ভাষা যত না লেখায় বাঁচে তার থেকে বলায় বাঁচে অনেক বেশি। কারণ খুব সোজা— যে কোনও ভাষার ক্ষেত্রেই, অন্তত আমাদের মতো দেশে, পড়তে জানা মানুষের চেয়ে পড়তে-না-জানা মানুষ সংখ্যায় বেশি। তাঁদের কথায় কথায় ভাষা বেগবান। যাঁরা পড়তে জানেন না তাঁরা অশিক্ষিত, এই ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। পড়তে-না-জানা মানুষের থাকে কাজের নিজস্ব শিক্ষা-দীক্ষা। কথাটা সবাই স্বীকার না করলেও অনেকেই কিন্তু করতেন। ভাগ্যিস করতেন। শ্রমনিষ্ঠ অক্ষরজ্ঞানহারা মানুষের বোধ যে কত গভীর হতে পারে তা ফরাসি ভাষা-বিশেষজ্ঞ, বাংলা ভাষার এক কালের
কফিহাউস-ইন্টেলেকচুয়ালদের আইকন কমলকুমার মজুমদার জানতেন। কফিহাউস-ইন্টেলেকচুয়ালদের নিয়ে, আধুনিকতার গর্বে মকমক করা কবিদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কমলকুমার ফুট কাটতে দ্বিধা করেননি। তিনি মানতেন, অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাসে যে বৈজু চাঁড়ালকে তিনি গড়ে তুলেছেন তা বাংলা ভাষার মুখের জগৎ থেকে রস ও রসদ সংগ্রহ করার ফল, বাংলা ভাষার মুখের সেই জগতের সঙ্গে কলকাতার কোনও সম্পর্ক নেই। উনিশ শতকের কলকাতার শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা শ্রীরামকৃষ্ণের মুখের ভাষায় কান পাততেন— বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, শিবনাথ শাস্ত্রী, কে নেই! কমলকুমার রামকৃষ্ণের শ্রীমুখের ভক্ত, সে তো আর এমনি এমনি নয়। রামকৃষ্ণদেবের ভাষা গ্রামের ভাষা— প্রমিত ভাষার ঠাট তাতে নেই, চিন্তার বোধের দীপ্তি আছে। চিন্তাবিদ প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য বাংলা জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মুখের ভাষাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তাঁর অভিমত, বাংলা ভাষার পরিভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে ঠান্ডাঘরে বসে থাকা ভদ্রলোক পণ্ডিতদের সাহায্য নিলেই কেবল চলবে না, যেতে হবে খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে। তাঁরা কেবল শ্রমনিষ্ঠ নন, রাজমিস্ত্রি-কামার-ছুতোর কাজের সূত্রে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সময় নানা বিশেষার্থক শব্দ ব্যবহার করেন। পরিভাষা নির্মাণে তা কাজে লাগানো উচিত। ভাষার উপর থেকে তলায় নামলেই শুধু হবে না, তলার থেকে উপরে ওঠার পথও কাটা চাই। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তো হাঁটতে পারলেই কবিতা লিখতে পারতেন, পথে না নামলে, সাধারণের কথা কানে না তুললে পদাতিক কবি লিখবেন কেমন করে!
বলার বাংলা কেবল মানুষের মুখে ভর করেই ছোটে না, তা টিভি-রেডিয়ো বাহিত হয়ে মানুষের কানে যায়— বলার ভাষার ক্ষেত্রে এই মাধ্যম দু’টির গুরুত্ব অপরিসীম। রেডিয়ো পুরনো, টিভি তুলনায় অর্বাচীন। যখন আমাদের গণমাধ্যমে এমন ব্যাঙের ছাতার মতো অ-সরকারিকরণ ঘটেনি, কলকাতা দূরদর্শন ও আকাশবাণীর সংবাদ-পাঠক, অনুষ্ঠান-সঞ্চালকরা তখন যত্ন করে বাংলা বলতেন। যত্ন-শিক্ষা-অনুশীলন ভাষা-প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলা বলার ক্ষেত্রে যে জরুরি, এই বোধ তাঁদের ছিল। এ কথা ভাবার দরকার নেই যে গণমাধ্যমে মান্য বাংলা বলতেই কেবল যত্ন লাগে। পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় নানা রকম বাংলা, সে বাংলাও কিন্তু যত্ন করেই শিখতে হয়। তরুণ মজুমদারের গণদেবতা-য় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেখানে সে ভাবেই বাংলা বলেছেন যে ভাবে বীরভূমের দেবু চরিত্রটি কথা বলে। গণদেবতা-র জন্য সৌমিত্রকে আলাদা করেই শিখতে হয়েছিল সে রকম কথা বলা। বাংলা ভাষার মান্য একটি রূপ যেমন শিখতে হয়, তেমনই বাংলা ভাষার মুখের বিভিন্ন ভেদকেও জানতে-বুঝতে হয়— ভেদগুলিকে ভেংচি কাটলে চলে না।
এখনকার গণমাধ্যমে বিকল্প অনেক, এক চ্যানেল থেকে দ্রুত আর এক চ্যানেলে আপনি বিহার করতে পারেন। কানে না সইলে, চোখে না ধরলেই বদলে ফেলুন। তবে যেখানেই যান বলার বাংলার কতকগুলি লক্ষণ আপনার চোখে পড়বে। সঞ্চালকেরা খুব দ্রুত কথা বলতে চান। কোন ধ্বনির উপর তিনি শ্বাসাঘাত দেবেন, তা শব্দের অর্থের উপর বা ধ্বনি বিন্যাসের উপর নির্ভর করছে না, তাঁর বলার গতির উপর নির্ভর করছে। বাংলা শব্দের মধ্যে ইংরেজি শব্দের ও হিন্দি শব্দের অহেতুক মিশেল— সে মিশেলে বোধ-বুদ্ধির থেকে ভাবনাহীন যান্ত্রিকতা অনেক বেশি ক্রিয়াশীল। তাঁদের মুখের ভাষা অনেকটা শ্রীজাতর লেখা ‘জনৈক বাঙালির বক্তব্য’ কবিতাটির সমগোত্রীয়। সে কবিতার বাঙালিটি বলেছিল, “আমার কান্ট্রির মতো কান্ট্রি নাই টোটাল ভুবনে।/ তারও মধ্যে, দেখতে গেলে, ওয়েস্ট বেঙ্গল ইজ দি বেস্ট।/ কালচারই বলো আর আর্টই বলো, আনবিলিভেবল্!/... হ্যা, মানছি পোভার্টি আছে, ডার্টি পলিটিক্স আছে, তবু/ ইংরেজিতে না চেঁচিয়ে, বুকে হাত দিয়ে বলো দেখি— / বেঙ্গলী ভাষার মতো সুইট ভাষা আছে, পৃথিবীতে?” শ্রীজাতর কবিতাটি ২০০১-২০০২ নাগাদ লেখা। তার পর তো অনেক দিন কেটে গেল। শ্রীজাত ভাষার এই ভঙ্গিটি নিয়ে মশকরাই করেছিলেন। এই ভাষাটা যে বিরক্তিকর ও কৌতুকের কারণ তা অ-সরকারি গণমাধ্যম ভুলে গেল। এর ফলে নগরের ভদ্রলোকদের ভাষা, ও তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট গণমাধ্যমের ভাষা যত্নহীন, অনুশীলনহীন, দ্রুতগতিসম্পন্ন, বেজায়গায় শ্বাসাঘাত-প্রধান ইংরেজি-হিন্দির মিশেল হয়ে উঠল।
