দুই মমতা। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
শ’দুয়েক লোকের জমায়েতে তখন মাইক্রোফোন গমগম করছে। চতুষ্পার্শ্বে উৎকর্ণ সব মুখ। কিছু মুখ ততোধিক উন্মুখ। আচমকাই পিছন থেকে আওয়াজটা এল, ‘‘অনেক লাখ লাখ, কোটি কোটির অঙ্ক তো বলছেন। কয়েকটা কোম্পানির নাম বলতে পারবেন?’’ প্রশ্নকর্তার মাথায় একটা ধানরঙা হ্যাট। পরনে সেই রঙেরই স্যুট। টাইয়ের রংটা মনে পড়ছে না। কপালে সিঁদুরের ঢাউস টিপ (টিকা নয়, টিপ)। দেহবিভঙ্গে দৃশ্যতই একটু তেরিয়া ভাব। এমন কিছু যে একটা হতে পারে, সেই খবর ছিলই। অতএব গোটা হলঘরের মুন্ডু ঘুরে গেল পিছন দিকে।
অক্সফোর্ডের কেলগ কলেজের প্রেক্ষাগৃহের পোডিয়ামের সামনে দাঁড়ানো কৃশতনু মহিলা একটুও ঘাবড়ালেন না। বরং গড়গড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার নাম বলতে লাগলেন। কিন্তু হ্যাট-কোট থামতে নারাজ। তিনি বলতে লাগলেন, ‘‘আপনি মিথ্যে কথা বলছেন!’’
সুতির শাড়ির মহিলা তাতেও মেজাজ হারালেন না। তত ক্ষণে পিছনের সারিতে উঠে দাঁড়িয়েছে আরও কিছু চেহারা। তাদের হাতে উঁচু করে ধরা সাদার উপর লাল রঙের হরফে লেখা পোস্টার। বিক্ষোভ দেখাতে গেলে যেমন করতে হয়। খানিকটা স্লোগানও।
তাপ বাড়ছিল হলঘরে। গুঞ্জন ক্রমশ পরিণত হচ্ছিল বিতণ্ডায়। চাপানউতর পৌঁছোচ্ছিল কথা কাটাকাটিতে। কারণ, তত ক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন দর্শক-শ্রোতাদের একটা অংশ। পিছন ফিরে তাঁরাও পাল্টা বক্তব্য পেশ করতে শুরু করেছেন। তাঁদের গলাও চড়ছে। তাঁরা বলছেন, ‘‘উনি এখানে দেশেরও প্রতিনিধিত্ব করছেন। ওঁকে এখানে অপমান করা মানে দেশেরও অপমান। আপনারা এ ভাবে বিদেশের মাটিতে দেশের অপমান করতে পারেন না।’’ সাদা হাতকাটা ‘পাফ জ্যাকেট’ পরিহিতার মধ্যে তখনও কোনও উত্তেজনা নেই। উল্টে তিনি বলছেন, ‘‘ইউ আর অল মাই ব্রাদার্স। আপনাদের আমি চকোলেট খাওয়াব। মিষ্টি খাওয়াব। আপনারা বরং কলকাতায় গিয়ে আপনাদের দলকে আরও মজবুত করুন। যাতে আমার সঙ্গে তারা লড়তে পারে।’’
কিন্তু গোলমালটা বাড়ছিল। ক্রমশ বাড়ছিল। তার মধ্যেই এক প্ল্যাকার্ডধারী তরুণ গলা চড়িয়ে বললেন, ‘‘আপনি যাদবপুরে যান! গিয়ে দেখুন সেখানে কী অবস্থা!’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে কি এ বার সামান্য বিচলন দেখা গেল? একটু নড়াচড়া? দেখা গেল। কারণ, তিনি মঞ্চের ধারে দাঁড়ানো তাঁর নিরাপত্তারক্ষী স্বরূপ গোস্বামীর দিকে ফিরে হাতের ইঙ্গিতে কিছু একটা চাইলেন। দেখা গেল, চোখের পলকে মমতার হাতে চলে এসেছে একটা ছবির প্রিন্ট আউট। যে ছবি তোলা হয়েছিল তিনি হাজরা মোড়ে লালু আলমের হাতে মার খেয়ে মরণাপন্ন হওয়ার পরে।
জাদুকরের টুপি থেকে খরগোশ বার করার মতো মমতাকে ছবিটা বার করতে দেখে মনে পড়ল, আগের দিনই তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার কাছেও একটা ছোট্ট কাগজ আছে। আমি তৈরি হয়েই যাচ্ছি।’’ সেই কাগজ, অর্থাৎ ছবিটা দু’হাতে মাথার উপর তুলে ধরলেন একদা বাংলার প্রধান বিরোধীনেত্রী। তার পরে বললেন, কী ভাবে তাঁকে মেরেধরে থামানোর চেষ্টা হয়েছে একাধিক বার।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে ঘটতে-থাকা গোটা দৃশ্যটার ভরকেন্দ্রে বসে থাকতে থাকতে মনে পড়ে গেল অন্য এক মুখ্যমন্ত্রীর কথা। ঘটনাচক্রে, তাঁরও নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি একটি ইংরেজি নিউজ় চ্যানেলের আয়োজিত মঞ্চে দর্শকের সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের অনুষ্ঠান শুরু করেও দর্শকের মধ্য থেকে ‘অপ্রিয়’ প্রশ্ন শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে প্রশ্নকর্ত্রী তরুণীকে ‘মাওবাদী’ আখ্যা দিয়ে ল্যাপেল মাইক্রোফোন এক টানে খুলে ফেলে সটান হাঁটা লাগিয়েছিলেন। আর ফিরে আসেননি। কলকাতার টাউনহল অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। কিন্তু ২০১২ সালের সেই ঘটনার মতো কাণ্ড সম্ভবত সেই প্রথম। প্রসঙ্গত, সে দিন যিনি সাক্ষাৎকার নিতে বসেছিলেন এবং ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে মমতাকে আসনে ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করে অনতিবিলম্বে রণে ভঙ্গ দিয়ে স্রেফ ভোম্বল হয়ে নিজের চেয়ারে থম হয়ে বসেছিলেন (কারণ, শত পীড়াপীড়িতেও মমতা ফিরে আসেননি), তিনি এখন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ। মমতার যথেষ্ট আস্থাভাজনও বটে।
অক্সফোর্ডের কেলগ কলেজের ঘটনাটা দেখতে দেখতে ঝপ করে কলকাতার টাউনহলের সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। পেশার প্রয়োজনে বিক্ষোভ, এসপ্ল্যানেড ইস্টে লাঠি-গুলি-গ্যাস প্রচুর দেখেছি (বস্তুত, যারা এসপ্ল্যানেড ইস্টে লাঠি, গুলি, গ্যাস নিজের চোখে দেখেনি এবং কখনও কভার করেনি, তাদের একটা সময়ে রিপোর্টার সমাজে ম্লেচ্ছ হিসাবে গণ্য করা হত)। কিন্তু ৫০ ফুট দূর থেকে এক রবাহূত (শব্দটা সচেতন ভাবেই ব্যবহার করলাম। হতে পারে, অনলাইনে নাম নথিভুক্ত করিয়ে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অক্সফোর্ডে বক্তৃতা করবেন— সেই রব শুনেই তো) কোনও নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে (তাও এক বার নয়, পর পর তিন বারের। যেখানে প্রতি বারের ভোট তাঁর আগের বারের চেয়ে কঠিন ছিল। কিন্তু প্রতি বারই তিনি জিতেছেন আগের বারের চেয়ে আসন বাড়িয়ে) আঙুল তুলে ‘লায়ার’ বলছেন, সেটা আগে দেখিনি। দেখিনি যে, খানিক ‘বাগে পেয়ে’ দেশের একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে কেউ চিৎকার করে বলছেন, ‘‘ইউ কিলড অভয়া! ইউ কিলড আ ইয়ং ডক্টর! ইউ আর আ কিলার!’’
যেমন এই পরিস্থিতিতে এই মমতাকেও আগে দেখিনি। যিনি মেজাজ হারালেন না, ধৈর্য হারালেন না, মঞ্চ ছেড়ে চলে গেলেন না, ভাষণ থামালেন না। শান্ত হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে তো রইলেনই, বরং বিক্ষোভকারীদের ‘বাবা-বাছা’ বলে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘‘ওই ঘটনাটা (আরজি কর-কাণ্ড) এখনও বিচারাধীন বিষয়। এখনও তদন্ত চলছে।’’ তাঁকে যখন ২০২১ সালের ‘ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস’ ইত্যাদি ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করা হল, আপনি কি হিন্দু? তখন তিনি জবাবে বললেন, ‘‘আমি জন্মসূত্রে হিন্দু পরিবারের সন্তান। কিন্তু আমি মানুষ হিসেবে একাধারে সব। আমি হিন্দু, আমি খ্রিস্টান, আমি শিখ, আমি মুসলমান, আমি বৌদ্ধ, আমি জৈন, আমি পার্সি। আমি সবচেয়ে প্রথমে একজন মানুষ!’’
এমন নয় যে, এই কথাগুলো মমতা এই প্রথম বললেন। কিন্তু নিজের পরিচিত প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক সভায় এই কথা বলা আর অক্সফোর্ডে আমন্ত্রিত বক্তা হিসাবে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়ে (সে বিক্ষোভকারীর সংখ্যা যতই সীমিত হোক) উচ্চারণ করার মধ্যে তফাত আছে বইকি! যেখানে অনবরত বিতণ্ডার ফুলকি উড়তে শুরু করেছে এবং তিনি সামান্য ইন্ধন দিলেই বিস্ফোরণ হতে পারে, সেখানে নিজেকে সংযত রেখে পরিস্থিতির রাশ আলগা হতে না-দেওয়া এক ধরনের মানসিক পরিণতিবোধ দাবি করে।
অক্সফোর্ডে মমতাকে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, তিনি সেই পরিণতিবোধে পৌঁছে গিয়েছেন। টাউনহলের মমতা আর অক্সফোর্ডের মমতা সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ। টাউনহলের মমতার চেয়ে অক্সফোর্ডের মমতা অনেক বেশি সংযমী। সম্ভবত অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসীও। যিনি মঞ্চে তাঁর কাছে কার্যত গলবস্ত্র হয়ে ক্ষমাপ্রার্থী কেলগ কলেজের প্রেসিডেন্ট তথা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভাইস চ্যান্সেলর জোনাথন মিকিকে বরাভয় দিলেন, ‘‘কাউকে জোর করে বার করে দেওয়ার দরকার নেই। গণতন্ত্রে সকলেরই নিজের বক্তব্য বলার অধিকার আছে। তবে ওঁরা শান্ত হয়ে প্রশ্ন করতে পারতেন। আমিও শান্ত ভাবে জবাব দিতে পারতাম।’’ মমতার শান্ত থাকা অবশ্য অস্বাভাবিকও নয়। গত প্রায় এক বছরে আরজি করের ঘটনা নিয়ে বেনজির নাগরিক আন্দোলনের সময়ে তিনি সমুদ্রে শয্যা পেতেছিলেন। আলোচনা, বিতর্ক, প্রতর্ক পেরিয়ে সেখান থেকে বেরিয়েও এসেছেন। তিনি শিশিরে কেন ভয় পাবেন? সেটা আরও মনে হচ্ছিল, যখন বক্তৃতার শেষে প্রশ্নোত্তরের সময় তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে খানিক খোঁচানোর চেষ্টা করলেন কর্ণ বিলিমোরিয়া। মমতা খুব যত্নের সঙ্গে সেই প্রসঙ্গও পাশ কাটিয়ে গেলেন। সম্ভবত পক্ষান্তরে বোঝাতে চাইলেন, তিনি ঘরের ঝগড়া ঘরেই রাখতে চান। বাইরে নয়, বিদেশের মাটিতে নয়। তিনি মোদী-শাহকে আক্রমণ করবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু করবেন ব্রিগেডের জনসভা থেকে। অক্সফোর্ডের বক্তৃতার মঞ্চ থেকে নয়। সে মঞ্চ তাঁর সামনে যত্ন করে বিছিয়ে দেওয়া হলেও নয়।
আশ্চর্য নয় যে, বক্তৃতা এবং প্রশ্নোত্তরের পর্ব শেষ করে যখন বেরোচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তাঁকে বলা হল, বিক্ষোভকারীরা প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও বাইরেই আছেন (প্রকারান্তরে বলা হচ্ছিল, তিনি যেন অন্য রাস্তা দিয়ে বেরোন)। যা শুনে মৃদু হেসে মমতা বললেন, ‘‘থাকুন না। গণতান্ত্রিক দেশ। আমি এই পথ দিয়ে গিয়েই বাসে উঠব।’’ কারণ, ধুরন্ধর রাজনীতিক মমতা জানতেন, সংযত থেকে ঘটনার রাশ হাতে নিয়ে নিয়েছেন তিনি। তাঁকে ঘিরে তখন মুগ্ধ জনতার জটলা। মমতা জানতেন, তাঁর সংযম তত ক্ষণে তাঁর চারদিকে অদৃশ্য এক বলয় তৈরি করে দিয়েছে।
মমতা জানতেন, টাউনহলের মমতাকে অনেক পিছনে ফেলে এসেছেন অক্সফোর্ডের মমতা।