Burma

বাঙালির বর্মা নিষ্ক্রমণ

১৪ মার্চ, ১৯৪২ সারা রাত জেগে ছিলেন বাবা। পর দিন ভোরে উঠে স্নান করে, গরু-বাছুরদের বেশি করে খাইয়ে সেগুলির দড়ি খুলে ছেড়ে দিলেন।

Advertisement

সুব্রত শঙ্কর ভদ্র

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২২ ০৫:০৩
Share:

আজ থেকে আশি বছর আগে, আজকের দিনে— ২৯ এপ্রিল— দেড় মাসের দুঃসহ যাত্রার শেষে আমার বাবা পা রেখেছিলেন ইম্ফলে। সঙ্গে মা, তিন বোন, আর দিদিমা। আজকের মায়ানমার, তখনকার বর্মার জঙ্গল-ভরা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে তাঁদের দুঃস্বপ্নের পথ চলা শেষ হয়েছিল উদ্বাস্তু শিবিরে। আমার মা তখন পূর্ণ গর্ভবতী, কী করে খাড়া পাহাড়, সরু গিরিপথে হেঁটেছিলেন, বৃদ্ধা মাকে পার করিয়েছিলেন সে সব পথ, সর্বোপরি, পথশ্রমে, বিনা চিকিৎসায় মৃত এক কন্যাসন্তানের শোক কী করে বহন করেছিলেন, আজ কল্পনা করাও দুষ্কর। জাপানের বর্মা আক্রমণের জেরে ১৯৪২ সালে কয়েক লক্ষ বাঙালির বর্মা নিষ্ক্রমণ কী করে ভুলবে বাঙালি, কেনই বা ভুলবে?

Advertisement

সুবোধ কুমার ভদ্র, আমার বাবা, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে বর্মা গিয়েছিলেন এক সহপাঠীর আহ্বানে। তাঁরা দু’জনে মান্দালয়ে একটা ডিস্পেনসারি খুলেছিলেন, পরে বাবাই সেটা চালাতেন। প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন লিউ শহরে। ইরাবতী নদীর ধারে তাঁদের কাঠের বাড়ি, চারিদিকে দামি টিক গাছের বন। এই বাড়িতেই তাঁর চার কন্যাসন্তান জন্মায়। শান্ত সংসার জীবনে আগুনের আঁচ লাগল ১৯৪০ সালে, যখন জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিল। ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৪১ রেঙ্গুনে প্রথম বোমা ফেলল জাপানি বিমান। সেই সঙ্গে, এক শ্রেণির স্থানীয় মানুষ বহু দিনের বিদ্বেষ চরিতার্থ করতে হিংস্র হয়ে উঠল শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত ভারতীয়দের উপর। পরবর্তী আট মাসে জাহাজে বা পায়ে হেঁটে ছ’লক্ষ ভারতীয় বর্মা ছাড়লেন।

বাবা জনপ্রিয় ডাক্তার ছিলেন বলে গোড়ায় নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি। কিন্তু ক্রমশ কেরোসিন, খাবার, সবেতেই টান পড়ল। দেশে ফেরার জাহাজে স্থান অকুলান। এয়ার সাইরেন বাজলেই সকলে লুকোতেন আরও নিরাপদ একটা বাড়িতে, সেখানেও চপার হাতে লোকেদের ঘোরাফেরা দেখা গেল। আট বছরের বর্মাবাস গুটিয়ে ফেরার তোড়জোড় শুরু হল।

Advertisement

১৪ মার্চ, ১৯৪২ সারা রাত জেগে ছিলেন বাবা। পর দিন ভোরে উঠে স্নান করে, গরু-বাছুরদের বেশি করে খাইয়ে সেগুলির দড়ি খুলে ছেড়ে দিলেন। সকলে সজল চোখে প্রার্থনা করলেন, যেন ওরা ভাল থাকে। যাত্রা শুরু করেও সকলে ফিরে ফিরে দেখছিলেন নিজেদের কাঠের বাড়িটার দিকে। পথের যা কিছু সুবিধে, খাবার থেকে গাড়ি, সবই দখল করেছে পলায়নরত ব্রিটিশ বাহিনী এবং ইউরোপীয়রা। তাদের তল্পিতল্পা, এমনকি পিয়ানো পর্যন্ত বইতে গাড়ি বরাদ্দ করল ব্রিটিশ সরকার, ভারতীয়দের দিল না। পিছনে জাপানি সেনা, সামনে লুটপাটরত দুর্বৃত্তের দল। জঙ্গলে বুনো শুয়োর, সাপ, হাতি। পোকাক্কু জেলার ১৯৫ কিলোমিটার জংলি পথের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘মরণের পথ’। সঙ্গের খাবার ফুরিয়েছে, ট্রানজ়িট ক্যাম্প থেকে পাওয়া চাল-ডালে একবেলাও চলে না। পথশ্রমে আধমরা মানুষগুলি এক নাগাড়ে এক মাসেরও বেশি হেঁটে ১৭ এপ্রিল পৌঁছলেন ভারত সীমান্তে টামু গ্রামে। সেখান থেকে নাগা পাহাড় পেরিয়ে ঢুকতে হবে ইম্ফলে। সে-ও এক ভয়ানক কঠিন যাত্রা, খাড়াই পথ, বহু জায়গায় রাস্তা অত্যন্ত সরু, জঙ্গলে ভরা।

আট জনের দলটি থেকে প্রথমে হারিয়ে গেলেন কম্পাউন্ডার প্রসন্নবাবু— এক দিন বিশ্রামের জন্য থামলেন, পরে আর তাঁর খোঁজ পাওয়া গেল না। তার পর প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেল সব চাইতে ছোট কন্যাসন্তানটি। রাস্তার দু’ধারে বহু পরিত্যক্ত শিশুকে দেখেছিলেন বাবা-মা, দেখেছেন বহু দেহ। কোনওটায় পচন ধরেছে, কোনওটা খেয়ে গিয়েছে জঙ্গলের জন্তুরা। একটি হিসাবে আশি হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন বর্মা থেকে নিষ্ক্রমণের পথে।

শেষ অবধি যে দিন মণিপুরের সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে মোরে-তে পা রাখল উদ্বাস্তুদের দল, অনেকে দেশের মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, চোখে আনন্দের অশ্রু। সেখান থেকে ইম্ফলের রিফিউজি ক্যাম্প, এখানে আমার মা জন্ম দিলেন এক কন্যাসন্তানের। আর এক কন্যাকে হারানোর শোক বুকে নিয়েই নবজাতককে বুকে তুলে নিলেন তিনি। আটশো কিলোমিটারেরও বেশি যাত্রা করেছেন তাঁরা দেশে পৌঁছতে।

তার পরেও বাকি ছিল ইম্ফল থেকে ডিমাপুর আসার কঠিন যাত্রা। শেষ অবধি অসমে দেখা হয় আমার কাকা সতীশচন্দ্রের সঙ্গে। কাকা অনেক দিন ধরে রিফিউজি ক্যাম্পে বাবাদের খুঁজছিলেন। তাঁকে দেখে মা, দিদিমা কান্নায় ভেঙে পড়েন। অসম থেকে ফরিদপুরের মানিকদহে পৈতৃক বাড়িতে পৌঁছে সে যাত্রা শেষ হয়। যদিও সেই ‘লং মার্চ’ বাবার সারা জীবনের উপর ছাপ রেখে গিয়েছিল। সম্পন্ন, জনপ্রিয় চিকিৎসক হিসেবে যিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন, তিনি কপর্দকহীন, কর্মহীন, সন্তানশোকে সন্তপ্ত এক মানুষ হয়ে যাত্রা শেষ করলেন। অর্থাভাব তাঁকে বেশ কিছু বছর তাড়িয়ে ফিরেছে। এমন নানা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আখ্যানেই বেঁচে রয়েছে আশি বছর আগে বাঙালিদের বর্মা থেকে মহানিষ্ক্রমণের কাহিনি। তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও লেখা হয়নি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement