সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার রাস্তায় রানাঘাটের বিজেপি সাংসদের গাড়ির পিছনে বোমা পড়েছিল। ব্যাপারটা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক এবং উদ্বেগজনক। তবে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে বেআইনি বোমা-বন্দুক আর রাজনৈতিক ছাতার তলায় বা বাইরে থাকা দুষ্কৃতীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যার প্রেক্ষিতে ঘটনাটা খুব একটা ব্যতিক্রমী নয়। কিন্তু বাংলা সংবাদ চ্যানেলে দু’দিন ধরে বলা হল দ্য কাশ্মীর ফাইলস দেখে ফেরার পথে বিজেপি সাংসদ আক্রান্ত। যেন দ্য কাশ্মীর ফাইলস দেখার সুবাদেই তিনি প্রায় শহিদ হতে বসেছিলেন! যেন গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি দেখে ফিরলে এমনটা হত না! এবং মাননীয় সাংসদ যদি সত্যিই অন্য কোনও সিনেমা দেখে ফেরার সময় একই হামলার মুখোমুখি হতেন, সেখানে সংবাদ মাধ্যমের কাছে ছবির নামটা এক ছটাকও গুরুত্ব পেত না। আসলে এটাই হল খবরের নির্মাণ, তার পরিবেশন, আর খবর যাঁরা গবগবিয়ে গিলছেন, সেই উপভোক্তাদের ধারণা।
দ্য কাশ্মীর ফাইলস ছবিটার এই দেশজোড়া ভয়ানক ঐতিহাসিক বক্স-অফিস সাফল্যের পিছনে এমন ধারণা বা পারসেপশন-এর নিপুণ নির্মাণ এবং হিসাবি পেশাদার বিপণন স্ট্র্যাটেজি আছে। এই প্রথম ভারতের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল তার সমস্ত সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে, কেন্দ্র ও রাজ্যে তাদের পুরো সরকারি ক্ষমতাযন্ত্র নিয়ে একটা সিনেমার প্রচারে নেমেছে। এই সিনেমা দেখাটাকে একটা নিঃশব্দ রাজনৈতিক আন্দোলনের চেহারা দেওয়া হয়েছে।
ছবিটাকে ঘিরে একটি ধারণা তৈরি করা গেছে যে, এখানে স্বাধীন ভারতের এমন এক রাজনৈতিক গুপ্তকথা ফাঁস করা হয়েছে, যেটা দেখা এবং জানাটা প্রত্যেক ভারতীয় হিন্দুর পবিত্র নাগরিক কর্তব্য! এই প্রচারের এমন মহিমা যে মানুষ সিনেমাঘরে পৌঁছবার আগেই বিশ্বাস করছে, সিনেমায় যা দেখানো হয়েছে ‘সব সত্যি’ এবং আগেকার সমস্ত দুর্বল দ্বিধাগ্রস্ত তোষণবাজ সরকার সেই ‘নির্মম কঠোর সত্যি’কে চেপে রেখে জনগণকে বিভ্রান্ত করে এসেছে।
এই তথাকথিত ‘কমিটেড’ দর্শক দ্য কাশ্মীর ফাইলস-এর প্রামাণ্যতা ও অভ্রান্ততা সম্পর্কে যাঁদের এতটুকু সংশয় নেই, তাঁরাই সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত শেষ হতে না হতেই ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে হুঙ্কার ছাড়ছেন। ছবির তীব্র প্ররোচনামূলক সংলাপে প্রচুর হাততালি দিচ্ছেন। আর ছবির শেষে রীতিমতো হাত ছুড়ে স্লোগান তুলছেন। ইউটিউবেও প্রচুর ভিডিয়ো ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেখানে অস্পষ্ট আধো অন্ধকারে কিছু হইচই বিশৃঙ্খলার ফুটেজ-এর সঙ্গে ধারাভাষ্যে বলা হচ্ছে, এই তো অমুক ছবিঘরে মুসলিম হামলাবাজরা ছবির প্রদর্শনে বাধা দিয়েছিল। ‘হিন্দু’দের প্রতিরোধে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। খেয়াল করে দেখুন, প্রতিবেদনে ‘সাধারণ দর্শকের প্রতিরোধ’ বলা হচ্ছে না, স্পষ্ট করে দাগিয়ে ‘হিন্দু’ কথাটার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। যেন রামমন্দির আন্দোলনের সেই গোড়ার দিকে জোশ আবার ফিরিয়ে আনা— ‘গরব সে বোলো হাম হিন্দু হ্যায়’!
কিন্তু দ্য কাশ্মীর ফাইলস-এর সঙ্গে হিন্দু অস্মিতার এই রাজনীতি এত নিবিড় ভাবে জড়িয়ে গেল কী করে! এই শতাব্দীর প্রথম দশকে ছবির পর ছবিতে সানি দেওল তাঁর ‘ঢাই কিলো কা হাত’-এর রুদ্র প্রতাপ আর মাত্রাছাড়া ডেসিবেল-এ বাছাবাছা পাকিস্তানবিরোধী জাতীয়তাবাদী রণহুংকার দিয়েও সেই সাম্প্রদায়িক ভাগাভাগিটা ঘটাতে পারেননি, যেটা বিবেক অগ্নিহোত্রী পেরেছেন। উড়ি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক-এ চুলদাড়িতে মোদীর মতো দেখতে এক প্রধানমন্ত্রীকে আমদানি করেও, তাঁকে দিয়ে শত্রু প্রতিবেশীর ‘ঘর মে ঘুঁস কর’ মেরে আসা দুঃসাহসী সংলাপ বলিয়েও সেই গণহিস্টিরিয়া তৈরি করা যায়নি যা দ্য কাশ্মীর ফাইলস পেরেছে। এই ছবিতেও এক নৃশংস নরসংহারক জেহাদি মুসলিম সন্ত্রাসবাদীর মুখ দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ব্যাজস্তুতি করানো হয়েছে। বলা হয়ছে, তিনি পণ্ডিত নেহরু, এমনকি অটলবিহারী বাজপেয়ীর মতো নরম মানবিক নন। বরং কট্টর কঠোর। কিন্তু সে জন্যই প্রধানমন্ত্রী ছবিটাকে দরাজ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন বা বিজেপিশাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা প্রমোদকর মুক্ত করে দিচ্ছেন— ব্যাপারটা অত সরল নয়। আসলে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের রক্ত ও অশ্রুতে লেখা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডিকে ব্যবহার করে বিবেক অগ্নিহোত্রী এক ঘৃণার ন্যারেটিভ নির্মাণ করেছেন, যার ডিএনএ হল ‘ইসলামোফোবিয়া’। গত আট বছরে প্রায় গোটা ভারতের শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত হিন্দু জনতার মগজে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ তথা ইসলাম-বিরোধিতা গভীর শিকড় গেড়ে বসেছে। যোগী আদিত্যনাথের ৮০:২০ অনুপাতে এঁদের প্রগাঢ় আস্থা এবং মুসলিমদের ভারতীয় মূলধারার সমাজ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন, কোণঠাসা ও প্রান্তিক করে দেওয়ার প্রক্রিয়াতে অগাধ বিশ্বাস।
গুজরাতের পর হয়তো কর্নাটক এই নিরীক্ষার নতুন আঁতুড়ঘর হতে চলেছে। আর দ্য কাশ্মীর ফাইলস-এর মতো ছবি হয়ে উঠছে ওই নাগরিক সাম্প্রদায়িকতার নয়া বিনোদন। এই ছবিতে কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস, প্রেক্ষিত কিচ্ছু খোঁজার চেষ্টা না করে হিন্দু পণ্ডিতদের দুঃখ-দুর্দশার দায়ভার নারীশিশুবৃদ্ধ-নির্বিশেষে গোটা কাশ্মীরি মুসলিম সমাজ ও সামগ্রিক ভাবে ইসলামের উপরেই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছবি ‘কাশ্মীরিয়ত্’-এর মিশ্র সমন্বয়ী সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে না। বরং ইসলামের ‘নিষ্ঠুর অবৈধ’ অবরোধ থেকে প্রাচীন হিন্দু কাশ্মীরকে উদ্ধার করতে চায়। সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিলোপে তার সূচনা। আর এই ছবিটার আড়াইশো কোটি টাকার বক্স অফিস সাফল্যে তার উদ্যাপন। প্রসঙ্গত, আরএসএস-ও কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে— দু’শো নয়— হাজার বছর পিছন থেকেই লিখতে চায়।