এই ভাষা মানুষের আবেগকে মর্যাদা দেয় না। যে ভাবে প্রেম-পরিণয়-সাফল্যের-আনন্দের খবর পরিবেশন করা হয় সেই একই ভাবে শোক-দুঃখ-দুর্ঘটনার সংবাদ বিতরণ করা হয়। ভঙ্গি ও ভাষা এক, অথচ যা পরিবেশন করা হচ্ছে তা এক রকম নয়। এর থেকে বোঝা যায় এই যান্ত্রিক আপাত-স্মার্ট পরিবেশনভঙ্গি মানুষের আবেগকে, আবেগের বিভিন্নতাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। যা বিভিন্নতাকে স্বীকার করে না তা সন্ত্রাসের পথই প্রস্তুত করে। সন্দেহ নেই এ এক রকম ভাষা সন্ত্রাস। আনন্দ-শোক, সাফল্য-দুর্ঘটনা— এ ভাষার কাছে সব কিছুই ইভেন্ট মাত্র। যে ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি মানুষের নানা আবেগকে মূল্য না দিয়ে সব কিছুকেই ইভেন্ট বলে ভাবে, সেই ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্য না দেওয়ার দর্শনে অনুগত— জ্ঞাতসারে ও অজ্ঞাতসারে এই আনুগত্যকে মেনে নিয়ে সকলেই কিন্তু মনে মনে স্বৈরাচারী হয়ে উঠছি। তা ছাড়া বলার এই ভাষা গতি, শ্বাসাঘাত ও ভঙ্গি বজায় রাখার জন্য যে কোনও বিষয়কে দরকার মতো কেটে ছেঁটে নেয়, অর্থাৎ বিষয় নয় প্রকাশভঙ্গিটাই মূল। এ অনেকটা হাল-ফ্যাশনের জামা পরার মতো। জামা পরবেন বলে আপনি জামার মাপে শরীরটাকে খাটো করছেন। তার পর সেই মানানসই জামার মাপে শরীরটাকে ঢোকানোর পর যে যে কথা বলা দস্তুর, যে যে আবেগ প্রকাশ করা রীতি সেটুকুই করছেন। আপনার যা কিছু স্বাভাবিক ইচ্ছে তা অবদমিত ও লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
এই যে নাগরিক ভাষাপন্থা, এটাকে আঘাত করার জন্য এরই বিপরীতে আপাত-অকথ্য শব্দের সমাবেশে, শারীরিক ভঙ্গি-সহ রাগ প্রকাশের আর একটা ভাষা তৈরি হয়ে উঠেছে— তারও বয়স হল। সে ভাষা সর্বত্রই কানে আসে, কিন্তু সে ভাষাও কি বেশি দূর যায়? কমলকুমারের বৈজু চাঁড়ালের বাক্ভঙ্গি ও অনুভবের মধ্যে যে রাগ ছিল তা যান্ত্রিক নয়— বস্তুত শুধু রাগ ছিল না, জীবনের প্রতি অনুরাগও ছিল। নাগরিকতার বাইরে যে বিস্তৃত বঙ্গভূমির অবস্থান, যেখানে নানা বৃত্তির নানা বর্ণের প্রান্তিক মানুষেরা থাকেন, জীবন সম্বন্ধে তাঁদের বোধ যে বিচিত্র ভাষাভঙ্গিতে প্রকাশিত হত, তা এই গালাগালাত্মক শরীর-সর্বস্ব ক্রোধের ভাষার মতো নয়। এই কৃত্রিম ভাষা বাংলার বিচিত্র লোকায়ত জীবনকে জিভ দেখাচ্ছে। সহজিয়া সাধকেরা বলতেন ‘সে দেশে এ দেশে মিশামিশি আছে’। কথাটা গভীর। চটুল শরীরের কথা বলতে বলতে কখন যে সহজ-সাধক গভীর মর্মে প্রবেশ করে যেতেন। এই ভেংচি-কাটা কৃত্রিম গালাগালের ভাষা তা পারে না। তা হলে কী করব আমরা? প্রথমেই স্বীকার করে নেব বলার বাংলা এক রকম নয়, নানা রকম। সেই বাংলায় নানা আবেগ প্রকাশ করা সম্ভব, জ্ঞান ও যুক্তির নানা দিক তুলে ধরা সম্ভব। ভঙ্গির টানে স্মার্টনেসের অলীক স্বপ্নে আমরা যত ভাবছি এ ভাবে বললেই বুঝি আমাদের কথা পৌঁছে যাচ্ছে, ততই ভুল করছি। পৌঁছচ্ছে না, সবটাই এক আশ্চর্য তরল গতিময় ভঙ্গি, হয় যান্ত্রিক হাস্য নাহয় মার-মার ক্রোধ। এই হাস্য আর ক্রোধের সন্ত্রাসে বলার বাংলা ক্রমশই তার সামর্থ্য হারাচ্ছে। বাংলা ভাষার গ্রাম, মফস্সল, শহরের অলিগলির অধিকার হেঁটে দেখতে না শিখলে, সেখানকার কথা কানে না তুললে নববর্ষ যাবে-আসবে, নিজের তৈরি করা ভাষা-সন্ত্রাসের হাত থেকে বাঙালি বাঁচবে না।
তবে সেখানেও একটা প্রশ্ন মাথা তুলবে। বাংলা ভাষার গ্রাম, মফস্সল, শহরের অলিগলির মানুষদের ভাষার নিজত্ব কি আর কিছু অবশিষ্ট আছে, না কি ভাষাসন্ত্রাস কবলিত বাংলার গ্রাম-মফস্সল-কলকাতার প্রান্ত টিভি-রেডিয়োর বুলিই কপচাচ্ছে! পথই তার উত্তর দেবে।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী