শিক্ষার কর্তা ও কর্ম
Education

গোটা বিশ্বে উচ্চশিক্ষার সাফল্যের মন্ত্র: প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা

এ দিকে রাজ্যের বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশ কড়া মুঠোয় পাকড়েছে।

Advertisement

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২২ ০৭:৩৭
Share:

ভারী দুঃখ ব্যাঙেদের, তাদের রাজা নেই। শেষে দেবতার কাছ থেকে রাজা আদায় হল: একটা মরা গাছের ডাল। দু’দিন বাদে নালিশ: নড়নচড়ন নেই, হাঁকডাক জুলুম কিচ্ছু নেই, এ কেমন রাজা? নতুন রাজা হল একটা বক। সে ব্যাঙেদের ধরে আর গেলে। বেচারারা ফের দেবতার পায়ে পড়ল: ‘ঠাকুর, ঢের হয়েছে, আর রাজা চাই না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য নিয়ে বিতণ্ডায় সুকুমার রায়ের হাত-ফেরা ইশপের গল্পটা মনে পড়ল। পশ্চিমবঙ্গের সরকারপোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্যপালই বরাবর আচার্য। এটা শিরোনামে ওঠেনি, কারণ আচার্যের ভূমিকা আবদ্ধ থেকেছে আনুষ্ঠানিক উপচারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালমন্দের দায় তাঁর উপর বর্তায়নি। ব্যতিক্রমী রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর শিক্ষকদের সঙ্গে লেখাপড়া নিয়ে আদানপ্রদান চলত; বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনে তিনি হস্তক্ষেপ করেননি।

Advertisement

আজকের রাজ্যপাল কিন্তু কর্মোন্মুখ। তিনি চান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ-বিধি বিষয়ে তাঁর মত হবে চূড়ান্ত। এ দিকে রাজ্যের বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশ কড়া মুঠোয় পাকড়েছে। আইন চালু করে, শিক্ষকদের স্বাধীনতা খর্ব করে, আর্থিক বিধিনিষেধ চরমে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বলতে গেলে নিজস্ব কোনও ক্ষমতা অবশিষ্ট রাখেনি। উদ্যোগী উপাচার্যরা হতোদ্যম হয়ে সরে গিয়েছেন, যেমন যাদবপুরের শৌভিক ভট্টাচার্য।

মানতেই হবে, কেন্দ্রের এবং বহু রাজ্যের খতিয়ান অনুরূপ বা আরও মর্মান্তিক। আজ কেন্দ্রীয় সরকার দেশ জুড়ে সরকারপোষিত উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রশাসনিক নিগড়ে বাঁধছে, অর্থবরাদ্দ কমাচ্ছে, অবাধ চিন্তা ও জ্ঞানচর্চা দুষ্কর করে তুলছে। রাজ্য সরকারের আচরণে তার প্রতিফলন— না কি পূর্বক্রিয়া?— অবশ্যই সমান ভাবে অশুভ। জেএনইউ-এ কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক ভূমিকার সঙ্গে ২০১৪ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্য সরকারের ভূমিকার মিল রীতিমতো অস্বস্তিকর।

Advertisement

এ রাজ্যে বাম আমলে শিক্ষায় রাজনীতি ঢুকেছিল উৎকট, হানিকর ভাবে। বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম দফায় প্রেসিডেন্সি কলেজকে ধ্বংস করার ঘোষিত প্রচেষ্টার এই লেখক সাক্ষী, সাক্ষী বহু লজ্জাকর ঘটনার। বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কলেজ ব্যবস্থাকে দুর্বল ও দলনির্ভর করাও তখনই শুরু।

তবু সেই নষ্টামিতে যেন একটা সারল্য ছিল। স্বঘোষিত ক্রান্তিকারীরা কিছু সংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারেনি। গুরুতর বা লোভনীয় পদে নিজেদের লোক বসিয়েই তারা ক্ষান্ত, শিক্ষার পুরো কাঠামোটা বরবাদ করার উচ্চাভিলাষ তাদের কল্পনায় আসেনি। বামপন্থীদের যে বিদগ্ধ বিদ্যোৎসাহী গোষ্ঠী, তারাও ঠাঁই পেয়েছিল সেই কাঠামোয়। কাঠামোটা বজায় ছিল বলে যোগ্য উপাচার্যেরা ভাল কাজ করতে পেরেছেন, শাসকের সমর্থন পেলে তো বটেই (যেমন যাদবপুরে শঙ্কর সেন), শাসকের বিরোধিতা সত্ত্বেও (যেমন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তোষ ভট্টাচার্য)।

উপরন্তু সেটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের স্বর্ণযুগ। ইউজিসির আশীর্বাদে, অশেষ খামতি সত্ত্বেও দেশ জুড়ে গড়ে উঠেছিল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় বিস্তার। পশ্চিমবঙ্গেও বিকশিত হয়েছে যাদবপুর, সেই সঙ্গে বর্ধমান, কল্যাণী, উত্তরবঙ্গ, মেদিনীপুর। গত দশকে রাজ্যে অনেক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, কিন্তু সারস্বত বিকাশের পূর্ণাঙ্গ চিত্রটা যেন মাথায় রেখে নয়। শিক্ষকসংখ্যা আর পরিকাঠামোর দৈন্য এই অস্পষ্ট আধাখেঁচড়া পরিকল্পনার অবধারিত ফল।

এ দিকে উচ্চশিক্ষায় কেন্দ্রীয় সহায়তা তলানিতে ঠেকেছে। ইউজিসির অস্তিত্ব বিপন্ন। কিছু ভিআইপি প্রতিষ্ঠান বাদে কেন্দ্রের স্পষ্ট আগ্রহ সরকারপোষিত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কোণঠাসা করতে। তার মোক্ষম উপায় গবেষণা, পরিকাঠামো, ছাত্রদের বৃত্তি বাবদ অর্থবরাদ্দে কার্পণ্য।

আমাদের মতো ‘বিরোধী’ রাজ্যে কেন্দ্র-রাজ্য উভয়েই নিজস্ব উপায়ে ও তাগিদে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কব্জা করতে চায়, অর্থাৎ পোক্ত করতে চায় নিজের নিজের দুর্বলতাগুলি। আচার্য নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের মূলে বৃহত্তর এই রেষারেষি। প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এত নগ্ন ভাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের লড়াই রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে কখনও দেখা যায়নি। ছাত্র-রাজনীতি তুলনায় ছেলেখেলা।

মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করার প্রস্তাবটির আইনি দিক নিয়ে তর্ক চলছে। যা হওয়া উচিত মূল আলোচ্য, অর্থাৎ লেখাপড়া চিন্তা-গবেষণায় এর প্রতিঘাত, সে বিষয়ে সকলে নীরব। শিক্ষার পরিকল্পনায় শিক্ষকদের কখনও শামিল করা হয় না, এ ক্ষেত্রেও হয়নি। চটজলদি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আইনের মান্যতা পেলে শিক্ষাব্যবস্থায় যে প্রভাব পড়বে, তার দায় কিন্তু বর্তাবে শিক্ষককুলের উপর। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছাত্রসমাজ, আরও বিপন্ন হবে উচ্চতর জ্ঞানচর্চা।

রাজ্যপালের পদ রাষ্ট্রব্যবস্থার অঙ্গ, রাজনৈতিক ব্যবস্থার নয়— বরং, রাষ্ট্রীয় বিধানে তিনি রাজনীতির বাইরে, কোনও বিশেষ রাজ্যপাল সেই শর্ত যতই লঙ্ঘন করুন। ফলে রাজ্যপাল আচার্য থাকলে পদটি অরাজনৈতিক থাকা সম্ভব ও প্রত্যাশিত। এক জন মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু প্রশাসনের কার্যনির্বাহী প্রধান তথা রাজনৈতিক নেতা। তাঁর আচার্যের ভূমিকায় রাজনৈতিক মাত্রা আসা স্বাভাবিক। তিনি যদি প্রকট দলীয় রাজনীতি এড়িয়েও চলেন, সরকারি নীতি তাঁকে বলবৎ করতেই হবে— বলা চলে, সে জন্যই তাঁকে আচার্য করা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন কর্তৃত্বমুক্ত অস্তিত্বের, প্রয়োজনে সরকারবিরোধী অবস্থানের, অন্তিম রেশটুকু হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। মুক্ত চিন্তা ও জ্ঞানচর্চা প্রমাদ গনবে। স্বাধীনতার অভাবে সমাজ তথা অর্থনীতির যে অনিবার্য ক্ষতি, তা বুঝে উঠতেই এক যুগ কেটে যাবে।

আচার্য পদের অভ্যস্ত স্থিতিশীল নিরুপদ্রব চরিত্র বানচাল হচ্ছে একটা তাৎক্ষণিক দলীয় (ও ব্যক্তিগত) কোন্দলের জেরে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে আইন গড়াপেটা হচ্ছে খুশিমতো। এটা অবশ্য আজ দেশ জুড়ে নির্বিচারে শতগুণ ভয়ঙ্কর মাত্রায় হয়েই চলেছে। আচার্য নিয়োগের বিতর্ক তুলনায় নিরামিষ, সার্বিক বিপর্যয়ের ক্ষুদ্র পার্শ্বক্রিয়া। এর যারা বিরোধী, বৃহত্তর ধ্বংসলীলায় তাদের চিৎকৃত উল্লাস। তবু রাজায় রাজায় যুদ্ধ বাধলে উলুখাগড়ার বাঁচার তাগিদেই প্রতিবাদ না করলে নয়।

