কলকাতার আর জি কর হাসপাতালের মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে ‘জনজাগরণ’ হয়েছিল, বছরের শেষের দিনগুলিতে এসে তা খানিকটা স্তিমিত। এই আন্দোলন থেকে আমরা কী পেলাম আর কী পেলাম না, তার বিশ্লেষণ আগামী বহু দিন চলবে। এ কথা পরিষ্কার যে, এ রকম আন্দোলন এর আগে কলকাতার বুকে হয়নি। মহিলাদের নেতৃত্ব, তাঁদের অংশগ্রহণ থেকে আন্দোলনকারীদের দাবিসনদ— সব কিছুর মধ্যেই প্রগতিশীলতার ছাপ খুব স্পষ্ট ছিল। এই আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েও রাজ্যের বিরোধী দল বিজেপিকে জায়গা করে দেয়নি। এটা কম কথা নয়। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলির বাইরে থেকেও যে প্রগতিশীল গণ-রাজনীতি করা সম্ভব, এই আন্দোলন তা দেখিয়ে দিয়েছে।
বস্তুত, এটি ছিল একটি ‘নাগরিক আন্দোলন’। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম এবং তার পর রেশন অসন্তোষের ভরকেন্দ্র ছিল গ্রাম। গ্রামের উপর নির্ভর করে কলকাতায় সংহতিতে একটি নাগরিক ও ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল। ঠিক একই কথা এক কালের নকশাল আন্দোলন সম্পর্কেও বলা যেতে পারে। কিন্তু, আমাদের আলোচ্য আন্দোলন এখনও অবধি প্রধানত কলকাতা শহর বা শহরতলিতেই সীমাবদ্ধ। এটি একটি শহুরে, মধ্যবিত্ত, ও অভিলাষী শ্রেণির মানুষজনের আন্দোলন। যে সব মহিলা বাড়ির বাইরে কাজকর্ম করছেন, বা করতে উদ্যোগী, তাঁদের আন্দোলন, কারণ, কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষিত থাকার বিষয়টি কেবল আর কথার কথা নয়, বরং একটি বিরাট অংশের মানুষের কাছেই আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ দৈনন্দিন জীবনের প্রশ্ন। আর জি করের ঘটনা এঁদের পরস্পরের কাছে আসতে সাহায্য করেছে। এই রাজ্যে কর্মসংস্থানের হাল, শাসক দলের তোলাবাজি এবং স্বজনপোষণ নিয়ে এই শ্রেণির ক্ষোভ একটা নির্গমন-পথ খুঁজছিল। এ বারের লোকসভা ভোটে এঁদের অনেকেই হয়তো তৃণমূলকে ভোট দেননি, না হলে সব মিলিয়ে তৃণমূলের ফল ভাল হলেও তুলনামূলক ভাবে শহরাঞ্চলের ভোটে কেন টান পড়বে? এই শ্রেণির ক্ষোভ দিনমজুর বা কৃষকদের কিছুটা সহানুভূতি অর্জন করতে পারলেও এটি তাঁদের নিজেদের আন্দোলন ছিল না।
অর্থাৎ, এই আন্দোলনের একটি বিশেষ শ্রেণিচরিত্র ছিল। এটি একটি ‘নাগরিক আন্দোলন’ এই অর্থে। এটি শহুরে পেশাদারদের বিদ্রোহ। তাঁরা চান যাতে স্কুল, কলেজ, হাসপাতালে ‘আইনের শাসন’ রক্ষা পায়।
এই আন্দোলন কিন্তু আগের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান ও সতর্ক এক রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে বোঝাপড়ায় নেমেছে। আন্দোলনের বিরোধিতার প্রত্যক্ষ অভিমুখ রাজ্য সরকারের দিকে— আবার, আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকল আইনবিভাগও। অর্থাৎ, আন্দোলনের গোড়া থেকেই জানা গেল, সমাধানসূত্র যদি মেলে, তা চরিত্রে নিখাদ রাজনৈতিক হবে না। আন্দোলন হলে এই রাজ্য প্রশাসন লাঠি-গুলি চালায় না। বরং, বারংবার আলোচনায় বসতে চায়। একটা কাজ চালানোর মতো সমঝোতা সূত্র খুঁজে বার করার চেষ্টা করে। লাঠি-গুলি-জেল জীবন নষ্ট করে, কিন্তু একই সঙ্গে আন্দোলনের ব্যাপকতা বাড়ায়।
