রাজনীতিতে অনিচ্ছুক, অপারগ, ‘পাপ্পু’— যাবতীয় ইমেজ পাল্টে দিয়ে আরও এক বার আত্মপ্রকাশ করলেন রাহুল গান্ধী। দেশব্যাপী পদযাত্রা বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এল তাঁর অন্তর ও বহিরঙ্গে। চেহারায় এল এক কঠোর রুক্ষতা। তাঁর উদাস ও দ্বিধান্বিত বলার ভঙ্গি হয়ে উঠল ধারালো ও আক্রমণাত্মক। একের পর এক জনসভায় তিনি কংগ্রেসের জনমুখী কার্যক্রমকে সফল ভাবে জনতার সামনে পেশ করতে শুরু করলেন। একচেটিয়া পুঁজির তোষণ থেকে উগ্র হিন্দুত্ববাদ, সব প্রশ্নেই আক্রমণ শাণালেন বিজেপির উদ্দেশে। এবং, গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে ফেললেন এক দশক ধরে বিজেপির তৈরি করা এই ন্যারেটিভটিকে যে, তারা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই— ইন্ডিয়া জোটের বিকল্প রাজনীতির যে পরিসর তৈরি হল, তাতে রাহুলের অবদান ও গুরুত্ব নেহাত কম নয়। জোট জয়ী না হলেও তার মতাদর্শগত অস্মিতা ক্রমশ জনতার মনে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করল।
নির্বাচনের আগে সাধারণ মানুষের দুর্গতি প্রসঙ্গে রাহুল বলেছিলেন, ‘কংগ্রেসও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়’। এই কথায় দু’টি উদ্দেশ্য সাধিত হয়। এক, এ কথা মনে করিয়ে দেওয়া যে, ভবিষ্যতে যে কংগ্রেস আসছে তা অতীতের কংগ্রেস নয়। তিনি সেই পুরনো পার্টির গুরুভার বইতে আর রাজি নন। দ্বিতীয়ত, তিনি মহাত্মা গান্ধী বা জয়প্রকাশ নারায়ণের ঢঙে নিজেকে দল থেকে যেন কিছুটা বিযুক্ত করে নিলেন, যাতে কোনও আন্দোলনে শামিল হতে তাঁকে দলের মুখাপেক্ষী হয়ে না-থাকতে হয়। দেশে-বিদেশে এখন গণ-আন্দোলন সংঘটিত হয় জনতার নিজস্ব উদ্যোগে, পার্টি-পরিসরের বাইরে।
বস্তুত, বর্তমান কংগ্রেস দলকে তিনি পুরনো কংগ্রেসের উত্তরাধিকার হিসাবে যত-না দেখছেন, তার চেয়েও বেশি দেখছেন কংগ্রেসের বর্তমান ইস্তাহার ‘ন্যায় পত্র’কে সফল করে তোলার এক মাধ্যম হিসাবে। অর্থাৎ অতীত নয়, ভবিষ্যতের সুরে বাঁধতে চাইছেন রাজনীতিকে। সমতা ও সামাজিক ন্যায়ের উপরে ন্যস্ত ‘ন্যায় পত্র’ভিত্তিক নয়া কংগ্রেসি কার্যক্রম আসলে বিজেপির রাজনীতির এক বিকল্প মতাদর্শের অনুসন্ধান। মোদী চাইছেন সম্পদের বেলাগাম আহরণ, ‘ন্যায় পত্র’ চাইছে বণ্টন। মোদী দাঁড়াচ্ছেন নব্য অভিজাততন্ত্রের পাশে, ‘ন্যায় পত্র’ দাঁড়াচ্ছে কৃষক, বেকার মধ্যবিত্তের পিছনে। মোদী চাইছেন যে কোনও প্রশ্নেই ভারতের একটিমাত্র পরিচিতিতে স্থিতি, ‘ন্যায় পত্র’ চাইছে তার বহুত্ব। মোদীর রাজনৈতিক সমাজ মুখ দেখে মনুবাদের আয়নায়, ‘ন্যায় পত্র’কে কেন্দ্র করে নতুন যে রাজনৈতিক সমাজ দানা বাঁধতে চায় তার ভর রয়েছে যুক্তি, বুদ্ধের নিরীশ্বরবাদ ও গান্ধীর অহিংসায়।
বর্তমান লোকসভায় রাহুলের বক্তৃতাতেও শুধু ইতিবাচকতার সুর। শুধু প্রতিপক্ষের খুঁত খুঁজে বেড়ানো নয়, নতুন দিগন্তের সন্ধান। রাহুল বক্তৃতা দিতে উঠতেই বিজেপির সাংসদরা যখন ‘মোদীজি কি জয়’ বলে ধ্বনি তুলে রাহুলকে বসিয়ে দিতে ব্যস্ত, তখন লাল মলাটে মোড়া সংবিধানটি তুলে ধরে শান্ত গলায় রাহুল বললেন: ‘জয় সংবিধান’। জোঁকের মুখে যেন নুনের ছিটে পড়ল। তাঁর বক্তৃতাগুলি এখন লক্ষ্যে অব্যর্থ, অথচ কৌতুক ও ব্যঞ্জনায় ভরপুর। ইঙ্গিতধর্মী এই ভাষায় ব্যাজস্তুতি বা শ্লেষের উপস্থিতি লক্ষণীয়: অর্থাৎ শব্দ দিয়ে যা বলা হচ্ছে, বক্তব্যের নিগূঢ় অর্থটি ঠিক তার বিপরীত। যেমন প্রধানমন্ত্রী যে পরমাত্মার অংশ (তাঁর নিজেরই লব্জে), তার সত্যতা প্রতিপন্ন করার অছিলায় রাহুল তুলে ধরেন কয়েক জন পুঁজিপতির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ পক্ষপাত। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন: “আমাদের, বিরোধী পক্ষের কাছে ক্ষমতা দখলটাই সব নয়, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সত্যে পৌঁছনো। কিন্তু বেচারি আপনারা সরকার পক্ষ, আপনাদের কাছে ক্ষমতা ছাড়া আর দ্বিতীয় কিচ্ছুটি নেই।” তাঁর ভাষণে উপমা রূপকের ছড়াছড়ি। অভিমন্যু-ঘাতী ‘চক্রব্যূহ’— যার আর এক নাম ‘পদ্মব্যূহ’— তার রূপকের মাধ্যমে বিজেপির রাজনীতির ভয়ঙ্করতাকে ফুটিয়ে তোলেন অনায়াসে। বিজেপির মোকাবিলা করেন বিজেপিরই অস্ত্রে, ধর্মীয় প্রতীকের মাধ্যমে।
বিগত এক দশকে খোয়া যেতে বসা গণতান্ত্রিক পরিসরটিকে রাহুল যেন তাঁর বাগ্মিতা, উদারবাদের মাধ্যমে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। ক্ষমতা দখল নয়, যেন তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য হৃত গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার। তা করতে হলে প্রতিপক্ষের একচেটিয়া আধিপত্যের খেলাটা ঘুরিয়ে দিতে হবে। প্রতিপক্ষকে শত্রু ভাবলেই খেলাটা কিন্তু ভেস্তে যাবে, ফাঁদে পা পড়ে যাবে। তাই দেশের সমস্যা সমাধানের জন্যে রাহুল সরকারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে চান। এই আহ্বান বিজেপির পক্ষে শাঁখের করাত। যে দলের অন্দরে পরমতসহিষ্ণুতার অভাব, বিরোধী মতকে সে কোথায় স্থান দেবে! আবার আহ্বানে সাড়া না দিলে স্বৈরাচারের অভিযোগ হাতেনাতে প্রমাণিত।
তবে, এখনও সরকার পক্ষের জনপ্রিয়তা বিরোধীদের চেয়ে বেশি। তাই বিরোধী শিবিরকে ধ্যানজ্ঞান করতে হবে নিজস্ব পরিসর বাড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ছাপিয়ে যাওয়া। জনমুখী কার্যক্রম সামনে রেখে একটা স্পষ্ট বিকল্প বয়ান তৈরি তো আছেই, তার সঙ্গে প্রয়োজন আবেগ। সেই আবেগের উৎস কী হবে? সে জন্যই কি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আকর সংবিধানের উপরে বাজি ধরেছেন রাহুল? সে জন্যই কি বার বার লাল মলাটের বইটা তুলে ধরছেন জনসভায়, সাংবাদিক সম্মেলনে, সংসদে? নৈতিক ও নান্দনিক স্তরে হিন্দুত্ব-অস্মিতার গরিমাকে ছাপিয়ে এই নতুন ন্যারেটিভের শ্রেষ্ঠত্ব অবয়ব ধারণ করতে পারবে কি এই গ্রন্থটিতে? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ। কিন্তু জিততে যদি হয়, তবে হিন্দুত্বের বিকল্প অস্মিতা নির্মাণ ছাড়া কোনও গতি নেই— যাকে ঘিরে আরও বেশি সংখ্যক প্রান্তিক ও নিগৃহীত মানুষ গৌরব বোধ করবেন নতুন ছাতার নীচে দাঁড়াতে।