাঁর ভাবনায় নেই।
কেউ বলতেই পারেন যে, ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হওয়ার পর থেকেই তিনি বার বার প্রমাণ করছেন, এ রাজ্যে তাঁর ভূমিকা বিজেপির ‘প্রধান পর্যবেক্ষক’ হিসেবে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি রাজ্যে ‘আসল পরিবর্তন’-এর আহ্বান জানাতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। নির্বাচনী ফলাফলে স্বপ্নভঙ্গের হতাশায় অবসাদগ্রস্ত বিজেপিকে চাঙ্গা করে তুলতে আবার আসরে নামলেন ধনখড়। বিজেপি নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ভোট পরবর্তী বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাসের ছবি দেখে বেড়ালেন। অন্য দলের কর্মীরাও বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাসের বলি হয়েছেন— রাজ্যপাল তাঁদের কাছে যাননি।
আর এই প্রেক্ষাপটে পুরনো বিতর্কটা আবার জেগে উঠেছে— একটি সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যপালের পদ থাকাটা কি আদৌ সমীচীন? ১৯৫৯ সালে কেরলে ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদের প্রথম কমিউনিস্ট সরকারকে বরখাস্ত করার পর রাজ্যপাল পদ নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল, তা ছয় দশক পরেও জীবন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের ভূমিকায়। গত ছ’দশকে একাধিক বার বিতর্ক পৌঁছেছে শীর্ষ আদালতে। কিন্তু রাজ্যপাল পদের যৌক্তিকতা নিয়ে উঠে আসা প্রশ্নের কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। ১৯৩৫ সালের ঔপনিবেশিক ভারত শাসন আইন অনুযায়ী, রাজ্যপাল বা গভর্নরের পদ ছিল শুধুমাত্র ব্রিটিশ রাজের প্রতি দায়বদ্ধ। ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়ে ব্রিটিশরা যখন ভারতীয়দের হাতে প্রাদেশিক স্বশাসনের আংশিক অধিকার তুলে দিতে বাধ্য হল, তখন প্রাদেশিক সরকারগুলির মাথায় ব্রিটিশ রাজের প্রতিনিধি গভর্নর বসানো হয়েছিল।
স্বাধীন ভারতে সেই পদ কেন রেখে দেওয়া হল? তা হলে কি রাজ্যগুলি দিল্লির উপনিবেশ? রাজ্যপাল নির্বাচিত হবেন, না মনোনীত— তা নিয়ে সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যে দ্বিমত ছিল। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব তাঁরা ছেড়ে দেন আইনসভার হাতে। কিন্তু, পদটি যে থাকবে, তাতে তাঁরা একমত ছিলেন। আইনসভা স্থির করে যে, রাজ্যপালরা মনোনীত হবেন। স্বাধীন ভারতে নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলির মাথায় বসে থাকবেন কেন্দ্রীয় সরকারের সুপারিশে রাষ্ট্রপতি দ্বারা মনোনীত রাজ্যপাল।
কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের বা জোটের সরকার হলে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু যখনই কেন্দ্র ও রাজ্যে দু’টি ভিন্ন দলের সরকার, তখনই সমস্যা দেখা দেয় রাজ্যপালকে ঘিরে। ১৯৫৯ সালে কেরলের কমিউনিস্ট সরকার বরখাস্ত করায় রাজ্যপাল বি রামকৃষ্ণ রাও-এর ভূমিকা, পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬০-এর দশকে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভাঙাগড়ায় রাজ্যপাল ধর্মবীরের ভূমিকায় বোঝা গিয়েছিল যে, কেন্দ্রের শাসক দল রাজ্যপালকে তাদের এজেন্ট হিসেবেই ব্যবহার করবে। তবে, কংগ্রেস মাঝেমধ্যে রাজ্যপালদের রাজ্য রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করলেও কংগ্রেসের কাছে অধিকাংশ সময়েই রাজ্যপালের পদটা ছিল বৃদ্ধ নেতাদের বানপ্রস্থে পাঠানোর একটা ব্যবস্থা। রাজভবনগুলিকে কার্যত সাততারা বৃদ্ধাবাসে পরিণত করেছিল কংগ্রেস।
২০১৪ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার রাজ্যপালের পদকে বিজেপি-বিরোধী দল শাসিত রাজ্যে বিরোধী নেতার ভূমিকাতেও নামিয়ে দিল। মণিপুর ,অরুণাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, গোয়ায় সরকার গঠনে রাজ্যপাল কলকাঠি নাড়লেন কেন্দ্রের নির্দেশে। পশ্চিমবঙ্গে, কেরলে রাজ্যপালরা নিয়মিত ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন সেখানকার নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে, সমালোচনা করছেন। পুদুচেরির তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর কিরণ বেদি রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত জেহাদ ঘোষণা করে নানা পদক্ষেপ করার চেষ্টা করেছেন। মহারাষ্ট্রে সরকার গঠনে রাজ্যপাল ভগৎ সিংহ কুশিয়ারির বিতর্কিত পদক্ষেপ মানুষ দেখেছে। রাজ্যপাল এবং রাজ্য সরকারের বিবাদ বহু ক্ষেত্রেই আদালতে পৌঁছেছে।
সংসদীয় বামপন্থীরা এক সময় কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস চেয়ে, রাজ্যপালের পদ তুলে দেওয়ার দাবি করতেন। এখনও সংসদীয় বামপন্থীরা সেই দাবি থেকে সরে আসেননি— কেরল স্মর্তব্য। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে সেই বামপন্থীরাই ছুটে যাচ্ছেন রাজভবনে রাজ্যপালের দরবারে। ঝাড়খণ্ডে খাদ্যের দাবিতে রাজ্যপালের কাছে দাবি সনদ পেশ করছেন সিপিএম নেতৃত্ব। যেমন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী দল হিসেবে ছুটে যেত রাজ্যপালের কাছে। এখন প্রতি দিন তাদের লড়াই করতে হচ্ছে অতি সক্রিয় রাজ্যপালের সঙ্গে! রাজনীতির পাকেচক্রে রাজ্যপালের পদটি দিব্য টিকে থাকছে।