কিছু দিন আগেই আমরা দেখেছি কী ভাবে পুলিশের গুলি বাংলাদেশে একটা আস্ত সরকারের পতন ডেকে আনল। স্মর্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উত্থানের নেপথ্যেও লাঠি-গুলির একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। এই রাজ্য সরকার সে কথা জানে। কাজেই প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে সে দেখে নিয়েছে এই আন্দোলন কত দূর যেতে পারে। একটি আন্দোলনের ভিতর দিয়ে নাগরিক সমাজের কিছু ক্ষোভ যদি বেরিয়ে আসে (তা-ও আবার বিধানসভা নির্বাচনের অনেক আগে), তাতে বর্তমান সরকারের ভবিষ্যৎই পোক্ত হয়।
এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দিয়ে। আন্দোলনের নেতৃত্ব বা অন্য কেউ কোথাও বলে দেননি ‘জাস্টিস’ বলতে তাঁরা কী বোঝাচ্ছেন। আন্দোলনে যাঁরা যোগ দিলেন, তাঁরা ‘জাস্টিস’ বা ন্যায়বিচার নিয়ে তাঁদের নিজেদের যে ধ্যানধারণা, তার ভিত্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ‘জাস্টিস’-এর জ্বর ভয়ানক ছোঁয়াচে। তা শ্রেণি-সমাজ নির্বিশেষে যখন-তখন যাকে-তাকে সংক্রমিত করে ফেলতে পারে। আজকের রাষ্ট্রযন্ত্র সে-কথা জানে। এগারো দিনের মাথায় শীর্ষ আদালত ডাক্তারদের সুরক্ষার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি জাতীয় টাস্ক ফোর্স গড়ে দিল, সিবিআই-কে স্টেটাস রিপোর্ট দাখিল করতে বলল, রাজ্য সরকারকে তুলোধোনা করল এবং আন্দোলনরত ডাক্তাদের কাজে ফিরতে অনুরোধ করল। এই বিন্দুতে এসে একটি কথা নাগরিক আন্দোলনও কার্যত মেনে নিল— মিছিল-মিটিং হতে পারে, স্লোগান-পোস্টারে সৃষ্টিশীলতা ডানা মেলতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচার শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে এজলাস থেকেই, রাজপথ থেকে নয়।
শহুরে শিক্ষিত মানুষের আন্দোলন কোনও বিষয় নিয়ে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে আখ্যান তৈরি করতে পারে, আওয়াজ তুলতে পারে এবং তা গণমাধ্যমের সাহায্যে ছড়িয়ে দিতে পারে। নাগরিক আন্দোলনের সহজ-প্রবহমানতা তার সম্পদ। সে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত না করেই কিছুটা সাফল্য পেতে পারে। সমাজে দুর্নীতি, স্বৈরাচার কিংবা নারী নির্যাতনের মতো ক্ষেত্রে, যেখানে শ্রমজীবী মানুষ শাসক দলের ভয়ে ন্যায্য আওয়াজ তুলতে সাহস পাচ্ছেন না, সেখানে শহুরে নাগরিকদের দিক থেকে, নিজেদের আর্থ-সামাজিক শক্তির কারণেই, কার্যকর ভাবে আওয়াজ তুলতে পারাটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এই একই কাজ কৃষক বা শ্রমজীবী মানুষকে করতে হলে দরকার হয় অনেক বড় আকারের অবরোধের, অনেক বড় গণজাগরণের, ‘আইনের শাসন’-এর গণ্ডির মধ্যে লড়াই করার কোনও উপায়ই থাকে না তাঁদের, আর তাই সমাজ-প্রগতির নিরিখে অনেক বড় সম্ভাবনা নিয়েও হাজির হয় সেটা।
কলকাতার ‘অগস্ট আন্দোলন’ আজ হয়তো স্তিমিত। কিন্তু নির্বাপিত নয়। রাষ্ট্র যেমন দেখে নিয়েছে নাগরিক আন্দোলনটির কত ক্ষমতা, তেমনই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পরখ করে নিয়েছেন ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য কী ভাবে কত দূর এগোনো যায়।