সহযাত্রী: কলিম শরাফী (বাঁ দিকে) ও খালেদ চৌধুরী। কলকাতা, ২০০২
দেবব্রত বিশ্বাসকে নিবিড় ভাবে চেনেন যাঁরা, তাঁরা জানেন ওঁর মুখের অতিপ্রিয় এই ‘গালাগালি’টিও: “শাট আপ ইউ মিডল ক্লাস!” বলেছিলেন দাঙ্গাবাজদের মুখের উপর। যারা রক্তারক্তি খুনখারাবি বাধায়, তারাই কি শুধু দাঙ্গাবাজ? যারা ও-সব করে না কিন্তু মুখে আর মনে শুধুই ‘হিন্দু-মুসলমান’ করে যায়, সাদা আর কালো আড়াআড়ি দু’ভাগে ভাগ করে রাখতে চায় সব কিছু, হাওয়ায় গন্ধ শুঁকে হাজির হয় অসাম্প্রদায়িককে শূলে চড়াতে, তারাও সমান দুর্বৃত্ত। এবং ঘটনাচক্রে অনেক সময়েই এদের পরিচয় লেখাপড়া-জানা, সংস্কৃতিমনস্ক। দলবল জুটিয়ে এমন লোকেরাই খুব সম্ভবত চড়াও হয়েছিল জর্জ বিশ্বাসের রাসবিহারীর বাড়িতে: কেন তিনি তাঁর বাড়ির খাটের তলায় লুকিয়ে রাখলেন কলিম শরাফীকে— হিন্দু হয়ে কাজটা কী ঠিক হল?
কে কলিম শরাফী? বীরভূমের ছেলে, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন করেছে, জেলে কাটিয়েছে বছরখানেক, কমিউনিস্ট পার্টি আর বামপন্থা আঁকড়ে ধরেছে তার পরে, মন্বন্তরের সময় লঙ্গরখানায় খিচুড়ি খাইয়েছে বুভুক্ষু মানুষকে, চমৎকার গানের গলা তাই গণনাট্য সঙ্ঘ বা আইপিটিএ-র গানের দলের অন্যতম স্তম্ভ। তাতে কী? ধর্মপরিচয়ে তো মুসলমান! সেটাই হল কথা। ১৯৪৬-এর ১৬ অগস্ট, ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র কলকাতায় প্রাণ বাঁচানোর একমাত্র পাসপোর্ট হিন্দুর হিন্দুপাড়ায় থাকা, মুসলমানের মুসলমান মহল্লায়। সে কেন নিয়ম ভেঙে পার্ক সার্কাস পেরিয়ে আসবে এ-দিকে, দক্ষিণে?
কলকাতার এই দিনটা, এবং বিশেষ করে এই ভয়ঙ্কর সময়টার কথা কলিম শরাফী যে ভাবে লিখে গিয়েছেন তাঁর মিতায়তন স্মৃতিকথায়, আজকের বাঙালি তার খবর রাখলে বুঝত, ক্যালেন্ডারে এতগুলো বছর পেরোলেও বাঙালির কী কী পাল্টাল, বা পাল্টাল না। “হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যে কাণ্ডকারখানা দেখলাম তাতে যেকোনো লোকের পক্ষে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। রেড ক্রস-মার্কা, নানা ভাষায় নানা ধরনের ফেস্টুন হাওয়ায় দুলছে। আর স্বেচ্ছাসেবীরা হাতে রেড ক্রসের পট্টি বেঁধে কেউ-বা গান্ধী টুপি, কেউ-বা চাঁদ-তারামার্কা টুপি, আবার কেউ পাগড়ি বেঁধে বিভিন্ন ধর্মের যাত্রীদের সাহায্য করার জন্য ছোটাছুটি করছে। আমায় দেখে এক সর্দারজি এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, আমি কোথায় যাব।... বালিগঞ্জ স্টেশনের নাম উচ্চারণ করতেই সর্দারজি আমায় ধরে নিয়ে স্টেশনের বাইরে দাঁড়ানো একটি বাসে তুলে দিল।... হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে রাস্তার দু-ধারে কিছু মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখলাম।”
সর্দারজি কেন মুসলমান ছেলেকে ধরে হিন্দু পাড়ার বাসে তুলে দিতে যাবেন? কারণ— কলিমের পরনে সে দিন ছিল ধুতি-পাঞ্জাবি। এ সব কায়দা-কৌশল না জানলে হিন্দু-মুসলমানের ভারতবর্ষে চলবে কেন। আইপিটিএ-র হয়ে বাংলা আর অসমের প্রত্যন্ত এলাকায় অনুষ্ঠান করার সময় কলিম শরাফীর নাম হয়ে যেত কল্যাণ মিত্র, তাঁর প্রাণের বন্ধু খালেদ চৌধুরী তখন কালী চৌধুরী! ওই ধুতি-পাঞ্জাবির জোরে বাসে আসা গিয়েছিল মুসলমানদের বাপান্ত করা হিন্দু সহযাত্রীদের ভিড়ে মিশে। ভেবেছিলেন ভবানীপুরে সুচিত্রা মিত্রের বাড়ি যাবেন, পথে দেখা-হওয়া এক বন্ধু কানে কানে বারণ করল, এ পাড়ায় নামলে বিপদ আছে! অগত্যা রাসবিহারী মোড়, হেঁটে ‘জর্জদার বাড়ি’, দরজা খুলে তাঁকে দেখেই যাঁর চিৎকার, “শা... বাঁইচা আছে!” সে বাড়িতেই তখন বাসিন্দা আইপিটিএ-র দুই কমরেড শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্রও। এক সপ্তাহ সেই বাড়িতে একটা কামরার মধ্যে লুকিয়ে থাকা, অনেক সময় খাটের তলাতেও— পাড়াপ্রতিবেশী, এমনকি কাজের লোকেও যেন জানতে না পারে। যখন জানা গেল বাস বালিগঞ্জ থেকে এসপ্ল্যানেডের দিকে বাস চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে, তেমনই এক দিন, কলিম শরাফীর ভাষায় ‘ডিটেকটিভ স্টাইলে’ প্ল্যান সারা: “শম্ভুদা বেরিয়ে রাস্তার পাশে ফুটপাতে দাঁড়ালেন। বাস থামলেই আশপাশের অবস্থান থেকে হাঁক দেবেন তখন আমি ও জর্জদা ঘর থেকে ছুটে এসে বাসে উঠব।... সারা পথ এই অবস্থায় কাটার পর আমরা নিউট্রাল জোনে অর্থাৎ এসপ্ল্যানেডে পৌঁছলাম।” সেখানে মুজফ্ফর আহমদের হাতে কলিম শরাফীর দায়ভার সঁপে নিশ্চিন্তি।
এই যে প্রাণ হাতে করে ‘বিপজ্জনক বাঁচা’, এ থেকে তো দূরে থাকতেই পারতেন কলিম শরাফী। কিংবা তাঁর জীবননাট্যে আর যাঁরা প্রধান অপ্রধান কুশীলব— দেবব্রত বিশ্বাস বিজন ভট্টাচার্য শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্র জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র সলিল চৌধুরী সুচিত্রা মিত্র খালেদ চৌধুরী প্রমুখ আরও কত জন, তাঁরাও। বলেননি, কারণ সময়ের প্রতি শিল্পীর একটা দায়িত্ব আছে, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। যে দায়িত্ববোধ বলে, রাজনীতি যদি কেবল মানুষকে হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করে, তুমি শিল্পী হিসেবে সেই ভাঙা মানুষকে জুড়বে। যখন যেমন আঘাত আসবে মানুষের উপর, পারলে প্রতিহত করবে, নয়তো দেবে শুশ্রূষা। তা হতে পারে দুর্ভিক্ষের বাংলায় লঙ্গরখানা খুলে খিচুড়ি-সেবা, শিল্পীই খাওয়াবে। হতে পারে ওই দাঙ্গার শহরে ছোটাছুটি করে সাহায্য, কিংবা ঘরে লুকিয়ে রেখে আশ্রয়দান, শিল্পীই দেবে। সেই শিল্পীই গাঁ-গঞ্জ, পাহাড়-প্রত্যন্ত ঘুরে গাইবে গণসঙ্গীত আর ‘নবজীবনের গান’, অভিনয় করবে নবান্ন বা পথিক, শহীদের ডাক। যখন বাইরের, মানুষের ডাক আসছে বারংবার, তখন গৃহকোণে নিভৃত সাধনও অপরাধ।
পথে নামলেই যে পৌঁছনো যায়, তা-ও নয়। নিজেদের পার্টিলাইনও গ্রাস করতে চায় শিল্পীকে, শম্ভু মিত্র সলিল চৌধুরী কলিম শরাফীরা তারও সাক্ষী, এবং শিকার। ১৯৪৮-এ বি টি রণদিভের ‘আলট্রা-লেফ্ট’ তত্ত্ব কুক্ষিগত করতে চাইছিল শিল্প ও শিল্পী দুই-ই। তখন রবীন্দ্রনাথও অপাঙ্ক্তেয়, কোন গান গণসঙ্গীত হিসেবে গাওয়া যাবে তাতেও লাগবে অনুমতি। দম বন্ধ হয়ে না এলে বোধ হয় বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার গুরুত্বটুকুও ভুলতে বসে মানুষ। আইপিটিএ থেকে বিদায়ের পর সেই শ্বাস ও আশ্বাস হয়ে এল বাংলা থিয়েটার তথা সংস্কৃতি ‘বহুরূপী’র প্রতিষ্ঠা, সেখানেও তো শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্র মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রমুখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে কলিম শরাফী! ‘গ্রুপ থিয়েটার’-এর পথপ্রদর্শক হিসাবে বহুরূপী-র গুরুত্ব ও প্রভাব প্রায়ই স্মরণ করি আমরা, কিন্তু যে সময়ের গর্ভে, যে যাপিত অভিজ্ঞতার প্রয়োজন থেকে তার সৃষ্টি, সেই প্রেক্ষাপটটা তত তলিয়ে ভাবি না।
এই সব কিছু হওয়ার পরেও একটা ক্ষত দগদগে হয়েই রইল কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে, কলিম শরাফী এখানে থাকতে পারলেন না। একদা দিনে ‘দক্ষিণী’তে রবীন্দ্রগানের চর্চা আর বিকেলে আইপিটিএ, এই ছিল যাঁর রুটিন, স্বাধীনতা-উত্তর দেশে এই শহর বা রাজ্য সেই মানুষটিকে কোনও আয়-রোজগারের সুযোগ দেয়নি। কারণটা পরিষ্কার, ওই যে ধর্মপরিচয়! চাকরিবাকরি নেই, ওই উদাত্ত বলিষ্ঠ গলা সত্ত্বেও কেউ একটা গানের টিউশনি দিচ্ছে না, কলিম শরাফী চলে যেতে বাধ্য হন পূর্ববঙ্গে। সেও যে খুব সুখকর অভিজ্ঞতা তা নয়। পাকিস্তান আমলে ক্রমাগত তাঁকে কোণঠাসা করার চেষ্টা হয়েছে, রেডিয়োতে গান গাওয়ায় কোপ পড়েছে, রেকর্ডে এসেছে নিষেধাজ্ঞা। এতটাই যে, এক জন শিল্পীর গানের গলার যে সোনার সময়, সেই যৌবনকালটাই তাঁকে কাটাতে হয়েছে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ নিষেধ আর বারণের মধ্যে! মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন লন্ডনে, সেখানে গান গেয়ে আর শিল্পীর সহজাত আবেগে স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন প্রবাসী বাঙালিদের। স্বাধীন বাংলাদেশেও তাঁর প্রকৃত মূল্যায়ন হতে হতে ক্যালেন্ডারে গড়িয়ে গেল আশির দশক, তার আগে পর্যন্ত পুরোটাই এক অর্থে শিল্পী আর রাষ্ট্রের সংঘাতের ইতিহাস। উদারবাদী, অসাম্প্রদায়িক, গণজাগরণপন্থী শিল্পীকে খোপবন্দি করে রাখার চেষ্টা।
অমন যে স্বর্ণকণ্ঠ, তা রবীন্দ্রগানকে আশ্রয় করে থেকেছে বাকি জীবন। এখনও প্রকৃত সঙ্গীতরসিক চেনেন কলিম শরাফীর গলা, সমাজমাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসে ওঁর গাওয়া এক-একটি হীরাপান্না: আমি তখন ছিলেম মগন, বড়ো বেদনার মতো বেজেছ, আমি চঞ্চল হে, আজি ঝড়ের রাতে— আরও কিছু কিছু। সিডি-ক্যাসেট-অ্যালবামের সংখ্যা হাতে গোনা যাবে এত কম। তবু তাঁর বেলাশেষের আনন্দ ছিল রবীন্দ্রগান গাওয়ার শিক্ষাটি হাতে ধরে শিখিয়ে যাওয়ায়; তরুণবয়সে রাজনীতির সংস্রব যাঁর শান্তিনিকেতনে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছিল, সেই তিনি ঢাকায় তাঁর হাতে গড়া গানের ইস্কুলের নাম রাখলেন ‘সঙ্গীত ভবন’।
২০১০-এ প্রয়াত শিল্পীর জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হল এ বছর। এই বাংলার কেউ কেউ এখনও চেনেন ওঁকে, ‘দারুণ গলার এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী’ হিসেবে, ব্যস। তার আগের জীবন আর সময়টুকু মুছে গেছে, ভেসে গেছে যেন গঙ্গার জলে!