Ranajit Guha

কী ইতিহাস? কার ইতিহাস? রণজিৎ গুহ আর বাঙালির জ্ঞানচর্চা

রণজিৎ গুহর সঙ্গে আলাপ হওয়ার অন্তত বছর দশেক আগে থেকেই তিনি আমার বৌদ্ধিক-চেতনে বিচরণ করেন। পরিচয় ঘটেছিল তাঁর প্রথম বই, ‘আ রুল অফ প্রপার্টি ফর বেঙ্গল’-এর মাধ্যমেই। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, কখন সেই বইয়ের কথা জেনেছিলাম।

Advertisement

রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩ ২২:১২
Share:

রণজিৎ গুহ। ফাইল চিত্র।

রণজিৎ গুহর সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। প্রথম আলাপের পর আমাদের সম্পর্ক যে ভাবে গভীর হল, তার পিছনেও আনন্দবাজার পত্রিকার একটা ছোট ভূমিকা আছে। সালটা বোধ হয় ১৯৮২, রণজিৎ গুহর ‘আ রুল অফ প্রপার্টি ফর বেঙ্গল’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ সবে প্রকাশিত হয়েছে। তখন আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান নিখিল সরকার আমাকে বললেন ওই বইয়ের রিভিউ লিখতে। লেখাটি ছাপা হওয়ার পর বিজ়নেস স্যানডার্ডের গৌরী চট্টোপাধ্যায়, আমার গৌরীদি আমাকে খুব জোরজার করলেন সমালোচনাটি রণজিৎ গুহকে পাঠাতে। মনে কুণ্ঠা থাকা সত্ত্বেও লেখাটি রণজিৎ গুহকে ক্যানবেরাতে ডাক মারফত পাঠিয়ে দিই। সপ্তাহ দু’-তিন পর রণজিৎদার কাছ থেকে একটি চিঠি পাই তাঁর মুক্তোর মতো হাতের লেখায়। রিভিউটা ওঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। সেই শুরু। শিক্ষক-ছাত্র, গুরু-শিষ্য, যা বলুন।

Advertisement

এমন নয় যে রণজিৎ গুহর মৃত্যু অপ্রত্যাশিত ছিল। পা রেখেছিলেন একশোতম বর্ষে। সঙ্গে টানা বেশ কিছু দিনের অসুস্থতা। কিন্তু মৃত্যু, যতই অনিবার্য হোক না কেন, ঠিকই কিছুটা অপ্রস্তুত করে দেয়। তাই এক গভীর অভাব বোধ ঘুম কেড়ে নিল, যখন ২৮ এপ্রিল মাঝরাতে ওঁর জীবনাবসানের খবর পেলাম। যদি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে কিছু হয়, এ তেমনই। না মোছার মতো একটি রেখা চিরতরে টানা হল।

রণজিৎ গুহর সঙ্গে আলাপ হওয়ার অন্তত বছর দশেক আগে থেকেই তিনি আমার বৌদ্ধিক-চেতনে বিচরণ করেন। পরিচয় ঘটেছিল তাঁর প্রথম বই, ‘আ রুল অফ প্রপার্টি ফর বেঙ্গল’-এর মাধ্যমেই। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, কখন সেই বইয়ের কথা জেনেছিলাম। তখন ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট’ ছিল ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে এমারেল্ড বোয়ায়। সেখানে বরুণ দে-র অফিসে গিয়েছিলাম। আমি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাস নিয়ে পড়ছি। প্রথম বর্ষের ছাত্র। ১৯৭০ সালের শরৎকাল। কোনও রাজনৈতিক গোলমালের জন্য কলেজ বন্ধ ছিল। বরুণ দে আমাকে ইতিহাস পড়তে শেখানোর ভার নিয়েছিলেন। যে সব বই পড়া বাধ্যতামূলক বলে সে দিন বলেছিলেন, তার মধ্যেই ছিল রণজিৎ গুহর এই বইটি। কিছু দিন পর আমার শিক্ষক অশীন দাশগুপ্ত, যাঁর ইতিহাসচর্চার ধরন বরুণবাবুর থেকে একেবারেই আলাদা, ফের রণজিৎ গুহর সেই বইটির কথা উল্লেখ করেন। বলেন, আমার সেটি পড়া উচিত। দুই শিক্ষকের কথা আমি অমান্য করতে পারিনি। বরুণ দে-কে জিজ্ঞাসা করি, কোথায় বইটি পেতে পারি। নিজের বইটিই আমাকে পড়তে দেন তিনি। খানিকটা ঘোরের মধ্যেই পড়ে ফেলি সবটা। বইটির মুখবন্ধ লেখা তৃতীয় পুরুষে (‘‘তারুণ্যে এই লেখক, নিজের সময়ের অধিকাংশের মতোই বেড়ে উঠেছেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ছায়ায়’’)। বইটির সাবটাইটল ‘অ্যান এসে অন দ্য আইডিয়া অফ পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট’ আমাকে বিভ্রান্ত করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর কথা জানতাম বাংলার কৃষিকেন্দ্রিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসাবে। কৃষিকেন্দ্রিক ইতিহাসের কথা বললে আমার ইরফান হাবিব এবং এন. কে. সিংহের বইয়ের কথা মনে পড়ে। কিন্তু ‘আইডিয়া’ বা ভাবকেন্দ্রিকতার কী সম্পর্ক কৃষিকেন্দ্রিক ইতিহাসের সঙ্গে? বইটা পড়তেই শুরু করেছিলাম খানিকটা বিস্ময়, কিছুটা বিভ্রান্তি আর আতঙ্ক নিয়ে। উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ি আমি। সবটা বুঝেছি বলে নয়। রণজিৎ গুহর গদ্যই এত সুন্দর! বইটি লেখার ধরন দেখেই প্রথমে মুগ্ধ হই। রণজিৎবাবুর কত বাক্য, শব্দবন্ধ যে গেঁথে যায় আমার স্মৃতিতে। ‘‘...মেড ইট ইর‌্যাটিক লাইক আ চাইলডস ফার্স্ট অ্যাটাক অন আ মেকানো সেট।’’ (‘‘... খেলনার উপর শিশুর আক্রমণের মতো এটিকে অনিশ্চিত করে তুলেছিল’’)। ‘‘পায়োনিয়ার্স সেলডম মেক ভার্চু অফ পেশেন্স...’’ (অগ্রগামীরা খুব কমই ধৈর্যের গুণ দেখেন)। ইতিহাস রচনা এমন সম্ভ্রান্ত ও শৌখিন হতে পারে! নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম। এখনও মনে হয়, উপস্থাপনার দিক থেকে সেটিই ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে লেখা শ্রেষ্ঠ বই। পরবর্তী পাঠে ক্রমে বুঝেছি ইতিহাস বোধের নিরিখে ওই কাজ কতটা স্বতন্ত্র এবং উল্লেখযোগ্য।

Advertisement

বইটি যখন ভাবনাচিন্তা এবং লেখার প্রাথমিক পর্যায়ে, ইতিহাসবিদরা উপনিবেশে ব্রিটিশ নীতি তৈরির ক্ষেত্রে এই সব ‘আইডিয়া’-র গুরুত্ব তখনও পরখ করে দেখেননি।

বইটি যখন ভাবনাচিন্তা এবং লেখার প্রাথমিক পর্যায়ে (প্রথমে ৫০-এর দশকের মাঝামাঝি বাংলায় লেখা একটি অসম্পূর্ণ সংস্করণ, পরে ১৯৬৩ সালে ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করে মাউন্টন অ্যান্ড কম্পানি), ইতিহাসবিদরা উপনিবেশে ব্রিটিশ নীতি তৈরির ক্ষেত্রে এই সব ‘আইডিয়া’-র গুরুত্ব তখনও পরখ করে দেখেননি। নীতি তৈরি নিয়ে অন্য রকম ধারণা ছিল। যা মূলত একটি গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত স্বার্থের ভাবনা দিয়েই ব্যাখ্যা করা হত। রণজিৎ গুহর বই ইতিহাসচর্চায় বেড়া ভেঙে দেয়। তিনি দেখান কী ভাবে ব্যবসায়িকতা, বিভিন্ন দেশের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য, প্রকৃতিতন্ত্রের মতো ভাবনার প্রভাব রয়েছে ১৮ শতকের কৃষি নীতি তৈরির ক্ষেত্রে। তাঁর যুক্তিতে উপনিবেশবাদের প্রয়োজন, অবাধ বাণিজ্যের পরিকল্পনা, পলিসি তৈরির আসল ভাবনার থেকে ফলকে বিচ্যুত করে দেয়। জমিদার, যাঁদের কিনা সম্পত্তি হাতে পেয়ে হওয়ার কথা ছিল উন্নততর পুঁজিবাদী কৃষক, তাঁরা হয়ে গেলেন ঠিক উল্টোটা। অদৃশ্য পরজীবী মালিক। এক অর্থে, শোষক।

সময়ের অনেক আগেই ইতিহাসের ভাবকেন্দ্রিক চর্চার দিক নির্ণয় করেছেন রণজিৎ গুহ। সঙ্গে আরও অনেক কিছু করেছেন। আর সেখানেই ‘আ রুল অফ প্রপার্টি’ নিজের ঐতিহাসিক ক্ষেত্রকে অতিক্রম করে। নিজের বইয়ে দ্বিতীয় সংস্করণের (১৯৮১) মুখবন্ধে, পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সে দিকেই। তিনি লেখেন, ‘ইট (দিস বুক) অ্যাড্রেসেস ইটসেল্ফ টু দ্য কোয়েশচেন অফ কলোনিয়ালিস্ট নলেজ’ (ঔপনিবেশবাদী জ্ঞান সংক্রান্ত প্রশ্নের প্রতি নিবেদিত এই বই)। রণজিৎদার বিশ্বাস ছিল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সঙ্গে প্রকৃতিতন্ত্রের যোগের ব্যাখ্যা করে তিনি রাজনৈতিক অর্থনীতির একদম মূলে ফিরে গিয়েছেন। ফ্রান্সে প্রকৃতিতন্ত্রই ছিল সামন্ততন্ত্রের সমালোচক। প্রাচীন বন্দোবস্তের সঙ্গে লড়তে সাহায্য করেছিল। কিন্তু ব্রিটেন, ‘‘সে সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক পুঁজিবাদী শক্তি যখন ভারতে প্রকৃতিতন্ত্রের ভাবনা প্রয়োগ করল, তখন তা হাস্যকর হয়ে উঠল। তা জমিকেন্দ্রিক একটি নয়া-সামন্ততান্ত্রিক গোষ্ঠী তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করল, ঔপনিবেশিক সময়ে প্রাক্‌-পুঁজিবাদ নানা ভাবনার বীজ রোপণও করল।’’ রণজিৎদা একটি কথায় জোর দেন যে, ‘‘একটি একেবারেই বুর্জুয়া ধারার জ্ঞানচর্চাকে পশ্চাতমুখী করে একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ক্ষমতার রসায়নের মাঝে মানিয়ে নিতে বলা হয়’’ আর এই ‘এপিস্টেমোলজিকাল প্যারাডক্স’ ব্যবহার করেই তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে বুঝতে চেয়েছেন। জ্ঞানচর্চার আরও কিছু ভান্ডারের কথা উল্লেখ করেছেন রণজিৎদা, যা ইংরেজ আমলে ভারতে আসে। সে সবও পশ্চিমে সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে লড়াইয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু ভারতে এসে সে সব চিন্তার ‘এক সমুদ্র বদল ঘটে’, যখন ঔপনিবেশবাদীরা নতুন একটি দেশে নিজেদের ঘাঁটি শক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। ৮০-র দশকে যখন রণজিৎদা এ সব কথা লিখছেন, তখন যেন পাঠকদের সতর্ক করতে করতে যাচ্ছেন নিজের নবতম বৌদ্ধিক দুশ্চিন্তার বিষয়ে। এ সবই বড় আকারে দেখা যায় তাঁর দ্বিতীয় বই ‘এলিমেন্টারি আসপেকটস্‌ অফ পেজ়্যান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’ (১৯৮৩) এবং ‘সাবঅলটার্ন স্টাডিজ়’-এর প্রথম খণ্ডে। এ সব কাজের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতিলাভ করেন রণজিৎদা। এই দু’টি বইয়ের গুরুতর জায়গা হল, ঔপনিবেশিক ভারতে ক্ষমতার ভাগাভাগির বিশ্লেষণ রয়েছে পাতায় পাতায়। ক্ষমতা ও আধিপত্য নিয়ে ভাবনা অবশ্য রণজিৎদার ছেলেবেলার অবদান। একটিমাত্র আত্মজীবনীমূলক রচনা যে তাঁর রয়েছে, তাতে উল্লেখ করেছেন, কী ভাবে তাঁর আশপাশের অনেককে, এমনকি বন্ধু, খেলার সঙ্গীদের কাউকে কাউকে প্রজা বলে সম্বোধন করা হত। আর সেই সঙ্গীরা রণজিৎদার পরিবার পরিজনদের মনিব বলতেন। এই প্রজা শব্দটি রণজিৎদার স্মৃতিতে খুব স্পষ্ট ভাবে বসে যায়। এই শব্দটিই জমিদারদের ক্ষমতায়নের চিহ্নক। যা কিনা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফসল। এবং গ্রাম বাংলায় পুঁজিবাদী জমিদারেরা যে শোষণের ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন, তা তাঁকে মনে করাত এই শব্দটি। ভারতীয় সমাজে এই গোষ্ঠীর ক্ষমতা-চর্চা তাঁর ভাবনা এবং কাজের একটি বড় অংশ হয়ে ওঠে। তাঁর কথায়, ‘‘যে তীক্ষ্ণ প্রান্ত ব্যবহার করে পশ্চিমে পুঁজিবাদ তার আধিপত্য গড়ে তুলেছিল, ঠিক তার উল্টো ভোঁতা দিকটির দ্বারা প্রাচ্যের জনতাকে বশীভূত করা সুবিধাজনক বলে মনে করা হয়েছিল।’’

ভারতের কি কোনও ভারতীয় ইতিহাস হতে পারে? প্রশ্ন তুলতে উৎসাহ দিয়েছিলেন রণজিৎ গুহ।

রণজিৎদা যা লিখেছেন, তার প্রায় সব কিছুরই একটি অবিচ্ছেদ্য ধারণা আছে। তা হল প্রাপ্ত জ্ঞানের সব কিছুর প্রতিই আমূল সন্দেহ। ঔপনিবেশিক ও অভিজাতদের আধিপত্য নিয়ে তাঁর সমালোচনা আরও প্রশ্ন তুলতে উৎসাহ দিয়েছিল। ভারতের কি কোনও ভারতীয় ইতিহাস হতে পারে? সে প্রশ্নও উঠে এসেছে। ইতিহাসচর্চার একটি পরিচিত ভঙ্গি হল পশ্চিমি ধারার অনুসরণ করা, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক ভাবনার দ্বারা শৃঙ্খলবদ্ধ হওয়া। তা থেকে মুক্ত হওয়ার যে প্রশ্ন ওঠে, সেই স্পৃহাই তাঁকে সাহিত্যচর্চার দিকে ঠেলে দেয়। ভাবনার এই ধারার একটি ফসল হল ‘হিস্ট্রি অ্যাট দ্য লিমিট অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’। ইংরেজি ভাষায় লেখা তাঁর শেষ বই। এই কাজটি রণজিৎদার মুগ্ধ অনুরাগীদের অনেকেরই মেটাফিজ়িকাল বলে মনে হয়েছিল। এখানে তিনি নিজের পাঠকদের ভিন্ন ভাবে ভাবার অনুরোধ করেছিলেন। মিউজ় অব ক্লিয়োকে একটি মিউজ় হিসাবেই দেখতে বলছিলেন, আলাদা কোনও ভাবনার ধারা হিসাবে না দেখে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর করেছিলেন কিছু ক্ষেত্রে। সমালোচনার ধারণাটি তাঁকে অরওয়েলের ‘শুটিং অ্যান এলিফ্যান্ট’ পড়তে বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উদ্বেগের একটি বিশ্লেষক হিসাবে। কনরাডের ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ পড়েন ব্রিটিশদের নেতৃত্বহীন কর্তৃত্বের পরিপূরক হিসাবে। নদীর প্রতিটি বাঁকে, মার্লোকে যা সময়ের আদি প্রান্তে নিয়ে যায়। ঠিক জঙ্গল শুরু হয়েছিল যেখানে, সেখানেই ছিল ধোঁয়াশা। যে কোনও ধোঁয়াশার উপর কর্তৃত্ব ফলানো যায় হিংসা এবং জোরের মাধ্যমেই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রেই যা উপস্থিত ছিল। যে কোনও বিষয় নিয়ে চর্চা যেন এই সমীকরণের বাইরে গিয়ে হয়, রণজিৎদা নিজের ছাত্রদের তাতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আদালতে সাক্ষ্যের নিছক একটি অংশকে প্রাসঙ্গিক করে তুলে ‘চন্দ্রাজ় ডেথ’ প্রবন্ধে সূক্ষ্ম ভাবনার প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন কী ভাবে যৌন শোষণ, বর্ণবৈষম্য এবং লিঙ্গসংহতির কাঠামো বোঝা সম্ভব এবং কোন কারণে ১৯ শতকের মাঝামাঝি বাংলার গ্রামে নিম্নবর্গের এক মহিলার মৃত্যু হয়েছিল।

জীবনের শেষ সময়ে শুধু বাংলা ভাষাতেই লিখতে চেয়েছিলেন রণজিৎ গুহ।

জীবনের শেষ প্রান্তে এ সব প্রশ্ন রণজিৎদাকে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর সবচেয়ে আপন এবং প্রেমের— বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের কাছাকাছি। শুধু বাংলা ভাষাতেই লিখেছেন এই সময়টিতে। রামমোহন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এবং সমকালীন কবিদের নিয়ে লিখেছেন। জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলি তুলে ধরে এই সব লেখার বিশ্লেষণ করেছেন। রণজিৎ গুহ নিজের সব বাংলা বই লিখেছেন ভিয়েনার বাড়িতে বসেই। অতিমারির আগে প্রতি বছর রণজিৎদা ও তাঁর স্ত্রী মেকতিল্ডের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমার ও আমার স্ত্রীর অডেনের দু’টি লাইন মনে পড়ত, ‘‘টুওয়ার্ডস দ্য এন্ড হি সেল্ড ইনটু অ্যান একস্ট্রা অর্ডিনারি মাইল্ডনেস, অ্যান্ড অ্যাঙ্কার্ড ইন হিজ় হাউস অ্যান্ড রিচড হিজ় ওয়াইফ, অ্যান্ড রোড উইদইন দ্য হারবর অফ হার হ্যান্ড...’’।

দীর্ঘ আয়ু এবং ততোধিক কর্মবহুল জীবন সত্ত্বেও রণজিৎ গুহর বৌদ্ধিক যাত্রা কিছুটা অসম্পূর্ণ বটেই। তবে আমার মনে হয়, তিনি এমনটাই চেয়েছিলেন। নিজে প্রশ্ন তুলেছেন, আমাদের প্রশ্ন তুলতে শিখিয়েছেন। যে সবের অনেক ক্ষেত্রেই সে ভাবে উত্তর থাকে না। ওটাই ওঁর ধারা। সন্দেহপ্রবণতার দূতই যেন ওঁকে ভিয়েনা উডসের দিকে নিয়ে গিয়েছিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement