Feminism

চেতনা জুড়ে আশ্চর্য জাগরণ

দেশে ফিরে গিয়ে আপন ভাস্কর্যে এই নারী-আন্দোলনকে ফুটিয়ে তুলতে চান তিনি। ভেরা অবশ্য সন্দেশখালির ঘটনা জানেন না।

Advertisement

প্রহেলী ধর চৌধুরী

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:০৩
Share:

মেয়েটির নাম ভেরা লু, দেশ তাইওয়ান। ১৪ ডিসেম্বর অভয়া কাণ্ডকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নারী-রূপান্তরকামী-কুইয়রদের প্রতিবাদ মঞ্চে শামিল হয়েছিলেন পেশায় ভাস্কর বছর পঁচিশের এই তরুণী। দেশে ফিরে গিয়ে আপন ভাস্কর্যে এই নারী-আন্দোলনকে ফুটিয়ে তুলতে চান তিনি। ভেরা অবশ্য সন্দেশখালির ঘটনা জানেন না। রাজ্যের বাইরের বেশির ভাগ মানুষই জানেন না, বা শুনলেও মনে রাখেননি। অথচ, শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকা অসীম শক্তিধর স্থানীয় বাহুবলীদের বিরুদ্ধে সন্দেশখালির মহিলারা যে ভাবে এগিয়ে এসেছিলেন, যে ভাবে নথিভুক্ত করেছিলেন নিত্য দিন ঘটে যাওয়া ইভটিজ়িং আর শ্লীলতাহানির অভিযোগ, সেই ক্ষোভের আগুন, সেই বিপ্লবচেতনা, হঠাৎই মাঝ পথে হারিয়ে গেল কেন?

Advertisement

আসলে মেয়েদের আন্দোলন বড় সহজ কথা নয়। আন্দোলন মাত্রেই নয়, কিন্তু মেয়েদের লিঙ্গভিত্তিক প্রান্তিকতা তাদের লড়াইকে আরও কঠিন করে দেয়। সহজেই অভিমুখ ঘুরে যায়, সহজেই ‘হাইজ্যাকড’ হয়ে যায় নারী-আন্দোলন। যেমন ঘটেছিল ফরাসি বিপ্লবের সময়। যে লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল নারী ও ক্রীতদাসদের সমানাধিকারের দাবিতে, সেই বিপ্লবই কয়েক বছরের মধ্যে লিঙ্গসাম্যের দাবিটিকে পাশে সরিয়ে রেখে প্রকাশ করেছিল ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস অব ম্যান অ্যান্ড অব দ্য সিটিজ়েন, আর তাকে দেশের সংবিধানের ভূমিকাতে জুড়ে দিয়ে বেমালুম চেপে গিয়েছিল মেয়েদের দাবিগুলি। এমনতর লিঙ্গপক্ষপাতের প্রতিবাদে ওলাম্প ডু-গুজ ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস অব ওম্যান অ্যান্ড অব দ্য ফিমেল সিটিজ়েন প্রকাশ করেন— প্রতিটি ‘সিটিজ়েন’ শব্দের সঙ্গে ‘উইমেন সিটিজ়েন’ শব্দটি জুড়ে দিলে, তাঁকে গিলোটিনে চাপানো হল, প্রতিবিপ্লবী বলে দাগিয়ে দেওয়া হল।

দু’শো বছরেও এই অবস্থা পাল্টায়নি। ১৯৬০-৭০’এর দশকে এল বিংশ শতকের নারী-আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গ। প্রথম তরঙ্গে ভোটাধিকার, শিক্ষার অধিকার পাওয়ার পর, দাবি করা হল গার্হস্থ হিংসা নির্মূলীকরণ আইন, শ্রম আইন, অর্থনৈতিক সম্পদের সুষম বণ্টন, শিশু রক্ষণাবেক্ষণে রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা, গার্হস্থ কাজে পুরুষের অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি। নারী-আন্দোলনের এই দাবিগুলিকে সে সময় রাষ্ট্র, মিডিয়া ও ক্ষমতাবান স্বার্থান্বেষীর দল কী ভাবে ‘হাইজ্যাক’ করেছিল, তা নিয়ে ২০১৫ সালে সাংবাদিক সু এলেন ব্রডার প্রকাশ করেন সাবভার্টেড: হাউ আই হেল্পড দ্য সেক্সুয়াল রেভলিউশন হাইজ্যাক দ্য উইমেন্স মুভমেন্ট বইটি। লেখেন, কসমোপলিটান ম্যাগাজ়িন কী ভাবে তখন তাঁর মগজ ধোলাই করেছিল, আর কী ভাবে নারী-আন্দোলনের উদ্দেশ্যকে কেবলমাত্র মেয়েদের যৌনস্বাধীনতার লড়াই বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন। লিখেছেন, কী ভাবে গোটা আন্দোলনটা বেদখল হয়ে যাওয়ার অনেক দিন পর তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁর থেকে অনেক বেশি ক্ষমতাবান ও কৌশলী কিছু মানুষ এই আন্দোলনটিকে নিজেদের পুঁজিবাদী স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছিলেন তাঁরই মাধ্যমে। মেয়েদের আন্দোলন ঠেকানোয় অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছে সমাজ এবং পরিবারও।

Advertisement

এই সব কিছু ছাপিয়ে ২০২৪-এর নারী-আন্দোলন সফল। দোষীদের শাস্তি এখনও হয়নি ঠিকই, কিন্তু এই বিপ্লব শাসকের চোখে চোখ রেখে নিজেদের দাবিসনদের হিসাব বুঝেছে, এবং লাগাতার সরকারের দেওয়া কথা ও কাজের সংহতির পর্যানুক্রমিক মূল্যায়ন করেছে; কোনও রকম রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াইতে না-গিয়ে বর্তমান শাসকের কাছ থেকেই হকের নিরাপত্তা দাবি করেছে; দক্ষিণপন্থী বেনোজল ঢুকতে দেয়নি; এবং একটিমাত্র ঘটনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আবদ্ধ না থেকে মেয়েদের সার্বিক সমানাধিকারের দাবি তুলে ধরেছে।

ত্রুটিবিচ্যুতি অবশ্যই আছে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে নানান অন্তর্দ্বন্দ্ব হয়েছে, তাঁরা নানান দলে ভাগ হয়ে গেছেন। কিছু আন্দোলনকারী অতিবামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শ বা দক্ষিণপন্থী দলের ছত্রছায়ায় চলে গিয়ে এই মঞ্চটিকে ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছাতে চেয়েছেন। কেউ কেউ নিজেই নিজেকে এই গণআন্দোলনের স্বঘোষিত নেত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। কিন্তু, এটাই কি গণআন্দোলনের ধর্ম ও অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎ নয়? কোনও একটা আন্দোলনে, সবাই একই আদর্শ নিয়ে, একই রকম স্বার্থশূন্য ভাবে দিনের পর দিন প্রতিবাদ করবে; কোনও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, ক্ষমতা দখলের লড়াই বা ভ্রান্ত বিপ্লবচেতনা বাদ দিয়ে— এতটা কি আশা করা যায়?

বরং, অভয়ার জন্যে এই লড়াই যে ভাবে শুরু থেকে আজও মৌলিক দাবিদাওয়াগুলিকে কক্ষে রেখে এত দিন ধরে এই লড়াইকে জারি রেখেছে, তা তাৎপর্যপূর্ণ। যে ভাবে এই আন্দোলনের ট্রান্স কুইয়র, যৌনকর্মী ইত্যাদি নানান প্রান্তিক মানুষকে মূলস্রোত গণআন্দোলনের শরিক করেছে, তা-ও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এই নারী-আন্দোলন বহু ক্ষেত্রেই পুরুষদের পথে নামিয়েছে, শেখাতে পেরেছে যে, নারী-আন্দোলন মানে কেবল লিঙ্গ নারীর আন্দোলন নয়, নারীর হেতুতে করা আন্দোলন; শেখাতে পেরেছে যে, ফেমিনিস্ট মানে কেবল নারী-আন্দোলনকারী নন, নারীবাদী। অর্থাৎ নারী, পুরুষ কিংবা তৃতীয় লিঙ্গ যে ব্যক্তিই মেয়েদের সমানাধিকারের দাবিকে সমর্থন করেন, তিনিই ফেমিনিস্ট। এ প্রাপ্তি কি কম?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement