যে বৈদগ্ধ হারালে গরিব হই
Presidency University

চিন্তা যত পরিণত হয়েছে, দ্বিভাষিকতার প্রতি দায় বোধ করেছেন

ভাষা আমরা তৈরি করি না, তৈরি-হওয়া ভাষাতে আমরা জন্মাই। তাই ভাষাই অনেক দূর সত্যকে রচনা করে।

Advertisement

মৈনাক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২১ ০৫:৩৮
Share:

তোমার হার্টবিটের মধ্যে, শরীরের মধ্যে কবিতা থাকতে হবে। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর দলবৃত্ত— ছন্দ ঘুরবে তোমার সারা শরীরে। যে লোকটা সারা জীবন কবিতা পড়েছে, সে কিন্তু কবিতাচ্যুত হলে মরেই যাবে। ওটা তার কাছে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো।”— স্বপন চক্রবর্তী কথাগুলো বলেছেন দাঁড়াবার জায়গা নামের একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। বলছেন, সেরিব্রাল স্ট্রোক হওয়ার পরে হাসপাতালের ওয়ার্ডে কেমন করে কবিতা ওঁকে ঘিরে থেকেছে। ব্যাপারটা উনি ‘ডাক্তারি শাস্ত্র দিয়ে’ বোঝার চেষ্টা করছেন। রোমান ইয়াকবসনের কথা এসেছে। মাথায় স্ট্রোক হলে আমাদের বাক্যে অ্যাফেসিয়া জাতীয় যে গোলমাল হয়ে যায়, ইয়াকবসন তার সূত্র ধরে মেটাফর আর মেটনিমির আলোচনায় পৌঁছেছিলেন। সেই বিখ্যাত আলোচনা বহু চিন্তাবিদকে ভাবিয়েছে। ভাষার এই দুই অক্ষ, মেটাফর আর মেটনিমি, যখন একে অন্যকে স্পর্শ করে তখনই আমরা কাব্যভাষাকে পাই। তাই স্বপনদার মনে হয়েছিল, “কবিতা হচ্ছে সম্পূর্ণ শারীরিক।” গত কয়েক বছরে বাংলা কবিতা নিয়ে একের পর এক প্রবন্ধ লিখেছেন। শরীরে কবিতা নিয়ে বসবাস করার কথা যে উনি এমনি বলেননি, সে সব লেখা পড়লে তা বোঝা যায়। এ এক যুদ্ধ। চার দিকে জাঁকিয়ে বসা ধারণা যে, জীবনের সার সত্য প্রযুক্তি দিয়ে মেপে নেওয়া যায়, বিজ্ঞান বা টেনেটুনে সমাজবিজ্ঞানে পৌঁছলে পরে জগৎটা ব্যাখ্যা করার সব অস্ত্র আমাদের হাতে চলে আসে— এর বিরুদ্ধে স্বপনদা লেখায় আর বক্তৃতায় লড়াই করছিলেন। সাহিত্য জ্ঞান হয়ে উঠতে পারে কি না, হিউম্যানিটিজ় পড়া কেন প্রয়োজন, এই প্রশ্নগুলোর সরাসরি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

Advertisement

ভ্রম-এর কথা ঘুরেফিরে ওঁর লেখায় এসেছে। ভ্রম আর ভ্রমণ শব্দ দুটো যে একই উৎস থেকে এসেছে, সে কথা বলছেন। যা ‘চরাচরের মধ্যে সীমায়িত রহস্যরূপ বিচ্ছুরিত’, তাকে বলে ভ্রম। আর ভ্রমণ হল, ভ্রম করতে করতে যাওয়া। কবিতার সত্য এই রকম, সেটা এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে মাপার সুযোগ দেয় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার উপর এক প্রবন্ধে স্বপনদা লিখেছেন যে, অন্য ভাষাতেও ভ্রম আর ভ্রমণের আত্মীয়তা আছে। লাটিন ‘এরারে’ শব্দের অর্থ ঘুরে বেড়ানো, আর একই উৎস থেকে এসেছে ‘এরর’। সুনীলের কবিতায় বার বার আসা ভ্রমর শব্দটা একই সূত্রে বাঁধা। ওঁর মতে, এইখানে সুনীল ভাষাকেই কবিতার বিষয়বস্তু করে তুলেছেন, লিরিক কবিতা থেকে ওঁর পথ আলাদা হয়ে গেছে। এই সরণ আর ভ্রম অস্থির অনির্দিষ্ট সত্যের ঠিকানা হয়ে ওঠে কবিতায়। লাটিনে ‘মেটাফর’-এর সমার্থক শব্দ স্থানান্তর বা তরজমা।

ভাষা আমরা তৈরি করি না, তৈরি-হওয়া ভাষাতে আমরা জন্মাই। তাই ভাষাই অনেক দূর সত্যকে রচনা করে। গত শতাব্দীর শেষ অর্ধে এই চিন্তা হিউম্যানিটিজ় তথা সমাজবিজ্ঞানে বড়সড় প্রভাব ফেলেছিল। স্বপনদার চিন্তা সেই তাত্ত্বিক যুগবদলের মধ্যে গড়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্সি কলেজ আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে যাদবপুরে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। অবসর নেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ডিফিল গবেষণা করেছিলেন অক্সফোর্ডে। জাতীয় গ্রন্থাগারের অধিকর্তা ছিলেন, আরও কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা দায়িত্ব পালন করেছেন। খুব বেশি দেশ-বিদেশ ঘোরেননি। এই শহর ছেড়ে বেশি দিন কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেন না। কিন্তু ভ্রমণ করেছেন জ্ঞানচর্চা আর সাহিত্যের প্রসারিত দেশে। গ্রিক নাটক থেকে সেন্ট অগাস্টিন, রেনেসাঁস মঞ্চ থেকে উনিশ শতকের সমালোচনা সাহিত্য, অভিনবগুপ্ত থেকে হানস গাডামার, বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু থেকে শঙ্খ ঘোষ— সংক্ষেপে সেই ব্যাপ্তির কথা বলা দুষ্কর। যা হাতের কাছে পেতেন, পড়ে ফেলতেন। পড়লে কোনও দিন ভুলতেন না। যাদবপুরে ওঁর ছাত্ররা বলত, শেক্সপিয়র উনি উল্টো দিক থেকে মুখস্থ বলতে পারেন! এক বার বলেছিলেন, আমার সমস্যা কী জানো, ফোটোগ্রাফিক মেমরি! সেটা নাকি সমস্যা! জীবনটা বেশি দিনের নয়, যা কিছু জানার আছে সব শুষে নিতে হবে, এই রকম একটা তাড়না ওঁর মধ্যে ছিল। শেক্সপিয়র আর টমাস মিডলটনের উপর আন্তর্জাতিক স্তরে কাজ করেছেন। বুক হিস্ট্রি নামক বিদ্যাচর্চায় আমাদের দেশে এক জন পথিকৃৎ ছিলেন। ইংরেজিতে লিখে গেলে দুনিয়ার লোকে আরও বেশি করে জানত স্বপনদার কথা। কিন্তু যত ওঁর চিন্তা পরিণত হয়েছে, তত বেশি করে বাংলায় লিখেছেন। দ্বিভাষিকতার প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে চিন্তা করেছেন। তাতে ওঁর চিন্তার ধরন বদলে গেছে। নিজের ভাষায় ঘর বেঁধে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া মননের যে ঐতিহ্য বাংলার ছিল, তার প্রতিনিধির সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। বাংলা ভাষা ছেড়ে আজকাল সবাই পালায়। স্বপন চক্রবর্তীর অভাব তাই মিটবার নয়।