প্রতিবাদ নাহয় হল, কিন্তু সমাধান? দুটো কথা মনে রাখতে হবে। এক, ভারত জুড়ে আচার্য-উপাচার্যদের বিচিত্র পরিচয় ও নিয়োগপদ্ধতি। সব সুস্থ নজির নয়। অনেক রাজ্যে সেনা বা প্রশাসনিক আধিকারিকদের উপাচার্য পদে বসানো হয়। তাতে ছাত্র-শিক্ষকরা বশে থাকে, লেখাপড়ার উন্নতি ঘটে না। রব উঠেছে, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নাকি প্রধানমন্ত্রীর আচার্য হওয়া রেওয়াজ, যেমন বিশ্বভারতীতে। দ্বিতীয় নজির কিন্তু দুর্লভ। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য উপরাষ্ট্রপতি। জেএনইউ, হায়দরাবাদ, জামিয়া, নেহু, বারাণসী, আলিগড়— প্রত্যেকটিতে আলাদা লোক। নিশ্চয় তাঁরা শাসক দলের আস্থাভাজন, সেটা অন্য কথা।

দ্বিতীয়ত, আইন প্রণীত হবে সাধারণ নীতি ও বাস্তব মেনে, ব্যক্তিবিশেষকে মাথায় রেখে নয়। অমুক পদের বর্তমান অধিকারী কতটা উপযুক্ত সেটা গৌণ; ভবিষ্যতে যাঁরা আসবেন, তাঁরা? শুধু খেয়াল রাখতে হবে, আইনে এমন ফাঁক না থাকে যে, অযোগ্য ব্যক্তি বিপর্যয় ঘটায়, বা এমন কড়াকড়ি যে, যোগ্য ব্যক্তি কাজে বাধা পায়। আচার্যের ভূমিকা যত নিরপেক্ষ থাকে ততই মঙ্গল। তাঁর ভূমিকা হোক পঠনপাঠন ও সারস্বত আদর্শের প্রতিভূ হিসাবে— ব্যক্তিপরিচয় ছাপিয়ে, সক্রিয় প্রশাসন থেকে নিশ্ছিদ্র ভাবে বিচ্ছিন্ন থেকে। দেখা যাচ্ছে, বর্তমান ব্যবস্থায় আপাত আলঙ্কারিক আচার্যের হাতে বিলক্ষণ ক্ষমতা আছে শিক্ষা-প্রক্রিয়া ঘেঁটে দেওয়ার। প্রশাসনিক প্রধান ওই পদে বসলে সম্ভাবনাটা যথেষ্ট বাড়বে। সেটা ঠেকাতে চাই আচার্যের ভূমিকার নতুন সংজ্ঞা।

আমাদের নেতা-মন্ত্রী-আমলার চিরাচরিত রোখ, শিক্ষাব্যবস্থা তাঁরা স্বহস্তে চালাবেন। এর বিবিধ কারণ সম্ভব: ক্ষমতা, লেখাপড়া আস্বাদনের সুপ্ত বিলাস, সর্বোপরি এই বদ্ধমূল ধারণা যে, শিক্ষকরা নেহাত অপদার্থ, শাসিয়ে চোখরাঙিয়ে না রাখলেই নয়। শিক্ষকদের অশেষ দোষত্রুটি; কিন্তু যে কোনও কর্মক্ষেত্রের মতো এখানেও শেষ অবধি ভাল কাজ করবেন। বাইরে থেকে কর্তৃত্ব ফলিয়ে তা সম্ভব নয়। কর্তারা এটুকুই করতে পারেন, ভাল শিক্ষকদের পেশায় আকৃষ্ট করতে এবং তাঁদের প্রয়োজনীয় আবহ, রসদ ও স্বাধীনতা দিতে— দরকারে রসদ সংগ্রহেরও স্বাধীনতা দিতে। রাজ্যে, দেশে, দুনিয়ার সর্বত্র সফল উচ্চশিক্ষার এটাই প্রমাণিত মূলমন্ত্র।

ইশপের গল্পে গাছের ডালটা যত দিন রাজা ছিল, ব্যাঙগুলো মনের আনন্দে তার উপর লাফাত, নাচত, গলা ছেড়ে ডাকত। ওই ব্যাঙের কেত্তনই বাগ্‌দেবীর স্তোত্র। খাঁচার তোতার বুলি নেহাত ফাঁকা আওয়াজ।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement