আপনাদের তো আবার ছুটি? ভালই আছেন আপনারা টিচাররা…” ২ জানুয়ারি, ২০২২। বছরের শুরুতে প্রশাসনের তরফে ঘোষণা করা হয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধিনিষেধ, তার মধ্যে সরকারের তরফে নেওয়া অন্যতম প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ রাজ্যের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।
এই পর্যন্ত শুনেই শুরু হয়ে গেল নানান ডিজিটাল রসিকতা। মদ্যপান ও শিক্ষার তুলনামূলক গুরুত্ব, যেখানে রেস্তরাঁ খোলা সেখানে স্কুল-কলেজ কেন নয় ইত্যাদি। তার পর, অবশ্যম্ভাবী সমালোচনার তির ঘুরে যায় শিক্ষকদের দিকে। কী ভাবে তাঁরা করোনার এই পুরো সময়কাল কোনও কাজ না করে বসে বসে মাইনে পেয়েছেন, তাঁরা কত বেশি মাইনে পান ইত্যাদি। শিক্ষক, অন্তত সরকারি শিক্ষক, সরকারি অধ্যাপকদের মাসমাহিনা বেতন কমিশনের নিয়ম ইত্যাদি ধরে নির্ধারিত হয়। অন্য সরকারি কর্মচারীদের বেতন যদি চক্ষুশূলের কারণ না হয় তা হলে শিক্ষকদের কেন হবে, তা বোধগম্য হয় না।
২ জানুয়ারির সরকারি নির্দেশাবলি এক বার নির্দিষ্ট ভাবে দেখে নেওয়া দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ— এই পর্যন্ত সকলের চোখে পড়েছে, তার ঠিক পরে উল্লিখিত পঙ্ক্তিটি পড়েনি। সেখানে স্পষ্ট ভাবে বলা আছে অনলাইন পড়াশোনা চলবে। অনলাইন পড়াশোনা সম্পর্কে নানা আলোচনা, মত শুনতে পাওয়া যায়। তবে যে বিষয়টি নিয়ে সম্ভবত কেউ কথা বলার সময় করে উঠতে পারেননি, শিক্ষকরাও নিজেদের কথা স্পষ্ট ভাবে বলে উঠতে পারেননি, তা হল কত কষ্ট করে, কত চেষ্টায় এই অনলাইন পড়ানো শিখতে হয়েছে তাঁদের। তাঁরা বিষয়টি জানতেন, ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে কী ভাবে অঙ্কটি কষে ফেলতে হয় জানতেন। হঠাৎ তাঁদেরই বলা হল, কম্পিউটার খুলে, হোয়াইট বোর্ড জাতীয় একটি বিষয় খুলে সেই অঙ্ক করে ফেলতে। কত শিক্ষকের যে কত রকম বিড়ম্বনার কথা শুনেছি। সে সব কথা তাঁরা মুখ ফুটে বলতে পারেননি। শিক্ষক বলে কথা। শরীর খারাপ, মন খারাপ সব ঢেকে ছাত্রছাত্রীর সামনে হাসতে হয়। না হলে তারা ভেঙে পড়বে যে।
ছাত্রছাত্রীদের আন্তর্জালের অসুবিধার কথা, সেই সুবিধা না থাকার কথা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য আন্তর্জালের অসুবিধা শিক্ষক অধ্যাপকদেরও হয়, হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, আর্থিক অসুবিধার সমস্যা তাঁদের ক্ষেত্রে হয়তো প্রধান সমস্যা নয়, কিন্তু এক জন শিক্ষকের অনলাইন পরীক্ষা বা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের ক্ষেত্রে ঠিকমতো আন্তর্জাল বা ইন্টারনেট যোগাযোগ না-হতে পারা, প্রশ্নপত্রটি ছাত্রছাত্রীর হাতে আদৌ পৌঁছবে কি না, তাই নিয়ে অনিশ্চয়তার আতঙ্ক, পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর পৌঁছে দেওয়ার পোর্টাল কাজ করা বা না-করার আতঙ্ক— যিনি ভুক্তভোগী তিনিই শুধু জানেন। আপনি জানেন কম্পিউটারের ও-পারে বসে আছে আপনার কলেজের ছাত্রছাত্রীরা— আপনি শিক্ষক হয়ে বুঝতে পারছেন তাদের উৎকণ্ঠা। অথচ, আপনার কিছু করার নেই।