Advertisement

স্বপনদা দর্শন পড়তেন গোয়েন্দা-কাহিনি পড়ার মতো আগ্রহে। আজকাল দর্শন বিভাগের বাইরে লোকে মূলত পশ্চিম ইউরোপের দর্শনের খবর রাখে। হিউম্যানিটিজ়ের যে নতুন তত্ত্ববিশ্বের কথা বলছিলাম, তাতে সেই জাতের চিন্তার প্রবল উপস্থিতি। স্বপনদা দেরিদা, জাক রঁসিয়েরের পাশাপাশি নিয়মিত মাইকেল ডামেট বা রিচার্ড রর্টির মতো ইঙ্গ-আমেরিকান স্কুলের দার্শনিকদের লেখাও পড়তেন। শেষের দিকের লেখায় ক্রমশ এসেছে ভারতীয় দর্শনের আলোচনা। এই চর্চা ওঁকে সাহিত্যের বিশ্লেষণে তার্কিক শৃঙ্খলা, যুক্তির সবল কাঠামো তৈরি করতে সাহায্য করেছে। কাব্যের সত্য নিয়ে আবেগ অনুভূতি দিয়ে কাজ সারার প্রশ্ন নেই এখানে। কোথায় তা বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান বা দর্শনের উপলব্ধি থেকে আলাদা, সেটা স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ‘সহৃদয়’ শব্দটা অনুসরণ করে ইংরেজি (‘Being Staged’) এবং বাংলা (‘উচ্চশিক্ষার খরচ: সাহিত্যের সঞ্চয়’) লেখায় পৌঁছে গেছেন অভিনবগুপ্তের কাছে। সহৃদয় পাঠক কাব্য অনুশীলন করে ‘মনের মুকুর স্বচ্ছ’ করে তুলতে পারে। সাহিত্যপাঠ তাই অনুশীলনের ব্যাপার, হৃদয় দিয়ে আপনি বোঝার ব্যাপার নয়। অভিনবগুপ্তের থেকে উনি শিখছেন: সাহিত্যের অভিজ্ঞতা এক সঙ্গে নৈকট্য ও ব্যবধানের অভিজ্ঞতা। সংশয়ী ব্যবধান সহৃদয় হয়ে ওঠার প্রধান শর্ত।

এই সব ভাবনা ওঁকে নৈতিকতা বা এথিকস-এর প্রশ্নে নিয়ে গেছে। অপরের হয়ে ভাবা, অপর হয়ে ওঠা, ভিন্নতার মর্যাদা রাখার অন্যতম শর্ত। ভাষার মধ্যে সহৃদয় প্রবেশ সেই কাজটার জন্যে আমাদের প্রস্তুত করে। সাহিত্য নামক একটা কোনও সংজ্ঞা কোথাও স্থির হয়ে আছে এমন মনে করতেন না। ওঁর এক প্রিয় উদাহরণ ছিল লুক্রেশিউস (খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক), যাঁর ‘দে রেরুম নাতুরা’ পদার্থবিদ্যার বই, কাব্যে লেখা। বিজ্ঞানের প্রয়োজন ফুরোবার পরে আজ সেই বই সাহিত্য বিভাগে পড়ানো হয়। লিখেছেন, এক দিন হয়তো ফ্রয়েডকেও লোকে সেই ভাবে পড়বে।

বইয়ের দেশ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে স্বপনদা জানিয়েছিলেন, ‘স্রেফ বাংলা ভাষার লিখিয়ে বলে ভাবলে’ উনি সবচেয়ে খুশি হন। ২০১৭ সালে এক সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত ওঁর ‘পুরনো চাল’ সিরিজ়ের লেখাগুলো পাঠক যে ভাবে পড়েছেন, তাতে আনন্দিত হয়ে কথাটা বলছেন। এই সব লেখায় অন্য রকম ভ্রমণ করেছেন স্বপনদা। মেলা, খাবার, পোস্টকার্ড, ছাতা এমন সব বিচিত্র বিষয়ে লিখতে গিয়ে এক কথা থেকে আর এক কথায় হালকা চালে সরে সরে যে ব্যাপ্ত বৈদগ্ধের পরিচয় দিয়েছেন তা অবাক করা মজার জিনিস। এমন কথক, এমন শিক্ষক, এমন ভাবুককে হারালে একটা গোটা ভাষা গরিব হয়ে যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement