সাত বছরের তনসিং হ্যাসিং বাবা-মায়ের সঙ্গে ইম্ফলের অসম রাইফেলস-এর ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। মণিপুরে মেইতেই ও কুকি— দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। তার জেরে ঘরছাড়া হতে হলেও খুদে তনসিং-এর পক্ষে মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে ঝগড়ার কারণ বোঝা কঠিন ছিল। কারণ তার মা মেইতেই। বাবা কুকি।
জনসংখ্যার নিরিখে মণিপুরে মেইতেইরা সংখ্যাগুরু। কুকিরা সংখ্যালঘু। মেইতেইরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। কুকিরা মূলত খ্রিস্টান। হিন্দি বলয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও ছেলে সংখ্যাগুরু পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করলে আজকাল তাকে ‘লাভ জেহাদ’ আখ্যা দেওয়া হয়। মণিপুরে এখনও ‘লাভ জেহাদ’-এর তত্ত্ব মাথাচাড়া দেয়নি। কিন্তু মেইতেই-কুকিদের গুলির লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে গিয়ে তনসিংয়ের মাথায় লোহার টুকরো এসে বিঁধেছিল। রক্তপাত বন্ধ না হওয়ায় অ্যাম্বুল্যান্সে করে সাত বছরের ছেলেকে তার মা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে পুলিশ পাহারা ছিল। মেইতেই সম্প্রদায়ের লোকেদের সন্দেহ হয়, পুলিশ কুকিদের নিরাপদ ঠিকানায় নিয়ে যাচ্ছে। অ্যাম্বুল্যান্সে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ বাহিনী পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেও পুড়ে মারা যায় সাত বছরের তনসিং, তার মা মীনা ও এক প্রতিবেশী মহিলা।
মণিপুরের বিজেপি সরকার এই খবর ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। খবর প্রকাশিত হলেও ছোট রাজ্য মণিপুরের ঘটনা অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। তাতে অবশ্য মূল প্রশ্নটা ধামাচাপা পড়ে না। তা হল, একটি সম্প্রদায়ের মানুষের মনে কতখানি ঘৃণা, বিদ্বেষ তৈরি হলে তারা অন্য সম্প্রদায়ের সাত বছরের শিশু ও তার মা-কে পুড়িয়ে মারতে পারে? মানুষের মনে কতখানি নিরাপত্তাহীনতা, বিপদের আশঙ্কা তৈরি করলে মানুষকে এতখানি খেপিয়ে তোলা যায়?
বিরোধীদের অভিযোগ, বিজেপি-আরএসএসের সংখ্যাগুরুর আধিপত্য ও বিভাজনের নীতির সুবাদে গোটা দেশে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে অবিশ্বাস, পারস্পরিক বিদ্বেষ, সামাজিক বিভাজন তৈরি হয়েছে। এ দেশের আশি শতাংশই হিন্দু। অথচ দেশ জুড়ে ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ স্লোগান রোজই শোনা যাচ্ছে। গোটা দেশের এই কাহিনি যদি উপন্যাস হয়, তা হলে মণিপুর এরই ছোটগল্প। ২০১১-র জনগণনার হিসাবে মণিপুরের ২৮ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৫৩ শতাংশই মেইতেই। মূলত রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল ও ইম্ফল উপত্যকার জেলায় মেইতেইদের বাস। কুকিরা জনসংখ্যার মাত্র ২৮ শতাংশ। নাগাদের সংখ্যা আর একটু কম। অথচ ‘মেইতেই খতরে মে হ্যায়’ নামক আতঙ্কের বীজ বপন করা হয়েছে।
জাতীয় স্তরে গেরুয়া শিবিরের নেতারা ভয় দেখিয়ে বলছেন, মুসলিমরা বহু বিবাহ করছে। গাদা গাদা সন্তানের জন্ম দিচ্ছে। বাংলাদেশ, মায়ানমার থেকে মুসলিমদের অনুপ্রবেশ চলছে। এক দিন তারা সংখ্যায় হিন্দুদের ছাপিয়ে যাবে। তখন হিন্দুদেরই দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। না হলে ধর্ম পাল্টে মুসলিম হয়ে যেতে হবে। এর কোনও তথ্য-পরিসংখ্যাননির্ভর প্রমাণ নেই। অথচ গেরুয়া শিবির এর মোকাবিলায় হিন্দু রক্ষা বা গোরক্ষা বাহিনী তৈরির ডাক দিচ্ছে। মুসলিমদের ছলে-বলে-কৌশলে দমিয়ে রাখতে চাইছে। মুসলিম মানেই জঙ্গি বা অনুপ্রবেশকারী বলে সংশয়ের বীজ বুনে দেওয়া হচ্ছে।
একই ভাবে মণিপুরেও মেইতেইদের মনে কুকিদের সম্পর্কে বিদ্বেষ ও আতঙ্কের বিষ বাসা বেঁধেছে। ২০১৭-তে মণিপুরে প্রথম বার বিজেপি ক্ষমতায় আসে। তার পর থেকেই মণিপুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ বেড়েছে। মেইতেইরা এখন বিশ্বাস করে, গত দশ বছরে কুকিদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। মায়ানমার থেকে কুকি-চিন সম্প্রদায় মণিপুরে অনুপ্রবেশ করছে। ভবিষ্যতে মণিপুরে মেইতেইরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। কুকিদের অভিযোগ, মণিপুরের বিজেপি সরকার মেইতেইদের সামনে এ ভাবে কুকিদের বিপজ্জনক হিসাবে তুলে ধরছে। কুকিদের কপালে অরণ্যের জমি দখলকারী, বেআইনি আফিমের চাষি ও ড্রাগের কারবারি, বেআইনি অনুপ্রবেশকারী জঙ্গির তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে।
মণিপুর বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্যে ৩৯টিই ইম্ফল উপত্যকায়। কুকিদের মতো তফসিলি জনজাতিদের জন্য মাত্র ২০টি আসন সংরক্ষিত। বাকি ৪০টি আসন থেকে মেইতেইরা লড়তে পারে। এর অর্থ হল, মণিপুরের রাজনীতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ মেইতেইদেরই হাতে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ, এখনও পর্যন্ত রাজ্যের ১২ জন মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ১০ জনই মেইতেই। কোনও কুকি নেতা কখনও মুখ্যমন্ত্রী হননি। অথচ মেইতেইরা এখন ভয় পাচ্ছে, কুকিদের বর্ধিত জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিধানসভার আসন পুনর্বিন্যাস হলে জনজাতি সংরক্ষিত আসনের সংখ্যাও বেড়ে যাবে। কুকিদের হাতেই ক্ষমতার লাগাম চলে যাবে।
বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ নিজেও মেইতেই সম্প্রদায়ের নেতা। তাঁর বিরুদ্ধেই সংখ্যাগুরুর আধিপত্য কায়েমের কর্মসূচি চালানোর অভিযোগ। মেইতেইরা আদতে বহু-ঈশ্বরবাদী কাংলেইপাক বা সানামাহি ধর্মের অনুসারী ছিল। অষ্টাদশ শতকে মণিপুরি রাজাদের নেতৃত্বে তারা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী হয়ে ওঠে। তাই অখণ্ড ভারতের কথা বলে হিন্দুত্বের ছাতার তলায় মেইতেইদের টেনে আনা কঠিন। আরএসএস সে কারণেই মণিপুরে শাখা ছড়াতে পারেনি। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে বিজেপি তাই মেইতেইদের হাতে আরও রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। কুকিদের মতো অন্যান্য জনগোষ্ঠী কোণঠাসা হয়েছে। সংরক্ষিত অরণ্য থেকে কুকিদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। অথচ মেইতেইরা অরণ্যের এলাকা জবরদখল করে বসে থাকলেও কোনও ব্যবস্থা হয়নি। কুকিরা মনে করছে, মেইতেইরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে ফেলতে চাইছে। বিজেপি-আরএসএস গোটা দেশে শিখ, খ্রিস্টানদের মতো বাকি সংখ্যালঘুদের বাদ দিয়ে শুধু মুসলিমদেরই নিশানা করে। মণিপুরেও শুধু কুকিদের নিশানা করে বিজেপি ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’-এর নীতি নিচ্ছে।
মণিপুরের মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে রেষারেষির ইতিহাস বহু পুরনো। মেইতেইদের বাস মণিপুরের মাত্র ১০ শতাংশ এলাকায়। সেখানে নাগা-কুকিরা জমি কিনতে পারে। কুকি, নাগা ও অন্য জনজাতি সম্প্রদায়গুলি পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দা। মেইতেইরা পাহাড়ে জমি কিনতে পারে না। কুকিরা জমির সঙ্গে সরকারি চাকরির সুবিধাও ভোগ করছে বলে মেইতেইদের রাগ। তাদের নালিশ, সংরক্ষণের সুবিধা নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের উচ্চপদে কুকিরা জাঁকিয়ে বসেছে। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ক্ষমতাও কুকিদের হাতে চলে যাবে।
এই নিরাপত্তাহীনতা থেকেই মেইতেইদের মধ্যে তফসিলি জনজাতির তকমার দাবি উঠেছে। গত ৩ মে তার বিরুদ্ধে জনজাতিদের মিছিল বেরিয়েছিল। সেখান থেকেই হিংসার সূত্রপাত। মে মাসের গোড়া থেকে এখনও পর্যন্ত একশোর বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া। মেইতেই অধ্যুষিত এলাকা থেকে কুকিরা প্রাণ হাতে করে পালিয়েছে। কুকিদের এলাকা থেকে মেইতেইরা পাট গুটিয়েছে। দু’মাসের বেশি সময় ধরে হিংসা চললেও দূর-দিগন্তে শান্তির দেখা নেই।
এখানেই মণিপুর গোটা ভারতের কাছে সতর্কবার্তা। বিদ্বেষ তৈরি করা সহজ। আগুন লাগানোর মতোই। তা নেবানো কঠিন। কোনও সরকার রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নিজের পূর্ব-নির্ধারিত সঙ্কীর্ণ কর্মসূচি চালাতে গেলে বিপদ আসতে বাধ্য। সংবিধানের মূল মন্ত্র আসলে সুশাসন। বিভাজনের মতাদর্শের সেখানে স্থান নেই। আম্বেডকর বলেছিলেন, সৌভ্রাত্র ছাড়া গণতন্ত্র থাকতে পারে না। কাজেই শান্তি ছাড়া গণতন্ত্র ফেরানো মুশকিল।
কেন্দ্রে ও রাজ্যে বিজেপির ‘ডাবল ইঞ্জিনের সরকার’ মণিপুরের হিংসা থামিয়ে শান্তি ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে। অমিত শাহের মতো দাপুটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও মণিপুরে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। বিজেপি সমর্থিত বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের সরকারের আমলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদের কন্যা রুবাইয়ার অপহরণের পরে পাঁচ জন কাশ্মীরি জঙ্গিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবাণীদের আমলে কন্দহর বিমান অপহরণের পরে মাসুদ আজ়হারকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল ভারত সরকার। তার পরে এই প্রথম নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের আমলে মেইতেইদের বিক্ষোভের চাপে ভারতীয় সেনা ১২ জন কট্টর মণিপুরি জঙ্গিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।
ছোট্ট রাজ্য মণিপুর বলে এই ঘটনাও অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গিয়েছে।