শম্ভু মিত্র আর তৃপ্তি মিত্রের বাড়িটির কথা মনে পড়ছে দু’দিন ধরে। শম্ভুজেঠু খুব নিয়মানুবর্তী মানুষ ছিলেন, সব সময় সোজা হয়ে বসতেন। তৃপ্তিজেঠিও তাই। বাড়িটা ছিল অপূর্ব, ঢুকলেই যেন একটা ল্যাভেন্ডারের গন্ধ পেতাম।
এই যে নিয়মানুবর্তিতা, একটা চারিত্রিক দৃঢ়তা, সেটা কিন্তু শেখার মতো বিষয় ছিল। কথাগুলো ভাবছি, কারণ এই সমস্তই শাঁওলী মিত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমার মনে আছে মা স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত যখন গালিলেওর জীবন নাটকে অভিনয় করতেন, আমি তখন শাঁওলীমাসির কোলে বসে থাকতাম। তাঁর সেই স্পর্শে উষ্ণতার ছোঁয়া ছিল, দৃঢ়তারও— যদিও কোনওদিন বকেননি, জোরে কথা বলেননি। বাবা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের কাছে গল্প শুনছিলাম, “শাঁওলী ছোটবেলায় একটু অসুস্থ ছিল। তার পর হঠাৎ এক দিন সেটা কাটিয়ে উঠে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠল। তার পর প্রচুর কাজ করতে শুরু করল। নাথবতী অনাথবৎ, কথা অমৃতসমান, বিতত বিতংস-র মতো দামি দামি সব কাজ। নাথবতী অনাথবৎ যখন ও একা করতে শুরু করল, সারা কলকাতা শহরের, বিশেষত নাট্যপরিসরে একটা সাড়া পড়ে গেল। এতটাই সংবেদনশীল সেই প্রযোজনা যে বহু মানুষকে নাড়া দিতে পারল। দুর্দান্ত পারফর্মার শাঁওলী। মঞ্চে যখন একা থাকত এবং ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রকে এক সঙ্গে অভিনয় করত তখন ওই চরিত্রগুলো তো শুধু ওর থাকত না, যেন আমাদেরও হয়ে যেত।”
বাবা আরও বলছিলেন, “ওর সঙ্গে খুব একটা কাজ করার সুযোগ আমাদের হয়নি। এক বারই আমরা খুব পাশাপাশি থেকে কাজ করেছিলাম যখন গালিলেওর জীবন নাটকটা করি। ফ্রিৎজ্ বেনেউইৎজ্-এর নির্দেশনায় এই নাটকটায় কলকাতার সব নামীদামি অভিনেতারা অভিনয় করেছিলেন। তাতে সব চরিত্র ঠিক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু গালিলেওর মেয়ের ভূমিকায় কে অভিনয় করবে সেই নিয়ে একটু দ্বন্দ্বে ছিলাম। আমাদের ভাবনায় ছিল তিন জন, জোছনের (দস্তিদার) স্ত্রী চন্দ্রা, স্বাতীলেখা আর শাঁওলী। চন্দ্রা অনেক আগেই সরে গেল। স্বাতীও বলল, ওই পার্টটা শাঁওলীরই। স্বাতী তার বদলে অন্য একটা চরিত্রে অভিনয় করল। শাঁওলী অসম্ভব প্রশংসা কুড়োলো মানুষের।”
যাঁর কোলে আমি ছোটবেলায় বসে থাকতাম, আর নাথবতী অনাথবৎ করার সময় যাঁকে আমি দেখেছি, দু’জন যেন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। আমার মনে হত, মঞ্চে যিনি আসেন তিনি একজন সুপার(উয়ো)ম্যান। এক জন মহিলা যখন পুরুষের ভূমিকায় অভিনয় করছেন— তাঁর যে ভঙ্গি, যে গলা, মনে হত চোখের সামনে হাজারটা চরিত্র হয়ে যাচ্ছেন তিনি একাই। এই অভিজ্ঞতা অভাবনীয়।
তবে আমার কাছে হয়তো শাঁওলীমাসির সব থেকে প্রিয় পারফরম্যান্স বিতত বিতংস নাটকে। শেষের দিকে এক দৃশ্যে শাঁওলীমাসি ডাউন স্টেজে এসে দু’হাত তুলে একটা সংলাপ বলতেন, যেটা শুনে শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যেত, মনে হত যেন কোনও দিন এ রকম অভিনয়ের স্তরে পৌঁছতে পারি।
তবে আমার বার বার মনে হয়, উনি যদি আরও একটু বেশি অভিনয় করতেন, তা হলে বোধ হয় আমাদের পক্ষে ভাল হত। এ কথা অবশ্য আমার মায়ের সম্পর্কেও অনেকে বলেন। কিন্তু বুঝতে পারি, বিষয়টা তো ব্যক্তিগত ইচ্ছের উপর নির্ভর করে।
খুব মার্জিত মানুষ ছিলেন শাঁওলী মিত্র— পণ্ডিতও। আমার মনে হয়, যাঁরা এ রকম পণ্ডিত হন, তাঁদের জোর করে ছেলেমেয়েদের অনেক কিছু শেখানো উচিত। এ আমার ব্যক্তিগত মত, নয়তো পরবর্তী প্রজন্মের কিছু শিখে উঠতে পারাটাই যে মুশকিল। একটা পারফরম্যান্স করতে গেলে যে কতটা পড়াশোনা, পরিশ্রম, মগ্নতা প্রয়োজন হয়, সেটা না জানলে বা না বুঝলে পারফরম্যান্সগুলো হয়ে যায় বুদবুদের মতো ক্ষণস্থায়ী, বোঝা জরুরি।
শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, শাঁওলী মিত্রের যে অভিনয়ধারা, তার থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের ভিতরে আত্মমগ্ন থেকে যদি আমরা অভিনয়ের চর্চা করতে পারি, তা হলে তা নিয়ে বহু বছর পরে গিয়েও অনেকে আলোচনা করবেন। ওঁরাও হারিয়ে যাবেন না। আসলে আজকাল মনে হয়, এই রকম মানুষরা যত হারিয়ে যাচ্ছেন, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যমঞ্চটা খালি হয়ে যাচ্ছে। একটা পুরো যুগ, একটা ইতিহাস দ্রুত মুছে যাচ্ছে। মনে হয়, কোথায় গেলেন তাঁরা— যাঁদের আমাদের থেকে বেশি স্পর্ধা আর সাহস ছিল, যাঁরা আমাদের থেকে অনেক বেশি নির্লোভ ছিলেন!
বাবার কথাই বলি আবার। আমাকে বলছিলেন, “আমরা তো ভীষণ ভাবে জীবিত মানুষকে আঁকড়ে ধরে থাকতে ভালবাসি। সেই জায়গা থেকে চলে যাওয়াটা একটা শূন্যতার সৃষ্টি করেই। তবে মানুষ মরে গেলেও কিন্তু ‘মরে’ যায় না। সে থেকে যায় তার কাজের মধ্যে। কোনও দামি মানুষ চলে গেলে তার জন্য শোক করবে যেমন, তেমনই তাকে নিয়ে যদি আরও একটু ভাবতে পারো, তার কাজ নিয়ে যদি একটু রিসার্চ করতে পারো, তা হলে সেই মানুষের মৃত্যু অসম্ভব। সে বেঁচে থাকবে তোমাদের মতো অনেকের মধ্যে।”
শাঁওলীমাসি আমার কাছে তেমনই এক জন মানুষ। তাঁকে, তাঁদের ধরে রাখা আমাদেরই কাজ।