Silicon Valley Bank Collapse

নিয়ন্ত্রণের রাশ আলগা হলে কী হয় তার উদাহরণ সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক

২০০৮ সালের ব্যাঙ্কিং বিপর্যয়ের পরেও এ রকম ঘটনা আমেরিকায় ঘটল কী করে? অনেকই মনে করছেন এর নেপথ্যে রয়েছে ২০১৮ সালে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৩ ১৭:৪৮
Share:

ব্যাঙ্ক বিপর্যয়ে দায়ী কি ট্রাম্প? — ফাইল চিত্র।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে চলতি মাসের ৮ তারিখ সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক শেয়ার বাজারকে জানায় যে ব্যালান্সশিট সামলাতে বাজার থেকে ২২৫ কোটি ডলার তাদের চাই। আর পরের দিন শেষ হতে না হতেই ব্যাঙ্ক থেকে আমানতকারীরা ঝুঁকি না নিয়ে ৪২০০ কোটি ডলার সরিয়ে নেয়। মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যবসার অঙ্কে আমেরিকার ষোড়শ বৃহত্তম ব্যাঙ্কটি। আর শুক্রবার ১০ মার্চ আমেরিকার ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বন্ধ করে দেয় সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক বা এসভিবি-কে।

Advertisement

২০০৮ সালের ব্যাঙ্কিং বিপর্যয়ের পরেও এ রকম ঘটনা আমেরিকায় ঘটল কী করে? অনেকই মনে করছেন এর নেপথ্যে রয়েছে ২০১৮ সালে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত। ২০০৮ সালে সাবপ্রাইম কেলেঙ্কারির পরে এই রকম সর্বনাশা ঘটনা যাতে না ঘটে তা দেখতে চালু হয় ডড-ফ্রাঙ্ক ওয়াল স্ট্রিট রিফর্ম অ্যান্ড কনজিউমার প্রটেকশন অ্যাক্ট। এর সঙ্গে আসে ভলকার রুল। এই দুই মিলিয়ে আমেরিকার ব্যাঙ্কগুলির পরিচালন ব্যবস্থার উপর নানান বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়ে।

এই বিধিনিষেধের সারমর্ম ছিল ব্যাঙ্কগুলির লেনদেনের স্বেচ্ছাচারিতার উপর লাগাম দেওয়া। এই দুই আইনের মূল কথাই ছিল ব্যাঙ্কগুলি তাদের ডিপোজিট এমন ভাবে বিনিয়োগ করবে যাতে তা ফাটকায় পর্যবসিত না হয়। গ্রাহকদের আমানতের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নগদের জোগান ঠিক থাকে এবং ব্যাঙ্কের নিজের লগ্নি একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে দীর্ঘকালীন এবং স্বল্পমেয়াদে ভাগ করা থাকে এমন ভাবে যাতে প্রয়োজনে ক্ষতির মুখ না দেখেই তা ভাঙিয়ে আপৎকালীন সময়ে নগদের জোগানের ব্যবস্থা করা যায় কোনও সমস্যা ছাড়াই। আর এই ব্যাঙ্কটি এর প্রত্যেকটি ভেঙে আমেরিকার অর্থনীতির পরিচালন ব্যবস্থার উপর প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিয়েছে।

Advertisement

এর জন্য অনেকেই দোষ দিচ্ছেন আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে আমেরিকার ব্যাঙ্কগুলি অনুযোগ করতে থাকে যে এই বিধিনিষেধের ফলে তাদের লাভ কম হচ্ছে। যে সব ব্যাঙ্ক এই বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে লবি করতে শুরু করে তার মধ্যে সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের পরিচালকরা ছিলেন অন্যতম। এই লবির কথা শুনে ট্রাম্প ডড-ফ্রাঙ্ক এবং ভলকার রুল শিথিল করে দেন ২৪ মে ২০১৮ সালে।

আসলে অনেকেই মনে করছেন ঠিক সেই দিন থেকেই সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের সর্বনাশের শুরু। তখন বাজারে সুদের হার ছিল শূন্য। নগদ জোগান অনুপাতের তোয়াক্কা না করে এই ব্যাঙ্কটি তাদের নগদ জমার একটি বড় অংশ জ়িরো কুপন বন্ডে বিনিয়োগ করে দেয়।

এই বন্ডগুলির বিশেষত্ব হল এর সঙ্গে কোনও সুদ নির্দিষ্ট করা থাকা না। বাজারে ছাড়া হয় বন্ড বা ঋণপত্রের যা দাম তার থেকে কম দামে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সেই সময় শেষ হল বন্ডটি ভাঙিয়ে নিলে তার যে দাম সেই দাম পাওয়া যায়। ক্রেতার লাভ হল কেনার দাম আর বিক্রি করার দামের মধ্যে ফারাক। সময়সীমা পার হওয়ার পরে যে দাম হাতে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকে তাকে ফেস ভ্যালু বলে। আর তার থেকে যত শতাংশ কম দামে তা বাজারে ছাড়া হয় তাকে ডিসকাউন্ট বা ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বলা হয়ে থাকে।

আমেরিকার বাজারে সেই সময় সুদের হার প্রায় শূন্য থাকায় ব্যাঙ্কটি তাদের আমানতের একটা বড় অংশ এই ধরনের অতি দীর্ঘ মেয়াদের বন্ডে লগ্নি করে বসে। তখনও কোভিড নেই। লকডাউন নেই। এবং লাগাম ছাড়া মুদ্রাস্ফীতিও নেই। সমস্যার শুরু হল লকডাউন উত্তর রাশহীন মুদ্রাস্ফীতির কারণেই। আমেরিকার শীর্ষ ব্যাঙ্ক মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে সুদের হার বাড়াতে শুরু করল আর বিপদ শুরু হল সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের।

ঋণপত্র বা বন্ডের দাম সুদের হারের বিপরীতমুখী। সুদ বাড়লে বন্ডের দাম পড়ে, আর কমলে বন্ডের দাম বাড়ে। এর কারণ হল, বন্ড যখন আমি কিনছি তখন তাতে একটা নিদিষ্ট হারে সুদের প্রতিশ্রুতি থাকে। এ বার বাজারে সুদের হার বাড়লে আমি যদি আগের বন্ড অন্যের কাছ থেকে একই দামে কিনি তা হলে আমি আগের হারে রিটার্ন পাব। যা বাজারে চলতি সুদের হারের থেকে কম। বাজারে চলতি সুদের হারের সঙ্গে পা মিলিয়ে রিটার্ন পেতে গেলে ক্রেতা ওই বন্ড আগের থেকে আনুপাতিক হারে এমন কমে কিনবে যাতে তার বিনিয়োগের অঙ্কে রিটার্নের হার বাজারে চালু সুদের সমান হয়। বাজারে সুদ কমলে এর ঠিক উল্টোটা ঘটবে।

সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে আসল বিপদটা এল এখান থেকেই। বাজারে সুদ চড়তে থাকায় তাদের কেনা বন্ডের দাম পড়তে থাকল। আর ব্যালান্সশিটে সম্পদের অঙ্কও কমতে থাকল। আর অবশেষে ৮ মার্চ ব্যাঙ্কটি বন্ডে বিনিয়োগ বাবদ ১৮০ কোটি ডলার ক্ষতির কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হল। এর পরে আমানতকারীরা আর দেরি করেননি। রাতারাতি তাঁদের জমা টাকা এই ব্যাঙ্ক থেকে সরিয়ে নেওয়া শুরু করেন তাঁরা।

আমেরিকার নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতি শুক্রবার ব্যাঙ্কগুলির হাল খতিয়ে দেখে। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টায় অনেক ক্ষতি হয়ে যায় আমানতকারীদের। ওয়াকিবহাল মহলের যুক্তি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার যদি সেই ব্যবস্থা থাকত যাতে নিত্য দিন ব্যাঙ্কগুলির লেনদেন নিরীক্ষণ হত তা হলে আমানতকারীদের এই হেনস্থা হত না।

শুধু এখানেই শেষ নয়। প্রতিটি আর্থিক সংস্থার নিজস্ব লেনদেন নিরীক্ষণ বিভাগ থাকে। এই বিভাগের কাজ হল ব্যাঙ্কের বিনিয়োগ এবং লেনদেন যাতে সুরক্ষা বলয় অতিক্রম না করে। কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্য বলছে এই ব্যাঙ্কটিতে দীর্ঘকাল ধরে এই বিভাগটির শীর্ষপদে কেউ ছিলেন না। তাই বিভাগটা কার্যত কোনও কাজই করত না। আর রাশও ছিল না ব্যাঙ্কটির বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের উপর।

একটাই আশার কথা যে ১২ মার্চের ফেডারাল নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনও আমানতকারীর টাকা মার যাবে না। ব্যাঙ্কটির পরিচালক সংস্থা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাতে কি সেই বৃহত্তর প্রশ্নটির মীমাংসা হবে? শুধুমাত্র বৃহত্তর আর্থিক লাভের স্বার্থে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই স্বার্থের যূপকাষ্ঠে গোটা দেশের অর্থনীতিকে বলি দিতে পারে? এই প্রশ্ন কিন্তু আজ সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরাও কিন্তু বাদ নেই এই প্রশ্ন থেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement