স্বতঃস্ফূর্ত: অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর সামনে আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ, ১৪ অগস্ট। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
পুজো এলেই দেখবেন, সব ঠান্ডা। মিছিল ভুলে লোকে বাজার করবে।’ ‘ধর্ষণ কি আজই হল? বামেদের সময় ধানতলা-বানতলা হয়নি?’ ‘গান-নাচ নয়, মেয়েকে ক্যারাটে শেখান।’
গত দু’সপ্তাহে এ কথাগুলো যাঁরা বলছেন, নিজেদের অজানতেই তাঁরা একটা সংস্কৃতি নির্মাণ করছেন, তাকে পুষ্ট করছেন। তা হল ধর্ষণ সংস্কৃতি (রেপ কালচার)। সংস্কৃতি কেবল চারুকলার চর্চা তো নয়, তা হল সমাজজীবনের গাইডবই— কাকে কী বলা চলে, কোনটা ধরে নেওয়া যায়, কোনটা মানা চলে না। মানুষের সদ্গুণ, সৃজন প্রতিভার বিকাশ যেমন ঘটায় সংস্কৃতি, তেমনই অলক্ষ্যে তৈরি করে অন্যায়ের, বৈষম্যের জমি, রীতি, আচার, অভ্যাস তৈরির মধ্যে দিয়ে। হিন্দু মেয়েরা যে ভাই, জামাই বা সন্তানের মঙ্গল কামনায় উপোস করে, অথচ মেয়েদের মঙ্গল কামনায় কেউ উপোস করে না, এটা কারও খাপছাড়া লাগে না। কারণ, মেয়েদের সমাদর শাস্ত্রের বচনে থাকতে পারে, সংস্কৃতিতে নেই। সংস্কৃতির যে দিকগুলো মেয়েদের হীন করে রাখে, তার অন্যতম ধর্ষণের সংস্কৃতি।
আর জি কর কাণ্ডের পর ধর্ষণ-প্রতিরোধের নানা তালিকা তৈরি হচ্ছে— ক্যারাটে, পেপার স্প্রে, অ্যাপ ডাউনলোড, ইত্যাদি। মেয়েদের সক্ষমতা বাড়ানো খুবই জরুরি, কিন্তু এ সব উপদেশের পিছনে কাজ করে এই মনোভাব যে, মেয়েটা চাইলে ধর্ষণ এড়াতে পারত। যদি অমন জামা না পরত, যদি ছেলেটার সঙ্গে লাগতে না যেত, যদি রাতে একা না থাকত, যদি...। কোনও একটা দোষ বা খামতির জন্যই ধর্ষিত হতে হয়, সচ্চরিত্র এবং স্মার্ট মেয়েরা ধর্ষণ এড়াতে পারে, এই ধারণা হল ধর্ষণ সংস্কৃতির প্রধান লক্ষণ।
সে ভাবেই, ‘কোন দেশে ধর্ষণ হয় না?’ ‘কোন আমলে ধর্ষণ হয়নি?’ ‘দিল্লি, মুম্বইতে ধর্ষণের অভিযোগ কলকাতার চাইতে বেশি, তা হলে আবার এত শোরগোল কিসের?’ এ সব প্রশ্ন ধর্ষণকে স্বাভাবিক, এমনকি অনিবার্য করে দেখাতে চায়। হয়রানি-নিগ্রহের অভিযোগ না নেওয়া, তদন্তে ঢিলেমি, মামলা ঝুলিয়ে রাখা, লিগাল এডের দুর্দশা— রাষ্ট্রব্যবস্থার অবজ্ঞা আর জীর্ণতা ধর্ষণ সংস্কৃতিকে সবল করছে। মেয়েরা শরীর-মন দিয়ে এর অন্যায্যতা বোঝে, বোঝাতে সব সময় পারে না।
এক নিরপরাধ, কর্তব্যপরায়ণ চিকিৎসকের ক্ষতবিক্ষত দেহ সকলকে যেন ধাক্কা দিয়ে জাগাল। ধর্ষণের মতো অপরাধের যুক্তি খোঁজাও অপরাধ, এক ধর্ষককে শাসকের আশ্রয়দান সব মেয়ের অপমান— লক্ষ লক্ষ পায়ের ছাপে সে কথাগুলো লেখা হয়ে গিয়েছে পথে পথে। দাগ কেটেছে ইতিহাসের পাতাতেও। গত চোদ্দো দিনে মিছিল-সমাবেশে শতসহস্র মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান, প্রতিবাদের তীব্রতা ও ধারাবাহিকতা, এ সবই অভূতপূর্ব। কিন্তু সেটাই এই প্রতিবাদের সবচেয়ে বড় তাৎপর্য নয়। এই নাগরিক প্রতিবাদ দেখিয়ে দিল, নাগরিক এগিয়ে, নেতারা পিছিয়ে। মেয়েদের নেতৃত্বে নাগরিক সমাজ যতই ধর্ষণ সংস্কৃতিকে আঘাত করছে, ততই নেতারা ধর্ষণ সংস্কৃতিকে ঢাল করে বাঁচতে চাইছে।
যেমন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন করেছেন, হাথরস কে করেছে? উন্নাও কে করেছে? নেত্রীর সুরে টিভির বিতর্কগুলিতে তৃণমূল মুখপাত্ররা বলে চলেছেন, মধ্যপ্রদেশে কী হচ্ছে? উত্তরপ্রদেশে কী হচ্ছে? বাম আমলে কী হয়েছিল? এ শুধু ‘হোয়াট-অ্যাবাউটারি’ নয়, রুচিহীন দলাদলি নয়, এ হল ধর্ষণ, নারীহিংসাকে প্রাত্যহিক, প্রত্যাশিত ঘটনা করে তোলা। আশঙ্কা হয়, এর ফলে যে বার্তা পৌঁছয় দলের বাহুবলীদের কাছে, তা হল, ‘ওরা খেলছে, আমরা খেলব না কেন?’ এমনই ভয়ানক পরিণাম ধর্ষণের সংস্কৃতির। এমনই অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক দল।
আর জি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের নানা কাজের অসঙ্গতিতে সুপ্রিম কোর্টও সন্দিহান, অথচ মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বার বার স্বাস্থ্য দফতরের নানা সম্মানজনক পদে আপ্যায়ন করছেন। অভিযুক্তের প্রতি এই প্রশ্রয়ও ধর্ষণ সংস্কৃতির অঙ্গ। এর পর ধর্ষিতের পরিবার সুবিচারের কতটুকু আশা করতে পারে? ছাত্রছাত্রীরা পোস্টার লিখেছে, “শাসক তোমার কিসের ভয়, ধর্ষক তোমার কে হয়?” এই সন্দেহ যদি ভুলও হয়, তবু প্রশ্নটা তো উঠছে। সেটাও প্রমাণ করে, নবীন প্রজন্ম ধর্ষণ সংস্কৃতির পঙ্কিলতায় বাস করছে।
১৪ অগস্ট হাসপাতালে ভাঙচুরকে ‘রাম-বাম’-এর প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা বলে অভিহিত করে, মমতা ধর্ষণ-হত্যার দায়ও বিরোধীদের উপর চাপাতে চেয়েছেন। এটা নতুন নয়, ধর্ষণের বিচার চেয়ে মেয়েরা পথে নামলেই তাঁদের বিরোধী বলে দাগিয়ে দেন মমতা। কামদুনিতে তাঁদের মমতা বলেছিলেন মাওবাদী, সন্দেশখালিতে বলেছিলেন বিজেপি। অথচ, সন্দীপ ঘোষকে সরকারি চেয়ারে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা দেখে কার না মনে পড়েছে ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের কথা, মহিলা কুস্তিগিরদের লাগাতার আন্দোলন সত্ত্বেও যাঁকে কুস্তি ফেডারেশন থেকে সরায়নি বিজেপি সরকার? হাঁসখালিতে ধর্ষণের জেরে মৃত কিশোরীকে তড়িঘড়ি দাহ করা দেখে কি মনে পড়েনি হাথরসে দলিতকন্যার দাহ? কেন বার বার আক্রান্ত মেয়েদের বয়ানকে নস্যাৎ করে ঘটনার নিজস্ব ব্যাখ্যা চালাতে চেয়েছেন মমতা?
আমেরিকার মাফিয়ারাজ নিয়ে লেখা উপন্যাস দ্য গডফাদার-এ মারিয়ো পুজ়ো দেখিয়েছেন, আমেরিকাতে বড়-হওয়া মাইকেল করলিয়ন সিসিলিতে থাকার সময়ে মাফিয়ার প্রকৃত রূপ টের পায়। ফেরারি মাইকেলের আশ্রয়দাতা ছিলেন এক ডাক্তার, যিনি ডাক্তারির একটা বইও পড়েননি। মাফিয়া নেতার নির্দেশমতো শিক্ষকেরা নম্বর দিয়ে তাঁকে পাশ করিয়ে দিয়েছিল। “মেধা মূল্যহীন, প্রতিভা মূল্যহীন, পরিশ্রম মূল্যহীন। মাফিয়া গডফাদার উপহারের মতো দান করে তোমার পেশা।” যে হাত টাকার পরিবর্তে নম্বর দেয়, চাকরি দেয়, সেই হাতই চোখ ফাটিয়ে রক্ত বার করে দেয়। এই দুর্বৃত্ততন্ত্র সকলকে অবমানব করে রাখছে, মেয়েদের বাড়তি পাওনা যৌন-হেনস্থা, ধর্ষণ। কর্মক্ষেত্রের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে মেয়েরা কতখানি বিপন্ন, ৮ অগস্টের রাত তার চরম দৃষ্টান্ত। এর রকমফের চলছেই— ওয়ার্ডবয়ের হাতে নার্সের লাঞ্ছনা, অ্যাম্বুল্যান্স চালকের হাতে আশাকর্মীর হয়রানি, এমন অনেক ঘটনা সামনে আসছে।
মমতা নিজে বিচারের দাবিতে মিছিলে হেঁটেছেন, যেন রাত দখল-করা মেয়েদের দাবি আর তাঁর দাবি এক। আদৌ তা নয়। নাগরিক মিছিল শুধু আর জি কর কাণ্ডে দোষীদেরই শাস্তি চায় না। যে সংস্কৃতি কাজের জায়গায়, পড়াশোনার জায়গায়, রাস্তাঘাটে, বাসে-ট্রেনে নারী নিগ্রহের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখে না, যা মহিলাদের অভিযোগে সন্দেহ করে অথচ নিগ্রহকারী, বা নিগ্রহের প্রশ্রয়দাতার প্রতি প্রকাশ্যে সহানুভূতি দেখায়, যা জান্তব পুরুষত্ব দিয়ে মেয়েদের শাসন করতে চায়, মেয়েরা সেই ধর্ষণ সংস্কৃতির অবসান চেয়ে রাস্তায় নেমেছে। সেখানে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি নয়, মুখোমুখি।
শেষ অস্ত্র তাচ্ছিল্য — কী হল পথে নেমে? দোষী কি শাস্তি পেল? রাস্তা থেকে ফের ঘরেই ঢুকতে হল তো? কোনও নাগরিক আন্দোলন এক নাগাড়ে উচ্চগ্রামে বাঁধা থাকে না। বিচারের দাবি চলবে। কিন্তু ধর্ষকের পিছনে রাষ্ট্রের ছায়াখানি যে মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ আলোয় টেনে আনছে, ধমক দিয়ে, লাঠি চালিয়েও তাদের ‘ম্যানেজ’ করা যাচ্ছে না, এ-ও তো কম কথা নয়। মেয়েদের সমাবেশের পাল্টা সভায় লোক আনছে শাসক দল, পাল্টা মিছিলে হাঁটতে হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীকে, মিডিয়ার সামনে পুলিশ কমিশনার ব্যর্থতা স্বীকার করছেন, ছাত্রের ক্ষোভে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ সরছেন। অভ্রংলেহী রাষ্ট্রশক্তির কাদা-গলা পা দু’খানি বেরিয়ে পড়ছে বার বার। মাত্র দু’সপ্তাহে প্রকাশ পেল এই গণতন্ত্রের সংস্কৃতি। একটি মেয়ের ধর্ষণ ও হত্যা বুঝিয়ে দিল, মেয়েরা বেঁচে আছে। অতন্দ্র, সদা জাগরূক।