হয়তো এ যুক্তি যথেষ্ট নয়। হয়তো এর প্রত্যুত্তরে কেউ বলবেন প্রযুক্তির শিক্ষা প্রয়োজন ছিল বা যথেষ্ট অর্থ আছে শিক্ষকদের, তাঁদের উন্নত মানের আন্তর্জালের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। সত্যিই কি সময় ছিল, প্রযুক্তি শিক্ষার? আর শিক্ষকরা তো হাল ছেড়ে দেননি। বয়স্ক শিক্ষকরাও শিখে নিয়েছেন, পড়ানোর চেষ্টা করছেন। এমনকি নতুন করে খোলা স্কুল-কলেজে যখন ব্লেন্ডেড পদ্ধতি বা অনলাইন-অফলাইন মেশানো পড়ানোর নির্দেশ এল, তাও যথাযথ ভাবে পালন করার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। তখনও কি কোভিড সংক্রমণের ভয় ছিল না? লোকাল ট্রেনে আসা তাঁর ছাত্রছাত্রীরা যখন না-বোঝা পড়া বুঝে নেওয়ার জন্য তাঁর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে, তিনি হয়তো তাদের কোভিডবিধি মেনে চলার মৃদু ধমকটুকুই দিয়েছেন, সত্যি সরিয়ে দিতে পেরেছেন কি? এ বন্ধন, যিনি শিক্ষক নন তাঁকে বোঝানো সম্ভব নয়। আর এখন এই ভীষণ সঙ্কটের সময়ে, সত্যিই কি ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে আছেন তাঁরা?
বাস্তবটা দেখে নেওয়া যাক। অফলাইন পড়ানোর কাজ হয়তো বন্ধ, কিন্তু অনলাইন পড়ানো ছাড়া অসংখ্য প্রশাসনিক দায়িত্ব থাকে শিক্ষকদের। কন্যাশ্রী, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড, ঐক্যশ্রী, স্বামী বিবেকানন্দ স্কলারশিপ, মিড-ডে মিল প্রকল্প ইত্যাদি নানা সরকারি প্রকল্পের সুবিধা যাতে ছাত্রছাত্রীরা যথাযথ ভাবে পায়, তার জন্য সরকার যেমন উৎসুক, তেমনই সমান পরিশ্রম করেন শিক্ষকরা। ছাত্রছাত্রীদের যাতে আসতে না হয়, অথচ তারা এই অর্থবর্ষে সুবিধা পায়, তার জন্য ঝুঁকি নিয়েও কলেজে পৌঁছচ্ছেন তাঁরা। যাঁরা সরকারি নির্দেশের প্রসঙ্গে রসিকতা করছেন, তাঁরা হয়তো আর একটি পঙ্ক্তিও লক্ষ করেননি। প্রশাসনিক কাজে, রোস্টার অনুযায়ী ৫০ শতাংশ হাজিরাতে পৌঁছচ্ছেন শিক্ষক, অধ্যক্ষ, অন্যান্য সরকারি অফিসার, সামনের সারির যোদ্ধাদের মতোই। অসুস্থও হচ্ছেন একের পর এক।
আপনি হয়তো জানেন না এ যুদ্ধের খবর, আপনার সন্তান জানে। তারা চেষ্টা করছে তাদের সাধ্যমতো, স্যর, ম্যাডামদের যাতে অসুবিধা না হয়। তাদের থেকে জেনে নেবেন। আর, যদি সম্ভব হয়, খবর নেবেন আপনার চেনা শিক্ষক, অধ্যাপক মানুষটি বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা কেমন আছেন?