গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বিচারপতিরা কি সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন? সাম্প্রতিক কালে কলকাতা হাইকোর্টের এক বিচারপতির ভূমিকা নিয়ে সমাজে এমন আলোচনা শুরু হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতেই আনন্দবাজার অনলাইনে এই লেখা। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হিসেবে।
সম্প্রতি রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে স্কুলে চাকরিপ্রার্থীদের বিক্ষোভ তুঙ্গে উঠেছে। গোটা রাজ্য উত্তাল। এর মূলে রয়েছে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি এবং অবিচারের কাহিনি। মেধাতালিকায় নাম না থেকেও কেউ কেউ চাকরি পাচ্ছেন। মেধাতালিকা তৈরির জন্য যে পরীক্ষা হয়েছে, তাতে অকৃতকার্য হয়েও কেউ কেউ চাকরি পাচ্ছেন। অথচ মেধাতালিকার উপরের দিকে নাম থাকা সত্ত্বেও অনেকে চাকরি পাচ্ছেন না। এক কথায়— চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আইনের শাসনের সম্পূর্ণ অবমাননা করা হচ্ছে।
এই সব ব্যাপারে বিচারপ্রার্থীরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। নাম না-করে বলছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদালত ‘সদর্থক’ ভূমিকা নিয়েছে। এবং মূলত সেই কারণেই এটা নিয়ে একটা বিতর্কও তৈরি হয়েছে— আদালতের এই ভূমিকা কতটা সংবিধানসম্মত?
বিচারপতিদের ভূমিকা নিয়ে বর্তমান সময়ে নানা রকমের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই বিতর্ক স্বাভাবিক। কারণ, বিচারব্যবস্থার ভূমিকা সমাজে ক্রমশ আরও গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। এর প্রধান কারণ, আমার মনে হয়, বিচারবিভাগের প্রতি দিন-দিন মানুষের প্রত্যাশা বৃদ্ধি পাওয়া। মানুষ মনে করছেন, কোথাও ন্যায়বিচার না-পাওয়া গেলেও আদালতে পাওয়া যাবে। বিচারব্যবস্থা তাঁকে সেই ‘বিচার’ দেবে।
আইনের চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্যে যেতে চাই না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে, আদালতের এই ভূমিকা অন্তত মানুষের মনে বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাকে অনেকটা দৃঢ় করেছে। সেটা একটা শুভলক্ষণ। আশা করি, আগামী দিনে আদালতের এই সদর্থক ভূমিকার ফলে মানুষ সুবিচার পাবে।
এটা স্বীকার করতেই হবে যে, কাগজেকলমে আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। এবং সংবিধানে বর্ণিত আমাদের রাষ্ট্রের যে চেহারা, সেটা হল ভারত একটি ‘সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’। সংবিধানের মুখবন্ধেই এটা পরিষ্কার বলা আছে। এটা অনস্বীকার্য যে, রাষ্ট্রের এই সংবিধান-স্বীকৃত চেহারা আমরা স্বাধীন দেশ বলেই সম্ভব। পরাধীন ভারতে রাষ্ট্রের এই চেহারা অকল্পনীয় ছিল।
পরাধীন ভারতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ এ কথাটা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই কারণে যে, সাধারণ মানুষের সুবিচার পাওয়ার যে জন্মগত অধিকার, বৃটিশ-শাসিত ভারতীয় বিচারব্যবস্থা যেন তাকে মান্যতা দেয়। বিচারের বাণী যেন নীরবে-নিভৃতে কেঁদে না-মরে!
কিন্তু ছবিটা খুব একটা বদলায়নি। রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন প্রায় ৮০ বছর আগে। মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে তিনি ওই লাইনগুলো লিখেছিলেন। অর্থাৎ ১০০ বছরেরও বেশি। এই সময়কালে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। লিখিত সংবিধান এসেছে। যেখানে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা একটি স্বীকৃত মূল্যবোধ হিসাবে স্থান পেয়েছে। কিন্তু সুবিচার পাওয়ার যে জন্মগত অধিকার সাধারণ মানুষের, সেটা এখনও ঠিক চোখে পড়ে না।
যদিও আমাদের গণতান্ত্রিক ভারতকে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রের যে রূপ আমরা দেখতে পাই, সেটা রক্ষিত হয় না। অধিকাংশ সময়েই আমরা দেখি, রাষ্ট্র যে ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে ন্যায়বিচার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সংবিধানে বর্ণিত যে সার্বিক ন্যায়ের কথা বলা হয়েছে, অর্থাৎ রাজনৈতিক ন্যায়, সামাজিক ন্যায় এবং অর্থনৈতিক ন্যায়— রাষ্ট্রযন্ত্র সেটাকে মেনে চলছে না।
এখানেই বিচারবিভাগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা। যদিও বিচারবিভাগ রাষ্ট্রেরই একটি অংশ। কিন্তু রাষ্ট্র যে অবিচার করছে, তাকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং প্রশাসনিক ভাবে সংশোধন করার দায়িত্বে অতন্দ্র থাকার কথা বিচারবিভাগের। রাষ্ট্র যখন মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকারকে মান্যতা দেয় না, তখনই বিচারবিভাগের উপর দায়িত্ব পড়ে মানুষের সুবিচারের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার। এখানেই বিচারপতিদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনও কোনও বিচারপতি আছেন, যাঁরা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে মানুষের কথা না-ভেবে রাষ্ট্রের দেওয়া ব্যাখ্যাকেই মান্যতা দেন। আবার কোনও কোনও বিচারপতি আছেন, যাঁরা মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এবং প্রয়োজন পড়লে তাঁরা রাষ্ট্রের এই অচলায়তন ভাঙার চেষ্টা করেন।
পৃথিবীখ্যাত বিচারপতি লর্ড ডেনিং বলেছিলেন, বিচারপতিরা দু’ভাগে বিভক্ত। একদলকে বলা যায় ‘টিমোরাস সোল’ (ভীতু), অন্য দলকে তিনি বলেছেন ‘বোল্ড স্পিরিট’ (উদ্যমী)। আমাদের দেশের বিচারপতি কৃষ্ণ আইয়ারও বলেছেন যে, এক জন বিচারপতির ভূমিকা শুধু ক্রিকেট মাঠের আম্পায়ারের মতো নয়। এক জন বিচারপতিকে সামাজিক পট পরিবর্তনের অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে হবে। তবেই সংবিধানে বর্ণিত শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।
ভারত সরকার বনাম অখিল ভারতীয় শোষিত কর্মচারী সঙ্ঘের মামলায় ১৯৮১ সালে সুপ্রিম কোর্টের উপলব্ধি— এই সংবিধান সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের ফসল। যেখানে একটি শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল। এবং সবার জন্য সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট ‘বনধুয়া মুক্তি মোর্চা মামলা’য় বলেছিল, গরিব মানুষ যখন তাঁদের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য আদালতের কাছে আসেন, তখন আদালতের প্রয়োজন হয়। শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ— প্রথাগত পদ্ধতির বাইরে বেরিয়ে নতুন এমন কিছু করা প্রয়োজন, যা গরিব এবং সমাজের দুর্বল শ্রেণির মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করবে। এটা মাথায় রাখতে হবে যে, এই দুর্বল শ্রেণির মানুষেরা এ বার আদালতের দ্বারস্থ হতে শুরু করেছেন। ফলে এঁদের জন্য নতুন এবং ভিন্ন ধরনের আইনি লড়াইয়ের পথ এবং বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থার প্রয়োজন।
সুপ্রিম কোর্টের এই সমস্ত রায় ভারতের সমস্ত আদালতকে মানতে হয়। এই সব রায়ে বিচারব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে। সেটা মাথায় রেখে বলতেই হবে, বিচারপতিদের কর্তব্যপালনে এক অন্য ভাবনার সঞ্চার হওয়া উচিত। এখন সেই সময় এসেছে। এ সব কথা চিন্তা করেই ভারতীয় সংবিধানের ‘৩৯-এর ক’ ধারায় বলা হয়েছে যে, ন্যায়বিচারকে যেন আইন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করে, সেটা রাষ্ট্রের দেখা উচিত। এবং কেউ যেন ন্যায়বিচার থেকে অর্থনৈতিক বা অন্যান্য কারণে বঞ্চিত না হন, ৪২তম সংবিধান সংশোধনীতে তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
আইনের চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্যে না গিয়ে আবার বলছি, আদালতের এই ভূমিকা মানুষের মনে বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাকে অনেকটা দৃঢ় করেছে। সেটাই একটা শুভ লক্ষণ।
(লেখক সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান। মতামত নিজস্ব।)