সরব: ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্তির দিনটিতে জড়ো প্রতিবাদীরা, ট্রাফালগার স্কোয়্যার, লন্ডন, ২৪ ফেব্রুয়ারি। রয়টার্স
কয়েক দিন আগে একটা সমীক্ষা চোখে এল। এক নামী আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট বলছে, গত এক বছর ধরে যে যুদ্ধ হচ্ছে, ২৮টি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, সে সব দেশের ৬৪ শতাংশ মানুষের অবস্থান এ বিষয়ে ইতিমধ্যে পাল্টায়নি।
কী ‘অবস্থান’ তাঁদের, খুব জানতে ইচ্ছে করল। ভাল করে পড়েশুনে বোঝা গেল, তাঁরা এই এক বছর ধরে সমানে টিভির সামনে বসে কিংবা খবরের কাগজে চোখ রেখে যুদ্ধের হালচাল ‘ফলো’ করেছেন। নিয়ম করে, নিজের নিজের বাড়িতে বসে। সমীক্ষা বলছে, ‘গ্লোবাল পাবলিক ওপিনিয়ন’ একটুও বদলায়নি এর মধ্যে, অধিকাংশই মনে করছেন ইউক্রেনের উপর আক্রমণ শানিয়ে রাশিয়া খুব ভুল কাজ করেছে, অন্যায় করেছে, এ সব একদম মানা যায় না!
যাক, ভারী একটা স্বস্তি হল জেনে। তাই তো। এমন সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে গত ৩৬৬ দিন ধরে— এত লোক মরছে, এত লোক সর্বস্বান্ত দেশছাড়া হয়ে যাচ্ছে, বাবা-মা হারিয়ে শিশু অনাথ হয়ে যাচ্ছে, কত পরিবার শিশুদের খুঁজেই পাচ্ছে না, মেয়েদের উপর বর্বরতা চালানো হচ্ছে, বোমা বারুদ বিস্ফোরণ ছাড়াও দুই পক্ষেই সাধারণ মানুষের উপর চলছে নৃশংস অত্যাচার— এক কথায় বলতে গেলে আগুন জ্বলছে ইউক্রেনে। কিন্তু এমন বহ্ন্যুৎসব দেখেও চার পাশে তত হইচই নেই তো? হইচই কেন, ততটা আলোচনাও নেই। কিন্তু, না, সমীক্ষা যখন বলছে, এত লোক টিভির সামনে বসে খবর শুনছে, কাগজে খবর পড়ছে— তা হলে হয়তো আমিই, আমরাই, ভুল ভাবছিলাম।
আমাদেরই বা দোষ কী। আগেকার কথা যেটুকু শুনেছি, যেটুকু মনে পড়ে, কোথাও যুদ্ধ লাগলে লাগাতার উদ্বেগ আর ক্ষোভের স্রোত বওয়াটাই আমাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে আলোড়ন। রাস্তায় আন্দোলন। এই সব। সে রকমটাই হয়তো প্রত্যাশায় ছিল।
আগেকার দিন বলতে, অবশ্যই পাঁচ-ছয় দশক আগের কথা। শুনেছি ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় পৃথিবী জুড়ে কত কী ঘটছিল। এক দিকের আমেরিকা যুধ্যমান, আর অন্য দিকের আমেরিকা প্রতিবাদে ফুটন্ত। ছাত্রছাত্রী তরুণতরুণী শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি সমাজে কী কাণ্ডটাই হচ্ছে তখন। শুনেছি, আমাদের দেশেও তরুণরা রব তুলত ‘আমার নাম তোমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’। তার পরেও দেখেছি ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ হুঙ্কারে মানবমিছিল পথ আটকে দিচ্ছে, যদিও তখন যুদ্ধ শেষ। অনেক পরে, কুয়েত যুদ্ধের সময়ে দেখেছি, ১৯৯০-৯১’তে এ দেশে নানা শহরে আমেরিকান কনসুলেটের সামনে বিক্ষোভে সারে সারে দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েরা।
এই শতকেও। ইরাক আর আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় কত রাগ-বিরক্তি। ভারতে, ইউরোপের নানা দেশে, আমেরিকান ভূখণ্ডে, ‘যুদ্ধ নয়’ মর্মে জনধ্বনি। টিভিতে প্রাইমটাইমে তর্কাতর্কি। নিজের কাজের জায়গায় দেখেছি, রাগত চিন্তিত লেখার ঢল নামত সমানে। চিঠিপত্র আসত। সবার শেষ বক্তব্য একই— যুদ্ধ বন্ধ হওয়া দরকার, এখনই।
যুদ্ধ অবশ্য বন্ধ হয়নি। যা ঘটার তা-ই ঘটেছে, ঘটতে থেকেছে। কিন্তু যুদ্ধ দেখে সাধারণ মানুষ যে প্রায় নিয়মিত প্রতিক্রিয়া জানাত, সেটাই হয়তো খুঁজে ফিরছিলাম গত এক বছরে। চোখে পড়েনি। মিডিয়া এবং সোশাল মিডিয়া এখন ভরে গিয়েছে ক্ষুদ্র রাজনীতির প্রচারে আর ঝগড়ায়। আলোচনা-বিতর্ক চলছে গণতন্ত্রের বিপদ বা দক্ষিণপন্থার জয় নিয়ে, যুদ্ধ তাতে জায়গা পাচ্ছে কই।
অথচ সন্দেহ নেই, একুশ শতকের তৃতীয় দশকের এই যুদ্ধ যা দাঁড়াচ্ছে, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এমন কাণ্ড কখনও হয়নি। সহজ কথা তো নয় সেটা। যুদ্ধবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ যেন ভুলিয়ে দেওয়ার জোগাড় করছে যে, গত শতকের দু’টি ভয়াল বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ত্রসংবরণ, সঙ্কট সমাধান ও বহুপাক্ষিক আদানপ্রদানের লক্ষ্যে কত সাবধানতা নেওয়া হয়েছিল, কত আন্তর্জাতিক মঞ্চ, সংস্থা তৈরি হয়েছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের প্রচেষ্টায় বিকৃত ক্ষমতালিপ্সু রাষ্ট্রশক্তিকে আটকানোর কথা ভাবা হয়েছিল। একুশ শতকের ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তান যুদ্ধ, সিরিয়া সঙ্কটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধও কিন্তু প্রমাণ করেছে, ১৯৪৫-পরবর্তী সে সব আয়োজনই ব্যর্থ। আর তাই, কেবল রাশিয়া নয়, পশ্চিমি গণতান্ত্রিক দেশগুলিও অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহের বিপুল চক্রেই আপাতত মনোযোগী।
নানা কারণেই যুদ্ধ নিয়ে বেশি কথা বলতে চায় না অনেক দেশের সরকার। ভারতের কথাই ধরা যাক। রাশিয়া আর আমেরিকার ‘মিত্রতা’র সাঁড়াশি চাপে ভারত মহা মুশকিলে। দিল্লির পক্ষে মস্কোর মতো পুরনো বন্ধুকে চটানো অসম্ভব, কত সময়ে কত সহায়তা করেছে সে, এখনও করে। আবার, নতুন বন্ধুর নাম যখন ওয়াশিংটন, তাকেই বা ছেড়ে দেওয়া যায় কী করে? শিশুপাঠ্য ছড়া বলতেই পারে, ‘মেক নিউ ফ্রেন্ডস, কিপ দি ওল্ড/ ওয়ান ইজ় সিলভার, আদার ইজ় গোল্ড’, ওল্ড আর নিউ ফ্রেন্ড-এর মধ্যে কালান্তক যুদ্ধ লাগলে কী হবে, ছড়া সে কথা কিছু বলেছে কী?
শুধু ভারত কেন। পশ্চিম বিশ্বে উদার গণতান্ত্রিক দেশ বলে পরিচিত যারা, তাদেরও রাষ্ট্রীয় স্তরে তেমন যুদ্ধবিরোধিতা নেই। পৃথিবীর লিবারাল শিবির— অর্থাৎ ওই সমীক্ষার ৬৪ শতাংশ লোক সম্ভবত যে গোত্রের মধ্যে পড়েন— তাঁরা পুতিনের কর্তৃত্ববাদী রাশিয়ার প্রতি অতিমাত্রায় ক্ষুব্ধ বলেই হয়তো ভাবটা এমন, রাশিয়া যা করছে, তাতে যুদ্ধ থামার প্রশ্ন ওঠেই বা কী করে। বস্তুত, ভারত যে যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করছে, তাতেই নেটো-ভুক্ত দেশগুলি বিস্তর চটেছে। ইউরোপ-আমেরিকায় এই যে রাজনৈতিক নৈঃশব্দ্য, তার কারণ কি এক দিকে দক্ষিণপন্থার ক্রম-উন্মেষ, অন্য দিকে অন্ধ রাশিয়া-ভীতি? কে জানে।
তবে, রাষ্ট্র বা সরকার ছাপিয়ে বৃহত্তর সমাজের নৈঃশব্দ্যটাই বেশি বিস্ময়কর। লন্ডন, নিউ ইয়র্কের মতো দু’-একটা ক্ষেত্র বাদ দিলে ভারতীয় সরকার যা-ই ভাবুক না কেন, ভারতের সচেতন জনসাধারণ কি সরকারি নীতি মাথায় রেখে নীরবতা পালন করছেন? বিরোধী দলগুলো, নেতারা? তাঁদের কোনও মত আছে কি এ বিষয়ে? কে জানে!
আসলে যুদ্ধের মধ্যে তো কেবল কূটনীতি আর রাজনীতিই থাকে না— থাকে একটা বিরাট মাপের মানবিকতার প্রশ্নও। সেই প্রশ্ন রাষ্ট্র তুলতে পারে ঠিকই (যেমন ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে নেহরুর নির্জোট শিবিরভুক্ত দেশ তুলত), কিন্তু সাধারণত প্রশ্নটা উঠে থাকে সমাজের অন্দর থেকেই। রাষ্ট্র বা সরকার তেমন কিছু না করলে তো আরও বেশি করেই সমাজের সেই প্রশ্ন তোলার কথা ছিল!
কিন্তু দেশের ভিতরে এবং বাইরে সমাজের সেই প্রশ্ন তোলার ক্ষমতাটা ফিকে থেকে ফিকেতর হয়ে এখন নেহাত এক বিলীয়মান আভা। যে আভার কোনও বর্তমান নেই, অতীতকে মনে করিয়ে দেওয়া আছে শুধু।
না, এমন নয় যে, আমাদের সমাজ ‘ভাবলে’-ই, এবং কিছু আলোড়ন তৈরি করলেই, সমাধানটা হাতের নাগালে এসে যেত। কথাটা তা নয়। কথাটা হল, কী হবে কী হবে না, অত হিসেব না করেও তো আগেকার ‘আমরা’ অস্থির হয়ে পড়তাম এমন যুদ্ধপরিস্থিতিতে। আর এখনকার ‘আমরা’ এ সব ‘ফলো’ করি, কিন্তু ‘সামান্য’ বিষয়ে আর বিচলিত হই না। যুদ্ধ এসে বুঝিয়ে দিল, ‘আমরা’ কত পাল্টে গেছি। প্রযুক্তি-অধ্যুষিত, অতিমারি জর্জরিত, অর্থসঙ্কট-আক্রান্ত, আত্মকেন্দ্রিকতর আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বায়িত— এবং আরও অনেক বেশি বিশ্ববিমুখ। সাক্ষী রইল ইউক্রেন।