Rome

লজ্জা বিষয়ে দু’-একটি কথা

রোম যখন পুড়ছিল তখন নিরো বেহালা বাজাননি মোটেই— তিনি তখন ছিলেন রোম থেকে অনেকটা দূরে। তবে বাজনা তিনি বাজাতেন, গানও করতেন।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২২ ০৫:১৪
Share:

রোম যখন পুড়ছিল তখন নিরো বেহালা বাজাননি মোটেই— তিনি তখন ছিলেন রোম থেকে অনেকটা দূরে। তবে বাজনা তিনি বাজাতেন, গানও করতেন। মোসায়েবরা প্রশংসা করে এমন মাথায় তুলল যে, নিরো (৩৭-৬৭) মঞ্চে গাইতে শুরু করলেন। অনুষ্ঠান চলাকালীন বেরোনো ছিল নিষিদ্ধ। কে বিরক্তি প্রকাশ করছে, নজর রাখত সৈন্যরা। তবু কেউ কেউ দেওয়াল বেয়ে পালানোর চেষ্টা করত। কোনও এক শিল্পী এক বার পাল্লা দিয়ে আরও ভাল গেয়ে দেখিয়েছিলেন। সেই ছিল তার শেষ গান— মুন্ডু গেলে আর গাইবেন কী করে। অলিম্পিকেও যত বার, যত ইভেন্ট-এ নেমেছেন, নিরোই জিতেছেন। এক বার হচ্ছিল রথের দৌড়। সবার চার ঘোড়ার রথ, নিরোর রথ দশ ঘোড়ার। টাল হারিয়ে মাঝপথে ছিটকে গিয়েছিলেন রথ থেকে, তবু নিরোই চ্যাম্পিয়ন।

Advertisement

ক্ষমতা হারানোর পরে নিরোরই অনুরোধে তাঁকে হত্যা করেন এক রক্ষী। ছুরি বসানোর আগে নিরো বলেন, “আজ এক মহান শিল্পীর মৃত্যু হল।” সতেরো বছর বয়সে রাজা হয়েছিলেন নিরো, মাত্র তিরিশে মৃত্যু। যারা নিরোকে বুঝিয়েছিল তিনি মহান শিল্পী, তাদের কি দায় ছিল না এই পরিণতিতে? সে কথা কেউ লেখেনি। তবে লেখা আছে, নিরোর মৃত্যুর পর তাঁর নাম মুছে দেওয়া হয় অলিম্পিক বিজয়ীদের তালিকা থেকে। ইতিহাস এমন করে পথচিহ্ন দিয়ে যায়, অনাগত কালের শাসকদের জন্য।

নিরো কেমন শিল্পী ছিলেন, কে বলতে পারে? তবে শিল্পের চর্চা নিরোর মনকে সংবেদী, রুচিশীল করতে পারেনি। তাঁর আদেশে খ্রিস্টানদের উপর যে সব পৈশাচিক অত্যাচার হয়েছিল, তাতে যুদ্ধপ্রিয় রোমানরাও শিউরে উঠেছিল। নির্লজ্জতা ও নিষ্ঠুরতার এই সংযোগ আশ্চর্য নয়। দুটোরই উৎস অন্যের প্রতি তাচ্ছিল্যে। লজ্জাকে তাই কেবল মনের আবেগ বলে ভুল করা চলে না। মানুষের নৈতিক বোধের অন্যতম পরিচয় তার লজ্জা, যা প্রবলকে সংযত করে, দুর্বলকে শক্তি দেয় প্রতিবাদ করতে। যার উপর মিথ্যা মামলার খাঁড়া ঝুলছে, এক চিঠিতে যাকে বদলি কিংবা বরখাস্ত করা যায়, যাকে হয়রান করে গ্রামছাড়া করা বাঁ হাতের খেলা, সে-ও যখন শাসকের নির্লজ্জতায় ‘ছি!’ বলে ওঠে, তখন চাবুকের মতো তা আছড়ে পড়ে। এই হল লজ্জার শক্তি।

Advertisement

আমাদের শাস্ত্র অবশ্য ‘লজ্জার শক্তি’ বলে না, বলে লজ্জাই শক্তি। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবীর স্তুতিতে বলা হচ্ছে, “তুমি লজ্জা, পুষ্টি, তুষ্টি, শান্তি ও ক্ষান্তিস্বরূপা।” যিনি শক্তিরূপিণী, তিনিই লজ্জারূপিণী। পঞ্চানন তর্করত্ন বলছেন, এখানে ‘লজ্জা’ হল “কুকর্ম-নিবারণী-পৌরুষী লজ্জা।” এমন লজ্জা অবসন্ন করে না, পৌরুষ জোগায়। দেবী মহিষাসুরের মতো পরস্বাপহারীকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, তাই তিনি লজ্জারূপিণী। এই লজ্জার অন্য নাম ‘হ্রী’। দার্শনিক বৃন্দা ডালমিয়া হ্রী-কে বলছেন ‘গঠনমূলক লজ্জা’ (কনস্ট্রাকটিভ শেম)। অপরের প্রতি অন্যায় করা থেকে যা আমাদের সংযত রাখে, সেই বোধের উপরেই সম্পর্ক তৈরি হয়। লজ্জাই সমাজকে ধরে রেখেছে।

আর এক রকম লজ্জাও আছে, যা আমাদের মুখের কথা, পায়ের গতি আটকে দেয়। তেলচিটে, আঠালো এই অনুভূতি কেবলই পিছু টানে, এগোতে দেয় না। অন্যায়-অবিচারে বাধা দিতে দেয় না। এ সেই সঙ্কোচ, যা নিজের প্রতি অপমান। এই গ্লানিময় লজ্জার থেকে শক্তিদায়িনী ‘হ্রী’ আলাদা। স্বামী জগদীশ্বরানন্দ বলছেন, হ্রী হল ‘অধর্ম-বিমুখতারূপ সঙ্কোচ।’ অন্তরের যে কণ্ঠ অন্যায় করতে, অসত্য বলতে বারণ করে, তা-ই হল হ্রী।

যে নিজের মনের কথায় কান দেয় না, সে-ই দু’কান কাটা। কোনও অনুষ্ঠানে খাবারের প্যাকেট দেওয়া হচ্ছে, সে অন্যকে গুঁতো দিয়ে প্যাকেট ছিনিয়ে এনে খায়। সবার নিয়ম আমারও নিয়ম, এ কথা মানার শক্তি তার নেই। বৃন্দা বলছেন, অন্যের সঙ্গে নিজের সমতার বোধ, আর অন্যের প্রতি অন্যায় করতে লজ্জার বোধ, এ দুটো যেন একই টাকার এ পিঠ-ও পিঠ। আমরা লাইন দিয়ে বাস-অটোয় উঠি, বৃদ্ধ-অশক্তদের আসন ছেড়ে দিই, সেটা শুধু শেখানো নিয়মের জন্য নয়, বাইরের কারও চোখরাঙানিতেও নয়। কেননা অন্যের আগে নিজেকে রাখতে নিজেরই লজ্জা করে। গণতন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছে সাম্য, তাই গণতন্ত্রে নির্লজ্জতা মস্ত দোষ।

হ্রী-স্বরূপা লজ্জার কণ্ঠ সঙ্গীহীন রাতের পাখির মতো, কান পেতে না থাকলে শোনাই যায় না। নিজেকে বিশিষ্ট, অন্যের চাইতে বড় ভাবার দিকেই মনের ঝোঁক। তাই মহাভারতে বলা হচ্ছে, সমতা আর লজ্জা হল ‘আচার’, মানে যা নিয়মিত আচরণ করতে হয়। নিজেকে অন্যের সমান মনে করা, না করতে পারলে লজ্জা পাওয়া— এই অভ্যাস করা চাই। আদর্শ রাজনীতি, সমাজরীতি, শিক্ষানীতির সন্ধান করতে গিয়ে গান্ধী আর রবীন্দ্রনাথ, দু’জনেই আশ্রম তৈরি করেছিলেন, যেখানে সবাই সমান। নিত্য-পালনীয় নীতির সঙ্গে রাষ্ট্রনীতির সেতু নির্মাণই ছিল তাঁদের ভারত-নির্মাণ।

রাজনীতির সঙ্গে অন্তরের যোগ যত কমছে, যত তা কেবল বাইরের ‘কর্মসূচি’ হয়ে উঠছে, ততই দু’কান-কাটাদের জ্বালাতনে সমাজ-সংসার অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রক্ষমতাকে শিল্প-সাহিত্যে জাহির করতে দেখে হাসাহাসি করছি বটে। তবে কথাটা হাসির নয়। লজ্জাহীনের শক্তিলাভ বড় ভয়ানক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement