রাত কেটেছিল রাস্তায়, তাঁরও। মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থার প্রতিবাদে ধর্নায় বসেছিলেন নয়াদিল্লির যন্তর মন্তরে। পুলিশের টানাহেঁচড়াতেও হাতের ত্রিবর্ণ পতাকা ছাড়েননি। আর গত ১৪ অগস্ট মধ্যরাতের খানিক আগে প্যারিস অলিম্পিক্স থেকে বিনেশ ফোগতের পদকের আশা যখন নিবে গেল, পশ্চিমবঙ্গে মেয়েরা তখন আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে ‘রাত দখল’-এর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁদেরও অনেকের হাতে তখন জাতীয় পতাকা।
নির্ধারিত ৫০ কেজির চেয়ে মাত্র ১০০ গ্রাম ওজন বেশি থাকায় অলিম্পিক্সে কুস্তির ফাইনালে উঠেও প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে গেলেন বিনেশ। পর পর তিনটি লড়াই লড়ে ফাইনালে ওঠার দিনে যে-হেতু বিনেশের ওজন ৫০ কেজির মধ্যেই ছিল, তাই অন্তত রৌপ্যপদকের আর্জি জানিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে গিয়েছিলেন তিনি। ১৪ অগস্ট সেই আদালতই বিনেশের আবেদন খারিজ করে দিল। বিনেশের সঙ্গে ‘কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্র’ হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলে সম্প্রতি যে সমাজমাধ্যম সরব ছিল, সেখানেই কোথায় হারিয়ে গেল এই খবর।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির চেয়ারম্যান টমাস বাখ অবশ্য আগেই বলেছিলেন, নিয়মের নড়চড়ের প্রশ্ন নেই। ফাইনালের আগে কৌশলে ওজন বাড়িয়ে নেওয়া আটকাতেই রোজ ওজন মাপার নিয়ম চালু হয়েছিল অলিম্পিক্সের ওজনভিত্তিক ইভেন্টগুলিতে। পুরুষদের কুস্তির ৫৭ কেজির বিভাগে ব্রোঞ্জজয়ী, ভারতের আমন শেরাওয়াতের ওজন ম্যাচের আগের রাতে ৪.৬ কেজি বেড়ে গিয়েছিল। কোচেরা রাত জেগে আমনকে ট্রেনিং করিয়ে দশ ঘণ্টায় সেই ওজন নামিয়ে এনেছিলেন ৫৭-র নীচে। বিনেশের ক্ষেত্রে সেটাই করা গেল না।
শরীরের জলীয় পদার্থ কমিয়ে ওজন ঝরাতে অনেক সময়ে তিন দিনে এক কাপ জল খাইয়ে রাখা হয় কুস্তিগিরদের। তবু বিনেশের ফাইনালে ওঠার দিনে তিনটি লড়াইয়ের ফাঁকে সামান্য জল আর খাবার তাঁকে খাওয়াতেই হয়েছিল, না হলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কিন্তু এতেই বিনেশের ওজন প্রায় দুই কেজি বেড়ে যায়। বিনেশের ফাইনালে ওঠার খবর পেয়েই আমরা যখন সমাজমাধ্যমে জবরদস্ত পোস্ট ছেড়ে, নৈশভোজ সেরে ঘুমিয়েছি, বিনেশ তখন তাঁর উপোসক্লান্ত, ধ্বস্ত শরীরটা থেকে আরও ঘাম ঝরাতে নেমেছিলেন। তার পর, ফাইনালের আগে সারা রাত স্কিপিং, সাইক্লিং, সওনা বাথ-এ ওজন না কমলে তাঁকে শরীর থেকে রক্ত বার করার তোড়জোড়ও করতে হবে। মাথার চুল, কুস্তির পোশাক কেটে ছোট করাতে হবে। ছিটকে যাওয়ার পরেও হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
বিনেশের স্বাভাবিক ওজন ৫৫-৫৬ কেজির আশেপাশে, ৫৩ কেজির বিভাগে তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক পদকজয়ী। তাঁকে কেন অলিম্পিক্সে ৫০ কেজির বিভাগে লড়তে হল? ২০১৬-র রিয়ো অলিম্পিক্সে তিনি লড়েছিলেন ৪৮ কেজির বিভাগে, বয়স বাড়তে বেশি ওজনের বিভাগে যোগ দেন। ৫৩ কেজির বিভাগে ২০২২ কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জেতেন, সে বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে পান ব্রোঞ্জ। এর পরেই ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের তৎকালীন প্রধান ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগে বিনেশ, সাক্ষী, বজরং পুনিয়াদের রাস্তায় নামা। কুস্তি থেকে সাময়িক বিরতি ও লিগামেন্টের চোট অনেকটাই অনিশ্চিত করে দেয় বিনেশের ভবিষ্যৎ।
এ দিকে, ২০২৩ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৫৩ কেজির বিভাগেই ব্রোঞ্জ জিতে অন্তিম পঙ্ঘাল অলিম্পিক্সের ভারতীয় দলে জায়গা পেয়ে যান। অন্তিমের কোচের বক্তব্য, নিয়ম অনুযায়ীই অলিম্পিক্সের কোটা অর্জন করেছেন তিনি। কোনও অস্বচ্ছতা নেই। বিভিন্ন সূত্রের দাবি, সেই সময়ে দেশের কুস্তি সংস্থা চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত অ্যাড-হক কমিটির কাছে বিনেশ এই আশ্বাস পেয়েছিলেন যে, ৫৩ কেজির বিভাগে অলিম্পিক্সে কে লড়বেন, তা নির্ধারণে ট্রায়াল নেওয়া হবে। কিন্তু কুস্তি সংস্থার নতুন বোর্ড গঠনের আবহে তিনি ক্রমশ বোঝেন, ট্রায়ালের সম্ভাবনা ক্ষীণ। অলিম্পিক্সে অপেক্ষাকৃত বেশি ওজনের প্রতিদ্বন্দ্বীদের এড়াতে ৫০ কেজির বিভাগই বেছে নেন বিনেশ। নিতে হয় ওজন কমানোর চটজলদি রাস্তা।
অলিম্পিক্স ফাইনাল থেকে বিনেশ বাতিল হওয়ার পরেই ঝড় বয়ে যায় দেশের ক্রীড়ামহল থেকে সংসদ ভবনে। কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী সংসদে বিনেশের ট্রেনিংয়ের খরচের ফিরিস্তি দিলেও প্রশ্ন ওঠে, এই নিশ্চিত পদককে রক্ষা করতে কি বাড়তি যত্নশীল ছিলেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ? কুস্তি মুলতুবি রেখে ধর্নায় বসতে গিয়েই যদি বিনেশকে নিয়মের ফাঁসে ৫৩ কেজির বিভাগ হারাতে হয়, তা হলে তাঁর রাস্তায় নামার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল কেন?
গত বছরের ধর্নার সময়ে এক সাক্ষাৎকারে বিনেশ বলেছিলেন, অতীতে অলিম্পিক্সে মহিলা কুস্তিগিরদের সঙ্গে ফিজ়িয়ো না পাঠিয়ে সফরে গিয়েছিলেন কুস্তি সংস্থার শীর্ষ পদাধিকারী। সে বার দু’দিন ধরে এক ফোঁটাও জল না খেয়ে তিনি যখন ওজন কমাচ্ছিলেন, পাশে কাউকে পাননি। এ বার বিনেশ ছিটকে যাওয়ার পর ভারতীয় অলিম্পিক সংস্থার প্রেসিডেন্ট পি টি উষা বলেছেন, ওজন ধরে রাখাটা অ্যাথলিট ও তাঁর কোচের দায়িত্ব, মেডিক্যাল টিমের নয়। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতের রায় আসার আগেই অবসর ঘোষণা করে দেন বিনেশ। যদিও পরে সমাজমাধ্যমে লিখেছেন ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে’ ২০৩২ পর্যন্ত লড়াইয়ের মঞ্চে নিজেকে দেখতে পাওয়ার কথা; তাঁর কোচ ও চিকিৎসকদের ভরিয়ে দিয়েছেন প্রশংসায়।
মৃত্যুর ত্রিশ বছর পর আমেরিকান অ্যাথলিট জিম থর্পকে জোড়া স্বর্ণপদক ফিরিয়ে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি। ক্রীড়া আদালতের রায়ের পর পি টি উষারা তাবৎ আইনি রাস্তা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিচ্ছেন। তবু ভরসাটাই ফিরছে না।