Social Media Abuse

এখানে কেউ কথা বোলো না

তুচ্ছ ঘটনা? সহজলভ্য ইন্টারনেট সংযোগের অনিবার্য কুফল যে, জনপরিসরে কোনও আক্রমণ, কোনও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতেই আর বিন্দুমাত্র কষ্ট করতে হয় না?

Advertisement

আকাশ বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০২৪ ১১:০১
Share:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে।/ এখন হবে প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানে গানে॥” প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর ঈশ্বরবিশ্বাস, প্রেমচেতনা। কিন্তু কোলাহল তো দূরের কথা, এ যে কথা বলাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম!

Advertisement

কথা উঠছে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এক গায়িকার সূত্রে। সাধারণ দুটো কথার ফলে তাঁকে যে পড়তে হবে এতটা আতান্তরে, তা বুঝি নিজেও ঠাহর করতে পারেননি! নানাবিধ কারিগরি কলাকৌশল সমৃদ্ধ, তাবড় তারকা-সমন্বিত ও চলতি বছরের অদ্যাবধি সবচেয়ে বেশি আলোচ্য চলচ্চিত্রটি দেখে ভাল লাগেনি তাঁর। সে কথা জানিয়েছিলেন সমাজমাধ্যমের পরিসরে। লিখেছিলেন, অনেক দিন পর সিনেমা হল থেকে অর্ধেকেরও কম দেখে বেরিয়ে এলাম... ইত্যাদি। ভাইরাল হওয়া সম্পূর্ণ পোস্টটির স্ক্রিনশট পড়লে দেখা যাবে আরও কিছু কথা লিখলেও ব্যক্তি-অবমাননাকর একটি শব্দও সেখানে ছিল না। কিন্তু এ-হেন আপাত-নিরীহ অভিজ্ঞতা জানানোর পরই নাকি নেটিজ়েনদের একটা বড় অংশ কার্যত রে রে করে উঠেছিলেন তাঁর উপর! আক্রমণের মুখে পড়ে পোস্টটি মুছে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বিবেচনা করেছিলেন গায়িকা।

তুচ্ছ ঘটনা? সহজলভ্য ইন্টারনেট সংযোগের অনিবার্য কুফল যে, জনপরিসরে কোনও আক্রমণ, কোনও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতেই আর বিন্দুমাত্র কষ্ট করতে হয় না? যাঁরা ট্রোল করেন, তাঁদের কাজ এখন ভারী সহজ— যে কোনও একটি বিষয়ে যে কোনও এক জন ব্যক্তিকে বেছে নিয়ে (সেই ব্যক্তিকে অবশ্য সেলেব্রিটি হতে হয়, না হলে প্রচার পাওয়া যায় না তেমন) নিরন্তর আক্রমণ শাণিয়ে যেতে হয়, যত ক্ষণ না সেই ব্যক্তি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, অথবা ভেঙে পড়েন। তার পর খুঁজে নিতে হয় পরবর্তী শিকার। কিন্তু, শুধু এটুকুই কি? না কি, এর মধ্যে নিহিত আছে একটি বৃহত্তর বিপদের অনতিপ্রচ্ছন্ন ছায়া— শুধু রাষ্ট্রশক্তিই নয়, সাধারণ নাগরিকও আর ভিন্ন মতের অধিকার স্বীকার করতে নারাজ?

Advertisement

কেউ কেউ অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন সেই ভিন্ন মতের চরিত্র নিয়েও। বলেছেন, বক্তা যদি এক জন সেলেব্রিটি হন, জনপরিসরে যদি তাঁর প্রভাব থাকে, তবে কোনও সিনেমা (অথবা অন্য যে কোনও শিল্পকর্ম) সম্বন্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে তাঁর বিরত থাকাই ভাল। কারণ, তাঁর সেই মন্তব্য সেই সিনেমাটির বাজারে কুপ্রভাব ফেলতে পারে। একটি সিনেমা তো শুধু শিল্পকর্মই নয়, বহু মানুষের রুটিরুজি জড়িয়ে থাকে তার সঙ্গে। কোনও তারকার একটি নেতিবাচক মন্তব্য যদি সেই রুজির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে ব্যক্তিগত মতামতটি গোপন রাখাই কি সেই তারকার পক্ষে দায়িত্ববোধসম্পন্ন কাজ নয়? অর্থাৎ, এই প্রশ্নটি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে একটি বৃহত্তর চয়নের সামনে— মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা, না কি, অন্য কারও জীবন-জীবিকার স্বার্থে মতপ্রকাশের অধিকারে রাশ টানা, কোনটি নাগরিক সমাজের কাম্য অবস্থান হবে?

নিঃসন্দেহে একটি চলচ্চিত্র বহু মানুষের রুটিরুজির সঙ্গে জড়িত। এ কথাও সত্যি যে, পরিচিত বা তারকা গোত্রীয় কোনও ব্যক্তির কোনও বিষয়ে মন্তব্য হয়তো বা বেশ কিছু মানুষকে তুলনামূলক ভাবে দ্রুত প্রভাবিত করতেও পারে। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত মতামতের পিছনে ক্ষেত্রবিশেষে থাকতেও পারে বিশেষ অভিসন্ধি! কিন্তু কোনও কারণ বা শর্তেই কি কোনও ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত অভিরুচি, পছন্দ-অপছন্দের বহিঃপ্রকাশ থেকে বিরত থাকতে বলার কোনও অধিকার অপর কারও থাকে? যদি থাকে তবে আগামী দিনে সমালোচনা-সাহিত্য বা সাহিত্য সমালোচক, চিত্র সমালোচক, সঙ্গীত সমালোচক— এই জাতীয় শব্দগুলিরও কোনও অস্তিত্ব সমাজজীবনে থাকার কথা নয়। চারুকলার যে কোনও প্রকাশ বা প্রদর্শনীই যেমন কোনও না কোনও ভাবে কোনও না কোনও মানুষের রুটিরুজির সঙ্গে সম্পর্কিত, তেমনই কোনও অপ্রিয় কথা উচ্চারণ করতে হলে সমালোচকের অবশ্যই তারকা হওয়া চলবে না— এও কাঁঠালের আমসত্ত্বই।

দিন-রাত ঘরে ও বাইরে নানা রকম স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা দেখার বাধ্যবাধতায় সেই স্বৈরতান্ত্রিক অভ্যাসগুলি কি ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে আমাদের কাছে? স্বৈরতন্ত্রকে শনাক্ত করতে পারার যুক্তিবোধও ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে কি? এক সময় শনিবারের চিঠি প্রকাশিত হত প্রতি সপ্তাহে। সেই পত্রিকার শ্লেষ, বিদ্রুপ, ব্যঙ্গোক্তি থেকে রক্ষা পেতেন না প্রথম শ্রেণির প্রায় কোনও বুদ্ধিজীবীই। বস্তুত বুদ্ধিজীবী বা স্রষ্টা হওয়ার সূত্রেই আক্রান্ত হতেন তাঁরা। আক্রমণ কখনও কখনও ছাড়িয়ে যেত শালীনতার মাত্রাও। এ নিয়ে পরবর্তী কালে যথেষ্ট সমালোচিত শনিবারের চিঠি তথা তার সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। কিন্তু ভূরি ভূরি নেতিবাচক বা নঞর্থক মন্তব্য ছাপা হয় বলে কেউ দাবি তোলেনি শনিবারের চিঠির মুখ বন্ধ রাখার। দুঃখের কথা, বিশ শতকের প্রথমার্ধের ঔদার্য একুশ শতকের প্রথমার্ধে এসে ক্ষেত্রবিশেষে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সমাজজীবনে। সময়ের ঘূর্ণন সুস্থ ও স্বাভাবিক হলে এই উল্টো ছবি দেখতে পাওয়ার কথা ছিল না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement